শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ছক মোতাবেক সাজানো হচ্ছে প্রশাসন

তোফাজ্জল হোসেন কামাল : প্রশাসনে চলছে শেষ মুহূর্তে রদবদল, পদায়ন-পদোন্নতি, বাধ্যতামুলক অবসর, চাকরিচ্যুতি আর ওএসডি। সরকারের শেষ সময়ে এসে শীর্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ের সর্বস্তরেই এ কাজটি করা হচ্ছে আগামী দিনের বিশেষ উদ্দেশ্যে। এ তৎপরতাকে ‘নির্বাচনমুখী’ বলে মন্তব্য করেছেন পর্যবেক্ষকমহল। তাদের অভিমত, ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবরের সাধারণ নির্বাচনের আগেও তৎকালীন সরকার প্রশাসনের সর্বস্তরে একটি সিঁড়ি তৈরি করেছিল। কিন্তু সাধারণ নির্বাচনে সাজানো সিঁড়িটি কাজে আসেনি। জনমত তাদের সুচিন্তিত রায় প্রদান করে নীরবে এসবের প্রতিবাদ জানায়।

পর্যবেক্ষক মহলের মতে, একটি জাতীয় নির্বাচনে জনপ্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচারবিভাগের সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে তাদের ভাবনা এবং কর্মকা-কে ঘিরে একটি অবস্থা তৈরির পর সেটি নির্বাচনে প্রভাব ফেলে।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকালীন প্রশাসন কেমন হবে, তারা কার স্বার্থে দায়িত্ব পালন করবে, কারা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্ব পালন করবে, কাদের নির্দেশে ভোট কেন্দ্রের কর্মকর্তারা পরিচালিত হবে-এমন সব ভাবনা দেশবাসীর মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তার চেয়ে বেশি ভাবনায় আছে সরকার এমন ধারণার সৃষ্টি হয়েছে জনমনে। কারণ সরকার তার অধীনস্ত জনপ্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, জুডিশিয়াল ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ বিচার বিভাগের সর্বস্তরে একটি ছক মোতাবেক সাজানোর কাজ যেভাবে চালাচ্ছে তাতে জনমনে আগামীর ভাবনা এখনই ভাবাচ্ছে। তারাও বিভিন্ন হিসাব নিকেষ শুরু করেছেন।

জানা গেছে, মূলত ভবিষ্যৎ নির্বাচনী ছক কষার অংক মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেই শুরু করে। দায়িত্ব নেয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যে সরকার বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত ও সন্দেহভাজন বেশ কিছু কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়। যাদের আর পোস্টিং দেয়া হয়নি। কিছু অংশকে ডাম্পিং কিংবা হয়রানিমূলক পোস্টিং দিয়ে কাবু করা হয়। এছাড়া এ তালিকার বেশিরভাগ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি না দিয়ে একেবারে পেছনের কাতারে বন্দি করে ফেলা হয়। পদোন্নতি ও ভালো পোস্টিং না পাওয়ায় এরা প্রশাসনের মধ্যে গত সাড়ে চার বছরে তেমন কোনো প্রভাব রাখতে পারেননি। আর যারা তদবির করে পোস্টিং নিতে পেরেছেন তারাও ছিলেন কোণঠাসা। এতে করে প্রথম অংশের বাস্তবায়ন এরই মধ্যে অনেকটা যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এখন নির্বাচন যেহেতু সংবিধান অনুযায়ী নবম সংসদের মেয়াদ ২৫ জানুয়ারি শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে (২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত হবে তাই চূড়ান্ত পর্ব বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে মে মাসে শেষ সপ্তাহ থেকে বাধ্যতামুলক অবসর দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

