শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

আশুলিয়ায় নিহত আব্দুর রহমানই নব্য জেএমবির আমির -র‌্যাব

  • তাবেলাসহ ১৮টি নাশকতায় জড়িত নব্য জেএমবি

স্টাফ রিপোর্টার : ঢাকার আশুলিয়ার গাজীরচট এলাকায় গত ৮ অক্টোবর র‌্যাপিড আ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) অভিযানের সময় পাঁচ তলা থেকে পড়ে নিহত আব্দুর রহমানই নব্য জেএমবি শীর্ষ নেতা শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ বলে দাবি করেছে র‌্যাব। গুলশানে ইতালিয় নাগরিক তাবেলা সিজারসহ ১৮টি নাশকতায় জড়িত এই নব্য জেএমবি। এ ছাড়াও এখনো মাঠে রয়েছে তাদের ২১ সদস্য। গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বিএসইসি ভবনে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিক সম্মেলনে মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ এ কথা জানান। 

র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, এই আব্দুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহানই ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কথিত বাংলাদেশ প্রধান শাইখ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ। এর আগে আইএসএর মুখপাত্র 'দাবিক' পত্রিকার এক প্রতিবেদনে আবু ইব্রাহিমকে আইএসের বাংলাদেশ প্রধান বলে উল্লেখ করেছিল। ওই জঙ্গি নেতার প্রকৃত নাম সারোয়ার জাহান। বেনজীর আহমেদ বলেন, ওই আবদুর রহমানই শায়খ আবু ইব্রাহীম আল হানিফ নামে নব্য জেএমবি গঠন করে আমিরের দায়িত্ব নেন। এর প্রমাণ হিসেবে নব্য জেএমবি কর্মকাণ্ড শুরুর একটি ঘোষণার অনুলিপি সাংবাদিক সম্মেলনে দেখানো হয়। র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, ওই ঘোষণায় আবু ইব্রাহীম আল হানিফের সঙ্গে শেখ আবু দুজুনা নামে আরেকজনের সই আছে। সেই আবু দুজুনা হলেন নারায়ণগঞ্জের অভিযানে নিহত তামিম চৌধুরী, যাকে এতো দিন নব্য জেএমবির প্রধান সমন্বয়ক বলা হচ্ছিল।

এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর মহাখালী ও মতিঝিল থেকে নাফিজ আহমেদ নয়ন ও হাসিবুল হাসান নামে দুইজনকে আটকের পর গতকাল সকালে এই সাংবাদিক সম্মেলনে আসেন র‌্যাব প্রধান বেনজীর। র‌্যাব সদর দফতরের সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, ওই দু’জনের কাছ থেকে ২৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। তারা দু’জনেই নব্য জেএমবির সদস্য এবং আব্দুর রহমান ওরফে আবু হানিফ ওরঠে ঘনিষ্ঠ সহযোগী, বলেন তিনি।

গত ৮ অক্টোবর ঢাকার আশুলিয়ার এক বাড়িতে র‌্যাবের অভিযানের সময় পাঁচতলা থেকে পড়ে একজনের মৃত্যু হয়। সে সময় র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয় নিহত ব্যক্তির নাম আব্দুর রহমান আয়নাল, তিনিই নব্য জেএমবির প্রধান অর্থ যোগানদাতা। ওই বাসা থেকে ৩০ লাখ টাকাও উদ্ধার করে র‌্যাব। নিহতের স্ত্রী মোসাম্মত শাহানাজ আক্তার রুমিকে (২৮) আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়; তাদের দুই শিশু সন্তানকে পাঠানো হয় সেইফ হোমে। 

