বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

পিছু হটলেন অর্থমন্ত্রী

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির পেশ করা রিপোর্ট প্রকাশের অঙ্গিকার থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন অর্থমন্ত্রী। দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, কয়েক দফায় তারিখ পেছানোর পর সর্বশেষ গত ১৮ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছিলেন, ২১ সেপ্টেম্বর বুধবার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। কিন্তু বুধবারই কথা ঘুরিয়ে ফেলেছেন জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার নিজের স্টাইলে বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ‘ইট উইল বি পাবলিশড, বাট দেরি হবে।’ শুধু তা-ই নয়, মন্ত্রী আরো বলেছেন, ‘বেশ দেরি হবে।’ 

যথারীতি কিছু কারণেরও উল্লেখ করেছেন তিনি। বলেছেন, ফিলিপাইনের আদালতে দায়ের করা মামলার রায় যেহেতু বাংলাদেশের অনুকূলে আসছে এবং লুণ্ঠিত টাকাও যেহেতু ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে সেহেতু রিজার্ভ চুরি সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা এখন অপ্রয়োজনীয়। প্রকাশ না করার অনুরোধ তাকে নাকি অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছেন। তার কথার ভিত্তিতে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আগে টাকা ফেরৎ আসুক। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্টও নাকি টাকা ফেরৎ দেয়ার ব্যাপারে তৎপর রয়েছেন এবং এই টাকা দেয়ার আগে প্রেসিডেন্ট নাকি লজ্জায় বাংলাদেশ সফরে আসতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, টাকার একটি বড় অংশ দেশটির ক্যাসিনোতে অর্থাৎ জুয়ার আখড়ায় ঢুকে পড়ায় ফেরৎ আনতে দেরি হচ্ছে। আইনমন্ত্রীর বিদেশে অবস্থানকেও একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। সারকথায় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট সহসা প্রকাশিত হচ্ছে না। কবে নাগাদ হবে কিংবা আদৌ কোনোদিন হবে কি না সে প্রশ্নের উত্তরও সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে গেছেন তিনি। শুধু বলেছেন, ‘দেরি হবে, বেশ দেরি হবে!’

প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করা দরকার, ডেসটিনি ও হল-মার্ক কেলেংকারির পরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাকিং-এর মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা চুরি হয়ে যায়। বিষয়টি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জানাজানি হলেও এ ব্যাপারে সরকারকে তো বটেই, অর্থমন্ত্রীকেও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এই সুযোগে আওয়ামী ঘরানার লোক বলে পরিচিত হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেই পার পেয়ে গেছেন সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। ইশারা-ইঙ্গিতে ব্যঙ্গ করা ছাড়া তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেননি অর্থমন্ত্রী। তাকে আজ পর্যন্তও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়নি। অথচ অনুসন্ধানে জানা গেছে, সবই জানা ছিল ওই গভর্নরের। প্রধানমন্ত্রীও জেনেছিলেন যথাসময়েই। কিন্তু তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। 

ফলে ওই আওয়ামী গভর্নর একা নন, তার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাও পার পেয়ে গেছেন। তারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এমন এক অবস্থার মধ্যে তীব্র নিন্দা-সমালোচনা শুরু হলে ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। প্রথমে ২০ এপ্রিল অর্থমন্ত্রীর কাছে অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট জমা দেয়ার পর ৩০ মে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কার বরাবরে ভুয়া পেমেন্ট ইনস্ট্রাকশন পাঠানো হয়েছিল এবং কে বা কারা তা পাঠিয়েছিল, টাকা পরিশোধের অবৈধ এ নির্দেশ ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা গভর্নর আতিউর বা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছিল কি না এবং রিজার্ভ চুরির এতো বড় একটি কেলেংকারি এক মাসের বেশি সময় কেন গোপন রেখেছিলেন গভর্নর- এ ধরনের অনেক বিষয়ই উঠে এসেছে চূড়ান্ত রিপোর্টে। তদন্ত কমিটির প্রধান ফরাসউদ্দিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, এই চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো পর্যায়ের কোনো একজন বা কয়েকজন কর্মকর্তার সম্ভবত কোনো যোগসাজশ ছিল না। কিন্তু সে অবস্থান থেকে কমিটিকে সরে আসতে হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যেও কয়েকজন রিজার্ভ চুরির অপরাধে জড়িত ছিলেন। ফলে ধরে নেয়া যায়, রিপোর্টে তাদের নাম-পরিচয় যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশও। কথা শুধু এটুকুই নয়। জড়িতদের মধ্যে ক্ষমতাসীন অনেকের নাম এবং সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কেও তথ্য থাকা অস্বাভাবিক নয়। 

ধারণা করা হচ্ছে, মূলত সে কারণেই অর্থমন্ত্রী আগে থাকতে ঘোষণা দিয়েও একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে রিপোর্ট প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বসেছেন। এমন মন্তব্যের কারণ, অর্থমন্ত্রী প্রথমবারের মতো মুখ খুলেছিলেন রিজার্ভ চুরির ঘটনা জানাজানি হওয়ারও দুই সপ্তাহ পর। সেবার বিষয়টিকে তিনি পুকুর চুরি নয়, সাগর চুরি বলে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এটা গত জুন মাসের ঘটনা। এরপর তিন মাসের মাথায় এসে অর্থমন্ত্রী সম্পূর্ণ উল্টো অবস্থান নিয়েছেন। একই কারণে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শেয়ার বাজার কেলেংকারির কথা ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। কারণ, শেয়ার বাজারের লাখ লাখ ক্ষুদ্র ও সাধারণ বিনিয়োগকারীকে ‘ধান্দাবাজ’ ও ‘কিছু লোক’ বলে তামাশা করার মাধ্যমে হৈচৈ তোলার পাশাপাশি এ অর্থমন্ত্রীই কেলেঙ্কারির খলনায়কদের নামগুলো রিপোর্ট থেকে ‘ডিলিট’ করতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, জড়িতদের নাম প্রকাশ করা হলে সরকার ‘বেকায়দায়’ পড়তে পারে। এ থেকে তখন বুঝতে বাকি থাকেনি যে, শেয়ারবাজার আসলে কারা লুণ্ঠন করেছিল। আঙুল শুধু সরকারের দিকে ওঠেনি, ক্ষমতাসীনদের অনেকের নামও মুখে মুখে আলোচিত হয়েছিল। 

এ অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই রিজার্ভ চুরির ঘটনায়ও সরকারের মধ্যকার এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে জড়িত অনেকের দিকেই আঙুল উঠতে শুরু করেছে। এটাই স্বাভাবিক। আমরা তাই মনে করি, অর্থমন্ত্রীর তথা সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে তদন্ত কমিটির পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ করা এবং দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা। বলা দরকার, যেহেতু ফিলিপাইনের সরকার টাকা ফিরিয়ে দেয়ার অঙ্গিকার করেছে এবং যেহেতু টাকা ফেরৎ আসতেও শুরু করেছে বলে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, সেহেতু রিপোর্ট কোনো প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠার কথা নয়। এর মধ্য দিয়ে বরং ভবিষ্যৎ চুরি ও জালিয়াতি প্রতিহত করা সম্ভব হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