যে কারণে বাধ্যতামূলক অবসর : সরকার জানে যাদের বাধ্যতামুলক অবসর দেয়া হচ্ছে সরকার পরিবর্তন হলে তারা ফের চাকরিতে ফিরে আসবেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখন বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হচ্ছে ভিন্ন কারণে। এ কারণ সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিএনপি ও জামায়াতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত কর্মকর্তাদের শুধু ওএসডি অবস্থায় রেখে গেলে কোনো লাভ হবে না। বরং ক্ষতিই বেশি হবে। কেননা, নির্বাচন করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এলে মিডিয়াসহ নানা মহলের চাপে প্রশাসনে লেবেল প্লেইং ফিল্ড তৈরির নামে এদের পদায়ন করতে হবে। এর মধ্যে অনেকে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বও পেয়ে যাবেন, যা আওয়ামী লীগের জন্য বুমেরাং হবে। দীর্ঘদিন পর এরা গুরুত্বপূর্ণ পদে ফিরে এলে কর্মরত কর্মকর্তাদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়বে এবং তারা কার্যত সর্বশক্তি নিয়ে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের বিরুদ্ধে কাজ করবেন। যারা সচিবালয়ে থাকবেন তারা মাঠের কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করবেন। আর যারা সরাসরি মাঠ প্রশাসনে পোস্টিং পেয়ে যাবেন তাদের অনেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব নিয়ে ভোট কেন্দ্রে কৌশলে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীদের পক্ষে ভূমিকা রাখবেন। এ জন্য সরকার ক্ষমতা থেকে যাওয়ার আগে ১৮ দলীয় জোটপন্থী হিসেবে চিহ্নিত কিংবা সন্দেহভাজন প্রথম সারির কাউকে চাকরিতে বহাল রাখতে রাজি নন। বিশেষ করে যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর হয়েছে তাদের বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হবে। এমনকি সরকারের একটি মহল এ বয়সসীমা ২৫ থেকে ২০ বছরেও নামিয়ে আনতে আইন সংশোধন করার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। এর বাইরেও চিহ্নিত ও সন্দেহভাজন তালিকার যেসব কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বিদায় করা সম্ভব হবে না তাদের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন বরাবরে লিখিত অভিযোগ দেযা হবে। উদ্দেশ্য, যাতে তাদের কাউকে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদায়ন না করা হয়।

সূত্র জানিয়েছে, এখন যেসব অতিরিক্ত সচিবদের বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হচ্ছে তাদের ব্যাচের জুনিয়ররা অনেক আগে থেকে সচিব পদে দায়িত্ব পালন করছেন। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর তারা চাকরিতে থাকলে অনেকে ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে পোস্টিং পেয়ে যেতে পারেন। কেননা, ব্যাচের জুনিয়র কিংবা জুনিয়র ব্যাচের সচিবদের অধীনে এসব অতিরিক্ত সচিবদের পোস্টিং দেয়া সম্ভব হবে না। একইভাবে দীর্ঘদিন অন্যায়ভাবে ওএসডি থাকায় অনেক যুগ্ম সচিব প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টিং পেয়ে যেতে পারেন। ফলে দৃশ্যত এসব কর্মকর্তাকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত চাকরির বাইরে রাখতে আগাম এ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকজনকে অবসর দেয়া হয়েছে।

পদোন্নতি চাকরিচ্যুতি!

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় মাস সময় আগে জনপ্রশাসনে বড় ধরনের পদোন্নতির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটি সম্ভবত এ সরকারের আমলে শেষ পদোন্নতি। বিপুল প্রত্যাশার বিপরীতে এই পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু করা হলেও শেষপর্যন্ত তা কতটা নির্বাচনী লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হবে তা নিয়ে আগে-ভাগেই প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। যোগ্য ব্যক্তিরা পদোন্নতি না পেয়ে ব্যক্তি বিশেষের পছন্দ-অপছন্দ গুরুত্ব পেলে এই পদোন্নতি শেষ মুহূর্তে প্রশাসনে ক্ষোভের মাত্রা বাড়াতে পারে এমন আশঙ্কা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অনেকে বলেছেন এটা নির্বাচনী পদোন্নতি! পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করেও যারা দীর্ঘদিন অপেক্ষায় রয়েছেন তাদের পদোন্নতি দেয়া সরকারের আবশ্যিক দায়িত্ব।

সূত্র জানায়, চলতি সপ্তাহেই পদোন্নতির জন্য সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সভা হবার কথা রয়েছে। এদিন উপসচিব থেকে যুগ্ম-সচিব এবং যুগ্ম-সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির বিষয় বিবেচনা করার কথা।

