বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ৭০ বছর

নূরুল আনাম (মিঠু) : ১৯৪৬ সনটি উপমহাদেশীয় ইতিহাসে নানাবিধ কারণেই স্মরণীয়। এই বছরেই এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছিল। বোম্বের নৌসেনা বিদ্রোহ, ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা, মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কর্মসূচি ও তৎজনিত প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট দাঙ্গা- এই চারটি ঘটনা উপমহাদেশীয় ইতিহাসে প্রথম সারিতে স্থান পাওয়ার যোগ্য। এর সূত্রপাত অবশ্য হয়েছিল ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা থেকেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর উপরোক্ত বছরের ২৪ মার্চ তারিখে বৃটিশ ক্যাবিনেটের তিনজন সদস্য স্টাফোর্ড ক্রিপস, পেথিক লরেন্স ও এম.ভি. আলেকজান্ডার উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য এই অঞ্চলে আগমন করেন। এই মিশনের নেতৃত্ব দেন স্টাফোর্ড ক্রিপস। এটাই ইতিহাসে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা নামে পরিচিত। এখানে আসার পর মিশনের সদস্যরা উপমহাদেশের সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় করেন। অবশেষে তারা ১৬ই মে তারিখে তাদের পরিকল্পনা পেশ করেন। যা ‘ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা’ নামে ইতিহাস বিখ্যাত। এর মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান সবারই জানা আছে। এর কিছুদিন পরেই মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন বসল দিল্লীতে। বহু তর্ক-বিতর্কের পর জিন্নাহ সাহেব তাদের বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, ৫টি মুসলিম প্রধান প্রদেশের বাধ্যতামূলক অন্তর্ভুক্তির মধ্যদিয়ে পাকিস্তানের ভিত্তি রচিত হয়েছে যা কালক্রমে মুসলমানদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনে সাহায্য করবে। বাস্তবিকই শেষবারের মত পরোক্ষভাবে হলেও পাকিস্তান দাবির যৌক্তিকতা মেনে নিল। গ্রুপ ব্যবস্থা, তিনটির মধ্যে দুটিতেই আবার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং সর্বোপরি পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও ১০ বছর পর সংবিধান পুনর্বিবেচনার মধ্যদিয়ে এই প্রথমবারের মত সরকারি পর্যায়ে পরোক্ষভাবে হলেও পাকিস্তানের সুর ধ্বনিত হলো। আর তাই জিন্নাহ ঘোষণা করলেন, ‘মিশন প্লান গ্রহণ করার অর্থই হলো পাকিস্তানের পথে অর্ধেক অগ্রসর হওয়া’ এবং তিনি কংগ্রেস ও বৃটিশ সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘ভারতকে স্বাধীন করার একমাত্র পথ হচ্ছে যথাশীঘ্র সম্ভব পাকিস্তান স্বীকার করে নেয়া।’ তিনি বরাবরের ন্যায় অঙ্গুলি চালনা করে বললেন, ‘হয় তোমরা স্বীকৃত হও নচেৎ তোমাদেরকে বাদ দিয়েই আমরা পাকিস্তান লাভ করব।’ কিন্তু ১৯৩৭ সনের মত এবারও কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহেরু ঘাড় ত্যাড়ামি করলেন। তিনি এই পরিকল্পনা গ্রহণকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করলেন, ‘তিনি ও কংগ্রেস এই পরিকল্পনাকে গ্রহণ করছেন। এই অর্থে যে তারা গণপরিষদে যোগ দিচ্ছেন মাত্র কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গণপরিষদ সম্পূর্ণ স্বাধীন।’ ১০ই জুলাই তারিখে তিনি উদ্ধত ভাষায় ঘোষণা দিলেন, ‘ভারতীয় ইউনিয়ন যখন গঠিত হবে তখন গ্রুপিং বলে কিছু থাকবে না।’ এভাবেই একটি ভাল প্রয়াসের অপমৃত্যু হলো। তথাকথিত অখণ্ড ভারতের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকা হলো। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা মওলানা আবুল কালাম বলেন, ‘জওহরলালের ১৯৩৭ সনের ভুলের পরিণতি হয়েছিল মারাত্মক। তার ৪৬ সনের ভুল অধিকতর মারাত্মক বলে প্রমাণিত হলো।’ শুধু তাই নয়, তার চেয়েও মারাত্মক হলো প্রদেশগুলো সম্পর্কে তার মন্তব্য। সেখানেও তিনি শিথিল কেন্দ্র ও শক্তিমান প্রদেশের যে সুপারিশ ক্যাবিনেট মিশন করেছিলেন, তিনি তার বিপরীতটা করবেন বলে জানালেন। শিথিল কেন্দ্র ও শক্তিমান প্রদেশের সুপারিশ ক্যাবিনেট মিশন করেছিল এই জন্য যে, যেসব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেইসব প্রদেশের শাসন ব্যবস্থার সিংহভাগ তাদের হাতে থাকবে। আর এই কারণেই জিন্নাহ ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন। জিন্নাহ ভেবেছিলেন যে, এই শ্রেণী বিভাগ অনুসৃত হলে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মুসলিম লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে এবং উত্তর-পূর্বেও কংগ্রেস ও লীগের একটি শক্তিমত্তা থাকবে। কিন্তু নেহেরু তার সাংবাদিক সম্মেলনে এই ধারণার গোড়ায় কোপ মেরে দিলেন।
প্রদেশগুলোর এ রকম শ্রেণী বিভাগ তিনি মানতে অস্বীকার করলেন। নেহেরুর জীবনীকার মাইকেল ব্রেচার নেহেরুর এই বক্তব্যকে তার চল্লিশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বেশি প্ররোচণাপূর্ণ বলেছেন। অতঃপর জিন্নাহ বললেন যে, ‘লীগ ও কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনা করবে বলে। এখন কংগ্রেস সভাপতি বলছেন যে, গণপরিষদে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এই পরিকল্পনা বাতিল করবেন। যার অর্থই হলো সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগরিষ্ঠের দয়ার উপর ছেড়ে দেয়া।’ নেহেরুর এই বিতর্কিত বক্তব্যের ফলে যে ক্ষতি হলো সেটা পূরণ করার জন্য বৃটিশ পার্লামেন্টে ১৮ই জুলাই ক্রিপস জানালেন যে, বৃটিশ সরকার ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনঢ় থাকবে। কিন্তু জিন্নাহ এতে টললেন না। তিনি বললেন, ‘নেহেরুর কথাই কংগ্রেসের আসল মতলব ফাঁস করে দিয়েছে।’ আর এর ফলে যে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটল তাতে উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক দৃশ্যপট আমূল বদলে গেল। লীগ নেতৃবৃন্দ এর ফলে ওয়ার্কিং এক জরুরি সভা আহ্বান করতে বাধ্য হলেন। ২৯ জুলাই দিল্লীতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির এই জরুরি সভাতেই প্রথমবারের মত দেখা গেল একটি ভিন্ন মুসলিম লীগ ও ভিন্ন রকম জিন্নাহকে। দীর্ঘ দুই দশকের অচলাবস্থার অবসানের বার্তা ঘোষিত হলো এই সভায়। হিন্দু-মুসলমান ঐক্য তো এর দুই যুগ আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। ১৯২৬-এর পর থেকে হিন্দু-মুসলিম অন্ততঃ তাত্ত্বিকভাবে চিরকালের মত পৃথক হয়ে গেল। ১৯৩৭-এর নির্বাচনকে ঘিরে কংগ্রেসী অনমনীয়তায় মুসলিম স্বাতন্ত্র্য আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। আর ৪৬ এর মাঝামাঝিতে এসে দেখা গেল এরই চূড়ান্ত রূপায়ন। অনেকটা  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞান শিক্ষার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক ক্লাসের মতই। দীর্ঘ দুই দশক ধরে যা তাত্ত্বিক পর্যায়ে সীমিত ছিল ৩৭ এর কালে যা অনেকটা ব্যাবহারিক পর্যায়ে চলে এসেছিল এবার সেটাই চূড়ান্ত ব্যবহারিক রূপ পেল।
৩৭ এর পর থেকেই জিন্নাহ আর কংগ্রেসের কাছে নত হননি। মুসলিম লীগ ও তার তিন দশকের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে জেগে উঠল। অন্যদিকে তন্দ্রার ঘোর কাটিয়ে গোটা উপমহাদেশের মুসলমানরাও জেগে উঠতে শুরু করল। এমনি এক যুগ সন্ধিক্ষণে উপমহাদেশীয় মুসলমানদের তৎকালীন অবিসংবাদিত নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দীপ্তকন্ঠে ঘোষণা করলেন, “এতকাল কংগ্রেস দাবি করে এসেছে উপমহাদেশে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান আছে, বৃটিশ সরকার ও কংগ্রেস। কিন্তু এবার তার সাথে একটি তৃতীয় প্রতিষ্ঠান যুক্ত হল। আর তাহল মুসলিম লীগ।