সাংবাদিক সম্মেলনে বেনজীর বলেন, আশুলিয়ার ওই আস্তানায় ভুয়া ন্যাশনাল আইডি, পাসপোর্ট ও চাকরির আইডি কার্ডসহ বিভিন্ন কাগজপত্র পান তারা। সব মিলিয়ে জানা যায়, ওই ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে আসছিলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয়, কওমি মাদরাসায় ভর্তির পর থেকেই সারোয়ার জাহান জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৩ সালে চাঁপাইনবগঞ্জের ক্ষেতলালের এক বাড়িতে বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে শতাধিক লোক জড়ো হওয়ার খবরে পুলিশ সেখানে যায়। সে সময় বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জঙ্গিরা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে তিনটি অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় এবং গুলি করে গ্রেনেড ছুঁড়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ সেদিন ঘটনাস্থল থেকে ৩৩ জনকে আটক করে, যাদের মধ্যে এই সারোয়ার জাহানও ছিলেন বলে জানান বেনজীর আহমেদ। সেই এফআইআরের কপি সাংবাদিকদের দেখিয়ে তিনি বলেন, সারোয়ার ওই এফআইআরে সাত নম্বর আসামী ছিল। আমরা জানতে পেরেছি, ২০০৩ থেকে ২০১৬ এই ১৩ বছর সে জঙ্গি জীবন যাপন করে। সর্ববেশ আবু ইব্রাহিম নামে আমির হিসেবে নব্য জেএমবি গঠন করে।

আবদুর রহমানের একাধিক চিঠি, ই-মেইল ও এসএমএস পরীক্ষা করা হয়েছে জানিয়ে বেনজীর আহমেদ বলেন, নয়টি চিঠি গ্রহণ ও ১০টি চিঠি বিতরণ করেছেন তিনি। এসব চিঠিতে এই নব্য জেএমবি নেতা আবু ইব্রাহিম আল হানিফ নামে স্বাক্ষর করেছেন। নব্য জেএমবির নিহত সদস্যদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার কাজও করতেন আবদুর রহমান। 

তাবেলাসহ ১৮টি নাশকতায় জড়িত : আবদুর রহমান নব্য জেএমবির আর্থিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার পাশাপাশি বিভিন্ন হামলার পরিকল্পনা, সাংগঠনিক কাঠামো, অস্ত্র ও সামর্থ্য নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতেন। তার নির্দেশে নব্য জেএমবির সদস্যরা গুলশানে ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলাকে হত্যা, রংপুরে জাপানি নাগরিক কোনিও হোসিকে, রাজধানীর গাবতলীতে দারুস সালাম থানার সহকারী উপপরিদর্শক ইব্রাহিম মোল্লাকে হত্যা, দিনাজপুর শহরে খ্রিস্টান ধর্মযাজক ইতালির নাগরিক পিয়েরো পারোলারি সামিওকে হত্যাকরাসহ ১৮টি নাশকতার ঘটনায় জড়িত।

গত বছর পুরান ঢাকার হোসনি দালানে আশুরার তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা, নন্দনপার্কে শিল্প পুলিশ সদস্য মুকুল হোসেন হত্যা, বগুড়ার শিবগঞ্জে শিয়া মসজিদে হামলা, চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ইশা খাঁ নৌঘাঁটিতে বোমা বিস্ফোরণ, এ বছর পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে শ্রীশ্রী সন্ত গৌরীয় মঠে পুরোহিত যঞ্জেশ্বর দাসাধিকারীকে হত্যা, ২৫ মে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ব্যবসায়ী দেবেশচন্দ্র প্রামাণিক হত্যা, ৫ জুন নাটোরের বনপাড়ায় খ্রিষ্টানপল্লিতে সুনীল গোমেজ হত্যা, ৭ জুন ঝিনাইদহের মহিষডাঙ্গা গ্রামে পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলি হত্যা, পাবনার হেমায়েতপুরে খ্রিস্টান ধর্মযাজক নিত্যরঞ্জন পাণ্ড হত্যা, ১৫ জুন মাদারীপুরে কলেজশিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলা, ১ জুলাই ঝিনাইদহে সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস হত্যা, একই দিন গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা ও হত্যা, ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদগাহ মাঠে হামলার ঘটনা আবদুর রহমানের নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় ঘটেছে বলে সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয়। 