এদিকে আরো কিছু কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা বিরোধী দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সখ্যতা গড়ে তুলছেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে যেসব রাজনৈতিক গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করছে তাদের সঙ্গে এদের যোগাযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে সাবেক স্পিকার বিএনপি নেতা জমির উদ্দিন সরকারের একান্ত সচিব অতিরিক্ত সচিব নাসিমুল গনিকে অবসর দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিএনপি ও জামায়াতের তৎকালীন দু’জন মন্ত্রীর একান্ত সচিব ছিলেন এমন দু’জন অতিরিক্ত সচিবকেও অবসর দেয়ার প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়েছে বলে জানা গেছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানায়, বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডারে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির জন্য অপেক্ষমান রয়েছেন ১৯৮৪ সালের এবং এর আগের ব্যাচের ২৯৬ জন এবং যুগ্ম-সচিব হওয়ার জন্য ১৯৮৬ ব্যাচের ২০৭ জন, ১৯৮৫ ব্যাচের ৩০১ জন, ১৯৮৪ ব্যাচের ১৬৯ জন এবং ১৯৮৫ ব্যাচের ওপরের ব্যাচের ২৩ জন কর্মকর্তা। বর্তমান সরকারের সময়ে তিন দফায় ১৬৩ জন যুগ্ম-সচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এর মধ্যে ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি ৭২ জন, ৭ সেপ্টেম্বর ৬০ জন এবং ১০ অক্টোবর ৩১ জন। অবশ্য দুই দফা পদোন্নতি বঞ্চিত ২৯ জন কর্মকর্তা শেষবার অতিরিক্ত সচিব হয়েছিলেন। যুগ্ম-সচিব পদে তিন দফায় এক হাজার ২১৫ জন পদোন্নতি পান। এর মধ্যে ২০০৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ৮৬ জন, ৭ সেপ্টেম্বর ১৬৩ জন, ২১ নবেম্বর ১৬৬ জন। যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতির সময়ে অন্তত ১৫০ জন কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে জ্যেষ্ঠতা হারান। এখনো তারা উপ-সচিব। যদিও তাদের সহকর্মীরা এখন যুগ্ম-সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব হতে চলেছেন। এবার বঞ্চিতদের মধ্য থেকে কতজনকে বিবেচনা করা হবে তা নিশ্চিত নয়। তবে বঞ্চিতদের খুব বেশি সংখ্যক কর্মকর্তা পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হচ্ছেন না তা নিশ্চিত করেছেন এসএসবির একটি সূত্র। এ সরকারের সময়ে দুই দফার উপসচিব পদে পদোন্নতি পান ৫৭৮ জন। ২০০৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ২৮০ জন এবং ২০১০ সালের ১৫ অক্টোবর ২৯৮ জন। প্রথম দফায় ৯ম ও ১০ম ব্যাচের এবং দ্বিতীয় দফায় ১১ এবং ১৩তম ব্যাচের ১৪ জনসহ ২৯৮ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়। সর্বশেষ গত ১৪ মার্চ ১৮৯ জন কর্মকর্তাকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।

প্রশাসনের আলোচ্য তিনটি স্তরের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা দফায় দফায় পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন। ১৯৮২-এর নিয়মিত এবং বিশেষ ব্যাচের কর্মকর্তারা এখন সচিব। ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তারাও অনেকে উপসচিব আছেন। ১৯৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে এবার যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু হবে। যদিও এ ব্যাচের অনেকেই এখনো সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব হতে পারেননি।

সূত্রমতে, জনপ্রশাসন এখন থেকেই নির্বাচনমুখী তৎপরতা শুরু হয়েছে। বিএনপি ও জামায়াত সমর্থক হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তারা যাতে সরকারবিরোধী কিছু করতে না পারেন, সে লক্ষ্যে সরকার তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাচ্ছে। গত ২৯ মে থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ১৩ দিনে অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম-সচিব পর্যায়ের চারজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরের নামে কার্যত চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আরো কিছু কর্মকর্তাকে এ পথে পাঠানো হতে পারে। এর পাশাপাশি নির্বাচন মাথায় রেখে মাঠ প্রশাসনসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে।

