শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

প্রহর গুণছি আল্লাহ্ কবে আমাকে তোমার সাথে মিলিত করবে

শাহিদা জামান : অক্টোবরের ১১ তারিখ হলেই এক বছর পূর্ণ হবে তোমার চলে যাওয়া। এত তাড়াতাড়ি চলে গেলে একটা বছর মনেই হয় না। মাগরিবের নামায পড়ে ঘরে আসবে বললে, কিন্তু তোমার আর ঘরে ফিরা হলো না। চলে গেলে আল্লাহ্র সান্নিধ্যে। এমন অকস্যাৎ  চলে গেলে যা আমরা কেউ মেনে নিতে পারছি না । কিন্ত যাওয়া সত্য, মৃত্যুকে মেনে নিতেই হবে। কখনও কখনও তোমার আসার পথ চেয়ে থাকি, ক্ষণিক পরে সত্যটা উপলদ্ধি করি। জানি দুনিয়ার জীবনে তোমার সাথে আর কখনো দেখা হবে না। তুমি তোমার আকাক্সিক্ষত মঞ্জিলে পৌঁছে গেছ। তোমার মৃত্যু অন্য আর পাঁচ জনের মতো নয়। আজ শুধুমাত্র কুরআনের কথা বলাই ও কুরআনের পথে আহ্বান করার কারণে তোমাকে জেলখানার কারাগারে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা চলে যেতে হলো।
এমন মৃত্যু প্রসঙ্গে-আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের ঘোষণা- ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তোমরা তাদের মৃত বলো না, কেননা তারা রিজক প্রাপ্ত, তোমরা বোঝ না, আমাদের সকলের দোয়া আলাহ যেন তোমাকে শাহাদাতের মর্যাদাই দান করেন। আল্লাহ্ অন্যত্র এরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের কোন অপরাধ নেই। অপরাধ শুধু তোমরা ঈমান এনেছো সেই আল্লাহ্র প্রতি যিনি তোমাদের প্রতিপালক ও সৃষ্টিকর্তা।
তোমার জানাযায় হাজারো মানুষের উপস্থিতি বলে দেয় তুমি ভাল  লোক ছিলে। শাহাদাতের খবর এলাকায় পৌঁছালে মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল তোমার  বাসস্থানে। সারা রাত মানুষের আনাগোনা চলে। কেউ ঘুমাতে যায়নি। এলাকার ছোট-বড় সবাই এক বাক্যে বলে-‘আহা মানুষটার কি অপরাধ ছিল’। কবরস্থানের কান্নার রোল পড়েছিল। লোকেরা বলাবলি করছিল কবরে রাখার সময় যারা পিছনে পড়েছিল তারা সামনে আর এক পাও আগাতে পারেনি।
এলাকায় তুমি ছিলে কারোর জামাই, কারোর রাজার ভাই, কারোর রাজার চাচা, খেটে খাওয়া মানুষেরাও তোমার কথা মনে করে এখনো কাঁদে। তুমি এলাকার সকলেরই কিছু না কিছু সমস্যার সমাধান ও আর্থিক সংকট উত্তরণে ভূমিকা রেখেছো। কারোর চাকরির সুপারিশ, দরখাস্ত পর্যন্তও লিখে দিয়েছো। অভাবি মানুষের পাশে থেকে কিভাবে অভাব দূর করা যায়, নিজে ছোটাছুটি করে সেই ব্যবস্থাও করেছো। এমনি অনেক কাজ করে গেছো যে তারা যতদিন বাঁচবে তোমার জন্য দোয়া করে যাবে। পথে বের হলে এ সব মানুষ হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে তোমার কথা বলে। তুমি মরেও অমর, তুমি বেচে আছো এই সব মানুষের হৃদয়ে, আমাদের হৃদয়ে।
তোমাকে যখন শেষ বারের মতো দেখাতে আনে (অর্থাৎ নাতনীকে ভাই বলে আমরা ডাকি)। কেঁদে কেঁদে বলেছিল ও ভাইয়া আমিও বাঁচতে চাই না তোমার সাথে যাবো। ঘরের দেয়ালে লিখেছে ভাইয়া তুমি কবে আসবে- আই লাভ ইউ।
আমরা দু’জনেই দ্বীনের দায়ী। তাই দ্বীনের কাজ করতে আমাদের কোন সমস্যা কখনও হয়নি। স্বামী হিসাবে কখন জীবনে কোন কড়া কথা বলেনি। পিতা হিসাবে সন্তানদের কখনো বোকা-ঝোকা করেনি। ত্ইা তোমার বড় ছেলে তোমাকে আনার জন্য হাসপাতালে গিয়েছিল। ও বললো  আম্মি  আব্বুকে যখন ফ্রিজ থেকে বের করলো তখন আব্বুর মুখ ডান দিকে কাত ছিল। আর শরীরটা ছিল নরম তুলতুলে। অনেক্ষণ পর্যন্ত আব্বুর বুকে মাথা রেখে কেঁদে ছিল,  ছোট ছেলে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। যাতে আমি দেখতে না পাই।