আগের দুই প্রতিষ্ঠানের এক পক্ষের হাতে ছিল শাসন আর কর্তৃত্ব আর অন্যপক্ষের হাতে ছিল নিয়মতান্ত্রিকতাও আন্দোলন। এবার আমাদের হাতেও একটি পিস্তল এসেছে, এবার আমরাও এর সদ্ব্যবহার করব। এতোকাল মুসলিম লীগ যে নিয়মতান্ত্রিক ধারা অনুসরণ করে এসেছে তাও এখন থেকে বর্জিত হল।  এই বক্তব্যের মধ্যে বৃটিশ বিরোধী মনোভাবও সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। এখানে উল্লেখ্য যে ইতিপূর্বে কেন্দ্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেল তার মুসলিম লীগকে দেয়া পূর্ব প্রতিশ্রুতির খেলাপ করেছিলেন। আর এ সবেরই প্রতিবাদে সেদিনই ঘোষিত হল “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বা ডাইরেক্ট অ্যাকশন” কর্মসূচি। আর এর  তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল ১৬ই আগস্ট।
আর এটাই ছিল প্রতিপক্ষ নেহেরুর জীবনে সবচাইতে বড় বিস্ময়। মাইকেল ব্রেচারসহ নেহেরুর অনেক জীবনীকারও সুহৃদ স্বীকার করেছেন যে নেহেরু দু’দুবার জিন্নাহকে আন্ডার এস্টিমেট করেছিলেন। যা কিনা স্বয়ং নেহেরুও বিভিন্ন সময়ে স্বীকার করেছেন। প্রথমবার তিনি জিন্নাহকে আন্ডার এস্টিমেট করেছিলেন ১৯৩৭ সনের নির্বাচনে মুসলিম লীগের সাথে সমঝোতা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। প্রথমবার ভেবেছিলেন জিন্নাহ নিতান্তই চেয়ার টেবিল ও দর-কষাকষির নেতা। আর ৪৬ সনে দ্বিতীয়বার এই ভেবে আ-ার এস্টিমেট করলেন যে, নিতান্তই মুসলিম জনমত অনুকূলে থাকায় তিনি মুসলিম আসনগুলোতে জয়লাভ করেছেন। কিন্তু তার পক্ষে কখনই গণ-আন্দোলন করা সম্ভব হবে না কেননা তখনও তার (নেহেরুর) বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে নিয়মতান্ত্রিক জিন্নাহ কখনই গণ-আন্দোলনের ডাক দিবেন না। তার এই অতি আত্মবিশ্বাসের পরিণতি তো সবারই জানা। আর ১৬ই আগস্ট তারিখে কলকাতায় সংঘটিত সেই বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত দাঙ্গা নিয়ে আজ অবধি আলোচনা-সমালোচনার অন্ত নেই। অবশ্য এই দিন সমগ্র উপমহাদেশে হরতাল আহ্বান করেছিল মুসলিম লীগ। সকল প্রদেশে সবরকম ব্যবসায়িক কার্যকলাপ বন্ধ রাখা ও সর্বাত্মক হরতাল পালনের জন্য লীগের নেতা-কর্মী ও মুসলিম জনগণের প্রতি এক নির্দেশ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু শুধু কলকাতায় সংঘটিত দাঙ্গা নিয়ে আজ অবধি বিতর্কের অন্ত নেই। তবে সামগ্রিক বিচারে বলা যায় কলকাতা ছিল তৎকালীন বৃটিশ ভারতের বৃহত্তম শহর। শুধু কি তাই? ১৯১১ সন এটাই ছিল আফ্রো-এশিয়ার বৃটিশ সাম্রাজ্যের কেন্দ্র অর্থাৎ ওই সময় পর্যন্ত এটা শুধু যে বৃটিশ ভারতের রাজধানী নয় সেই সাথে উপমহাদেশ বহির্ভূত বার্মা, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, হংকং এমনকি অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড পর্য়ন্ত শাসন করা হয়েছিল এখান থেকেই। আর অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগ বিজয়ীই হয়নি তারা ১১৯টি মুসলিম আসনের মধ্যে ১১৩টিই লাভ করেছিল এবং মুসলিম লীগের এমনতর সাংগঠনিক অবস্থান আর কোন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে ছিল না। ফলশ্রুতিতে  কংগ্রেস ও উগ্রহিন্দু সংগঠনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল কলকাতা। এরই ফলশ্রুতি ছিল ১৬ই আগস্টের বহুল আলোচিত দাঙ্গা।
তবে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ফলাফলও নিয়ে এসেছিল। কেননা এর মাধ্যমেই মুসলিম লীগ কংগ্রেসের মতই রাজনৈতিক পরিপক্বতা অর্জনের পথে কিছুটা হলেও অগ্রসর হয়েছিল। যদিও সমকালীন নানাবিধ প্রতিকূলতার কারণে তা পুরোপুরি ফলবান হয়নি কিন্তু তার উত্তরসূরীরা বর্তমান বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রেই এর সূপল ভোগ করছেন। এতো গেল শুধু দলীয় প্রসঙ্গ। আগেই বলা হয়েছে যে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে পুরো উপমহাদেশীয় রাজনীতিতেই প্রত্যক্ষ ফলাফল নিয়ে এসেছিল। কেননা এর দ্বারাই তথাকথিত অখণ্ড ভারতের বিধিলিপি সম্পন্ন হয়েছিল। এর মাধ্যমেই তথাকথিত যুক্তবাংলার নিয়তিও নির্ধারিত হয়ে যায়। মুখোশ খসে পড়ে তথাকথিত বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের। চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়ে যায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ও তজ্জনিত বাংলা ভাগও।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