জানতে চাইলে জনপ্রশাসন সচিব আব্দুস সোবহান সিকদার বলেন, আমাদের হাতে কোনো তালিকা নেই। তবে সরকার যদি প্রয়োজন মনে করে তাহলে কোনো কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাতে পারে।

নির্বাচনমুখী প্রশাসন : জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, নির্বাচনমুখী তৎপরতার অংশ হিসেবে প্রশাসন সাজানোর কাজও চলছে। এর অংশ হিসেবে মাঠ প্রশাসনে জেলা প্রশাসকসহ (ডিসি) গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়া শুরু হয়েছে। সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের পদায়নের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। শিগগিরই সচিবালয়েও কিছু পরিবর্তন হচ্ছে বলে জানা গেছে।

গত পৌনে দুই মাসে ১১টি জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর আগে গত বছরের শেষ দিকে ৩০ জন নতুন ডিসি নিয়োগ দেয়া হয়, যাদের মধ্যে রয়েছেন কয়েকজন মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির একান্ত সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। আরো নতুন ডিসি নিয়োগের জন্য উপযুক্ত কর্মকর্তাদের তালিকা (ফিট লিস্ট) তৈরির কাজ চলছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) পদেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে।

শেষ বেলায় আরেক দফা পদোন্নতির উদ্যোগ : জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, পদ না থাকার পরও সরকারের শেষ সময়ে এসে আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের জন্য যুগ্ম-সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ে আরেক দফা পদোন্নতির দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য গত মঙ্গলবার পদোন্নতিবিষয়ক সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সভা হয়েছে। সেখানে উপসচিব থেকে যুগ্ম-সচিব পর্যায়ে পদোন্নতি পাওয়ার মতো যোগ্য কর্মকর্তাদের নাম নিয়ে আলোচনা হয়। পদোন্নতির জন্য যোগ্য কর্মকর্তাদের চাপও আছে সরকারের ওপর।

এর আগে গত মার্চ মাসে উপসচিব পদে ১৮২ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, পদ না থাকায় এক বছরের বেশি সময় ধরে যুগ্ম-সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা এক স্তর নিচের পদে চাকরি করেছেন। তারপরও পদোন্নতি চলছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে কাজ করে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আনসার। এই চারটি বাহিনীর রয়েছে দু’লাখ সদস্য। শুধুমাত্র পুলিশ বাহিনীর সদস্যই ১ লাখ ৫২ হাজার। এই চারটি বাহিনীই পরিচালিত হয় সরকারি নির্দেশে। দেশের স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়া ভোট কেন্দ্রগুলোতেও তাদের যথেষ্ট প্রভাব থাকে। নির্বাচনকালীন সময়ে তারা জনমনে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তাই তাদেরকে কাজে লাগানোর আয়োজন করে থাকে সরকার। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই বর্তমান সরকার তার সময়কালে নানাভাবে ব্যবহার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। দফায় দফায় নিয়োগ, পদোন্নতি, রদবদল, চাকরিচ্যুতি, ওএসডির ঘটনা ঘটেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে। দলীয় তকমাধারীরাই বিগত সময়ে ভালো পর্যায়ে ছিল এবং আছে। আগামী নির্বাচনে তাদেরকে সামনে রেখে গোটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাজে লাগাতে নানামুখী পরিকল্পনা ও ছকে সাজানো হয়েছে। স্তরে স্তরে আসীন সুবিধাভোগীরা।

জানা গেছে, পুলিশ বাহিনী একটা বড় হাতিয়ার। এই হাতিয়ার যার পক্ষে অবস্থান নেবে তার পক্ষেই জনমত গঠনে প্রভাব পড়ে। এই বাহিনীতে গত সাড়ে চার বছরে দফায় দফায় নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে। ঘটেছে পাইকারি হারে পদোন্নতি, পদায়ন, রদবদলের ঘটনা। বাদ পড়েনি চাকরিচ্যুতসহ ওএসডি করার প্রক্রিয়াও।