নব্য জেএমবির ২১ সদস্য এখনো মাঠে : জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির মাত্র ২১ জন সদস্য এখন মাঠে রয়েছেন বলে জানিয়েছে র‌্যাব। উদ্ধার করা হয়েছে আদের সব অস্ত্রই। সাংবাদিক সম্মেলনে বলা হয়, ৮ অক্টোবর র‌্যাবের অভিযানের সময় পাঁচতলা থেকে পড়ে নিহত ব্যক্তিই নব্য জেএমবির প্রধান ছিলেন। তখন সেখান থেকে পাওয়া পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্রের ভিত্তিতে র‌্যাব জানিয়েছিল তার নাম আবদুর রহমান। পরে তদন্তে জানা যায়, তার আসল নাম সারোয়ার জাহান, বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে। আর সাংগঠনিক নাম ‘শায়খ আবু ইব্রাহীম আল হানিফ’। এই নব্য জেএমবি যেসব হামলা ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তার সবগুলোরই দায় স্বীকার করেছে ইরাক-সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএস।

গত বছরের ২১ জুলাই নব্য জেএমবির আমির হিসেবে দায়িত্ব নেন সারোয়ার জাহান। এরপরে ২৬ জুলাই তাদের সাংগঠনিক এক প্রতিবেদনে নব্য আমির উল্লেখ করেন, তাদের ৩০০ জন সদস্য, ২০টি আধা স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র, নয়টি স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ও কিছু গ্রেনেড রয়েছে। এ প্রতিবেদনের আট মাস পর আরেক প্রতিবেদনে সারোয়ার জাহান উল্লেখ করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে তাদের ১৫ জন সদস্য নিহত ও ১৯ জন গ্রেফতার হয়েছেন। ছয়টি একে ২২ (একে টোয়েন্টিটু) রাইফেল ও একটি এম ১৬ (এম সিক্সটিন) রাইফেল র‌্যাব-পুলিশ জব্দ করেছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তাদের দু’জন কেমিস্ট ও একজন ইলেকট্রিশিয়ান রয়েছেন। এ ছাড়া একজন ইলেকট্রিশিয়ান গ্রেফতার হয়েছেন (কর্মকর্তারা বলছেন এসব কেমিস্ট ও ইলেকট্রিশিয়ান বোমা তৈরির কাজ করে থাকেন)। ওই সাংগঠনিক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আট মাসে তাদের সদস্য সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৬৬তে। অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে পাঁচটি একে ২২ রাইফেল, চারটি মোটরসাইকেল ও একটি মিনি ট্রাক।

বেনজীর আহমেদ বলেন, নিহত হওয়ার দুই দিন আগে সারোয়ার যে সাংগঠনিক প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন তাতে ৫টি একে ২২ রাইফেল, ৩৩ জন সদস্যের কথা বলা হয়। এই ৩৩ জনের মধ্যে ৮ অক্টোবর টাঙ্গাইল ও গাজীপুরে র‌্যাব ও পুলিশের চারটি পৃথক অভিযানে মোট ১২ জন নিহত হন। ওই সব অভিযানে জঙ্গিদের হিসাবের মধ্যে থাকা পাঁচটি একে ২২ রাইফেলই উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে তারা আর কোনো অস্ত্র কিনে না থাকলে ধরে নেওয়া যায় তাদের এখন কোনো অস্ত্র নেই। কিছু বোমা তৈরির সরঞ্জাম থাকতে পারে। আর ১২ জন নিহত হওয়ার পর এখন গ্রেফতার এড়িয়ে রয়েছেন আরও ২১ জন। অচিরেই এদের ধরে ফেলা যাবে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ২১ জনের মধ্যে তিনজন নীতিনির্ধারণী সদস্য। তাদের সাংগঠনিক নাম জানা গেছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