পুলিশ বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করতে সরকার তার ছক অনুযায়ী তাদেরকে সাজিয়েছে। ফলে সাজানোর বাইরে ছিটকে পড়েছেন ভিন্ন মতাবলম্বীরা। অনেকেই হয়েছেন বঞ্চিত। এক পর্যায়ে সুবিধাভোগীরা প্রভাব এমনভাবে বিস্তার করে যে গোটা পুলিশ বাহিনীই সরকারের পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত হয়ে দমন-পীড়নে নেমে আসে। সে অববস্থা এখনও বিদ্যমান। সরকার তার ইচ্ছেমতোই পুলিশকে সাজিয়েছে। তাদের আগামী নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে। এ জন্য দফায় দফায় পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত ১২ জুন একযোগে ২৯৬ জন সাব ইন্সপেক্টরকে (এসআই) ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। একযোগে এত সংখ্যক পদোন্নতি পুলিশ বাহিনীতে বিরল ঘটনা বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি।

তাদেরকে পদোন্নতির পর পছন্দের স্থানগুলোতে পদায়ন করা হয়েছে। এর আগে ২২ এপ্রিল উচ্চ পর্যায়ে ৬৯ পদে রদবদল করা হয়। এই রদবদলের আওতায় ছিলেন একজন ডিআইজসহ এসপি পর্যায়ের কর্মকর্তা। তার আগে ৩১ জানুয়ারি ১৩১ জন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি)-কে পদোন্নতি দিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এডিশনাল এসপি) করা হয়। তাদেরকে দফায় দফায় পদায়ন করা হয়। এই পদোন্নতির আদেশে রাষ্ট্রপতির সম্মতি জ্ঞাপন ঘটে ১০ জানুয়ারি। এর আগে ১২ জন এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে এডিশনাল ডিআইজি পদে পদোন্নতিসহ ৬০ জনকে বদলি করে পদায়ন করা হয়। তাদের মধ্যে ডিআইজির চলতি দায়িত্বও পেয়েছেন পছন্দের অনেকে। একই দিন আরও ১২ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পদে রদবদলের ঘটনাও ঘটে। এর আগে গত বছরের ১ নবেম্বর ৬ জন ডিআইজিসহ ৫১ জন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পদে রদবদল করা হয়।

পুলিশ বাহিনীতে গত চার বছরে চারজন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তবে কাউকেই বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়নি। আর বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে ২০ জনকে। বর্তমানে ওএসডি আছেন ১১ জন। এদিকে বিএনপির আমলে বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া পুলিশের ১৬ কর্মকর্তা এই সরকারের সময় আদালতের আদেশে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়ে মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হয়েছেন।

পুলিশ সদরদফতর সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের আমলে চাকরিচ্যুত চার কর্মকর্তা হলেন উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) খান সাঈদ হাসান ও ফারুক আহমেদ, পুলিশ সুপার কোহিনুর মিয়া ও সহকারী পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিন। খান সাঈদ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামী। গিয়াস উদ্দিন বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। কোহিনুর মিয়া ও ফারুক আহমেদ হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।

পুলিশ সদরদফতর থেকে পাওয়া তালিকায় দেখা গেছে, বর্তমানে ওএসডি থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে অতিরিক্ত আইজিপি এ কে এম মাহফুজুল হক, ডিআইজি মাজেদুল হক, অতিরিক্ত ডিআইজি আকবর আলী, পুলিশ সুপার ওবায়দুর রহমান খান উল্লেখযোগ্য। মাহফুজুল হক আওয়ামী লীগের নেতা এ এস এম কিবরিয়া হত্যা সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন। ওই কমিটির প্রতিবেদনে ঘটনাটি ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ ছিল। সর্বশেষ ওএসডি হন এআইজি জহিরুল হক ভূঁইয়া ও রখফার সুলতানা খানম। জাতীয় সংসদের অপরাধ-সংক্রান্ত তথ্য দেয়ার ঘটনা নিয়ে তাদের ওএসডি করা হয় বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।

এছাড়া সাবেক আইজিপি খোদা বখস চৌধুরী, অতিরিকক্ত আইজিপি বজলুর রহমান, মিজানুর রহমান ও ডিআইজি আনিসুর রহমান ওসেডি থাকা অবস্থায় স্বাভাবিক অবসরে যান।

এ ছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজির আহমদ এবং সিআইডির উপ-মহাপুলিশ অতিরিক্ত মহাপুলিশের চলতি দায়িত্বে নিয়োজিত মোখলেসুর রহমানকে অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দেয়ার সুপারিশ করার কথা রয়েছে চলতি সপ্তাহেই। তারাও শেষ মুহূর্তের পদোন্নতির সুযোগ পাচ্ছেন।

পুলিশের বাইরে রয়েছে বিজিবি ও আনসার। র‌্যাব স্বতন্ত্র ইউনিট হলেও পুলিশের কমান্ডেই তাদের কর্মপরিকল্পনা ও পরিচালনা। এ ছাড়া বিভিন্ন বাহিনী থেকে আসা প্রেষণের কর্মকর্তা ও সদস্যরা র‌্যাবে অন্তর্ভুক্ত। তাদেরকে তাদের মাদার ইউনিটও বিশেষ নির্দেশ না দিয়ে নির্বাচনকালীন সময়ে পরিচালনা করতে পারে।

সীমান্তের অতন্ত্র প্রহরী বিডিআরকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার জন্যই ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। এরপর বিডিআরের কোমর ভেঙ্গে পড়ে পরিণতি লাভ করে বিজিবিতে। বিদ্রোহের ঘটনায় জড়িত এমন অভিযোগের মাধ্যমে মামলা ও বিভাগীয় শাস্তির মুখে পড়ে প্রায় ৭ হাজার বিডিআর জওয়ান চাকরিচ্যুত হয়। তাদের অনেকেই কারাগারে। তাদের শূন্যতা পূরণে দফায় দফায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে দলীয়রা প্রাধান্য পেয়েছে। তাছাড়া কয়েক দফায় রদবদল করে বিজিবিকে সাজানো হয়েছে। নির্বাচনে বিজিবিকে ব্যবহার করার জন্য। আগামী নির্বাচনে তাদেরকে ব্যবহারের সুযোগ ইতোমধ্যে হাতিয়ে নিয়েছে সরকার।

এ ছাড়া বিজিবির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়ন করা হয় সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণের মাধ্যমে। সেনাবাহিনীকেও একটি চেইনের মধ্যে রেখেছে সরকার। তাই আগামী নির্বাচনের সময় বিজিবিতে রদবদল ঘটলেও সেনাবাহিনীর গঠিত চেইনের বাহির থেকে কোন কর্মকর্তাই পদায়নের সুযোগ পাবেন না।

বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়েছে বাছাই করেই। তাছাড়া এ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়ন করা হয় সেনাবাহিনী থেকেই। তাদের কমান্ডেই বাহিনীটি পরিচালিত হয়ে থাকে।

বিচার বিভাগ

সরকারের শেষ সময়ে এসে বিচার বিভাগে কর্মরতদের জন্য ঈর্ষণীয় হারে বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই জুডিশিয়াল সার্ভিস বেতন কাঠামো ঘোষণা করে সরকার। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে অন্যান্য পেশার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হারে বিচারকদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়। এতে করে আগামী নির্বাচনে তাদেরকে হাতে রাখার মোক্ষম সুযোগ নিয়েছে সরকার। নির্বাচনকালীন সময়ে বিচার বিভাগেরও যথেষ্ট প্রভাব থাকে। তারা বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায়।

জুডিশিয়াল সার্ভিসের বেতন-ভাতা বাড়ানোর আগে দু’শতাধিক যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ ও সিনিয়র সহকারী জজকে পদোন্নতি দেয়া হয়। এর আগে ১৪১ জন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে পদোন্নতি দিয়ে বানানো হয় সিনিয়র সহকারী জজ।

বিচার বিভাগের এহেন পদোন্নতি, বেতন-ভাতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে অস্বাভাবিক হিসেবে অভিহিত করেছে পর্যবেক্ষক মহল। সরকারের দাবি এসবই রুটিন ওয়ার্কের অংশ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