আমরা কেউ তোমার চলে যাওয়ার ক্ষণটিতে কাছে থাকতে পারলাম না। কুরআনের দুশমনেরা সে সুযোগ থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছে। শোকে মুহ্যমান হয়ে শুধু প্রহর গুনছি কবে দয়াময় আল্লাহু আমাকে তোমার সাথে মিলিত করবে।
সব সময় অল্পে তুষ্ট থাকতো। দুনিয়ার প্রতি বেশি আকর্ষণ ছিল না, তাইতো ব্যক্তিগত জীবনে ছিল সততার প্রতিক। কখনোও কারো কোন ক্ষতি তার দ্বারা হয়নি। মানুষের উপকারের জন্য বেশি সময় ব্যয় করতো। মাঝে মাঝে আমি খুব রাগ হতাম, অনেক সময় ঘরে বাজার থাকতো না, তাতে কি? ডাল আলু আছে তাই রান্না করো।
যেভাবে শাহাদাৎবরণ করলেন: সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখ,  আছর নামায বাদ আমাকে ফোন করে বললো বাসায় কখন আসবে,  একটু দেরি হবে বলায় বলল ঠিক আছে আমি মাগরিবের নামাজ পড়ে আসি। কিন্ত ফোন  পাওয়ার পরক্ষণে আমার ভেতরে একটা অস্থিরতা ভাব লাগতেছিল, তাই চা নাস্তা সামনে আনার পর আমি তা না খেয়েই বাসায়  চলে আসলাম,  অনাদেন বললাম আমি খাবো না,  আমার কেন যেন জানি ভাল লাগছে না।
মাগরিবের নামাজ পড়ে ওঠার সাথেই ফোন এলো রাজা ভাইসহ আরো দু’জন অ্যারেস্ট হয়েছে। তাদেরকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরদিন কোর্টে চালান দেয়া হলো। সেখানে সাক্ষাৎ করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিলাম, জামিন হলো না তারিখ পড়লো ১১  সেপ্টেম্বর।  ৩ তারিখ জেলাগেটে দেখা করলাম একমাত্র নাতনীকে নিয়ে। আগে কিছু  বলেনি। যাবার সময় বললাম ভাই চলো ভাইয়াকে দেখতে। কথায় দিদা জিজ্ঞাসা করায় বললাম অফিসে। যখন জানালার অপাস থেকে কথা বলল, তখনি বুঝতে পারলো এর আগে কারাগার লেখা দেখে বলেছিলো দিদা তুমি না বললে ভাইয়া অফিসে। বললাম এইতো তোমার ভাইয়ার অফিস। যখন ভাইয়াকে জানালার ওপাসে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, এবং নাতনীকে দেখে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলছিল ভাই কেমন আছো। তখন নাতনী খুব কাঁদছিল, লোকে কি ভাববে তাই জোরে না কেঁদে ফুঁফিয়ে কাঁদছিল আর বলেছিলো দিদা আমাকে বাসায় নিয়ে চলো আমি জোরে জোরে কাঁদবো। ওরা আবার আজকে ঢাকায় চলে যাবে। তাই গেটে রিকোয়েস্ট করে বলায় ওকে ভেতরে নিয়ে ওর ভাইয়ার সঙ্গে কোলাকুলির সুযোগ করে দিল। এটাই ওর ভাইয়ার সঙ্গে শেষ দেখা, ওরা দু’জন দু’জনে বুকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছিল । প্রাণ খুলে ঐ লোকটার জন্য দোয়া করে  আল্লাহ্ যেন ঐ সাক্ষাতের জন্য তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে অশেষ প্রতিদান দেন।
১১ই অক্টোবর কোর্টে হাজিরার দিন। সকালে রান্না করা কিছু খাবার নিয়ে কোর্টে পৌঁছালাম। পলিথিনে করে খাবার দিতে হল। আমার রান্না করা খাবার এটাই তার জীবনের শেষ খাবার। পলিথিনে হাত ঢুকিয়ে খাবার দৃশ্যটা আজ কাঁদায়।  সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষ গুলির এই অবস্থা। জামিন আবার না মঞ্জুর। দুপুর সাড়ে ১২ টায় নিয়ে গেল। দৈত্যের মত একটা গাড়ী পেছন দিকে দাঁড়াতে পারলাম না তাই ঘুরে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। গাড়ী যখন ছাড়লো হাত নেড়ে আমাকে বিদায় জানালো। গাড়ীর সামনে থেকে পেছন পর্যন্ত আসলো হাত নাড়তে নাড়তে সেদিন বুঝিনি এটা আমাকে শেষ বিদায় জানালো। বুঝিনি আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর চলে যাবে আল্লাহর সান্নিধ্য। আমরা ফিরে এলাম বাসায়। রাত ৭টায় দিকে এশার নামাজ পড়ার জন্য সবাই প্রস্তুত।  নামাযের আগে কারাগারে প্রতিদিন একেক জন একেক দিন কুরআনের আলোচনা করে। আজকে আরেক ভাইয়ের আলোচনা। কিন্ত রাজা ভাই বলল আজকের আলোচনা আমি করবো। উঠে কুরআন তিলাওয়াত  করলেন। অর্থ বলার সময় আর কথা বলতে পারল না। সবাই ভাবলেন, হয়তো ভুলে গেছে তাই মনে করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ করে সে বসে পড়ল। সবাই তখন ধরাধরি করে কারাগারের ভেতরের হাসপাতালে নিল। সেখান থেকে বলা হলো খুলনা মেডিকেলে নিতে হবে। রাত ৮ টা ৩০ মিনিট ফোন এলো এবং আমাকে বলা হলো আপনি দ্রুত খুলনা মেডিকেলে যান। উনি  অসুস্থ  হয়ে পড়েছেন। কাউকে না বলে আমি একা হাসপাতালে গেলাম। সবাইকে নিয়ে যেতে হলে দেরি হয়ে যাবে। আগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে সবাইকে জানাবো। হাসপাতালে পৌঁছিয়ে একবার দোতালা আমার নীচে এভাবে কয়েক বার ছোটাছুটি করে পেলাম প্রিজন সেল। গেটে যেতে নানান  প্রশ্ন এভাবেও কেটে গেল আরো মিনিট পাঁচেক, এর পর বলা হলো,  উনি নেই মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। আমি নির্বাক পাথর হয়ে গেলাম। লোহার গেটটা শক্ত করে ধরলাম। এভাবে কাটলো আরো কিছুক্ষণ কাটলো, ভেতরে প্রবেশ করলাম,  সামনে ওকে দেখে ধীর পায়ে ওর কাছে গিয়ে বসলাম। নিথর, নীরব দেহটায় হাত দিলাম। তখনও পর্যন্ত বুকটা গরম। চোখ ঝাপসা হৃদয় চৌচির কি করব। অবশেষে বৌ মাকে ফোন দিলাম, আর এক বোনকে ফোন দিয়ে আর কিছু বলতে পারছিলাম না। ওখানকার লোকেরা ফোন রিসিভ কর বলছিল। আমাদের অনেক অনুনয় বিনয় সত্ত্বেও পোস্টমর্টেম না করে লাশ দিল না। আমরা চাই এর উপর আর যন্ত্রণা না দেয়া হোক। কিন্ত আমাদের কোন আকুতি কানে তুলল না। এভাবে মৃত্যুর পরও তারা কেটে কুটে দিল।
আল্লাহ্ তায়ালার ইচ্ছা হলো তাকে শাহাদাতের মর্যাদায় ভূষিত করা। আরও শহীদদের রক্ত জমিনে ঝরানো প্রয়োজন এ রক্ত জমিনকে করে উর্বর। তাই আমাদের আকুতি সত্ত্বেও রক্ত ঝরার ব্যবস্থা করলেন। দেখা গেল গোসলের সময়ও ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরেছে। সারা পথ রক্ত পড়তে পড়তে এসেছে। সে রক্ত ছিল তরল।
আমরা জানি মৃত্যু সত্য। আল্লাহ্ বলেছেন-‘সব প্রাণীকে মরতে হবে। কিন্ত কোনো কোনো মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। তোমার চলে যাওয়াটা এমনি। আমরা দোয়া করি আল্লাহ্ মেহেরবানী করে তোমাকে তার নিয়ামত পূর্ণ স্থান দান করুক। আমাদের অশ্রুভেজা নয়ন, হৃদয় ফাটা আর্তনাদ তোমার বিরহের ভালোবাসার যতদিন সাক্ষাত না হবে অশ্রুর নদী বয়ে যাবে নীরবে।
পরিশেষে আল্লাহর কাছে আরাধনা-‘হে আল্লাহ্ আজকে আমরা যারা এ জুলুমের শিকার, তাদের সবাইকে শক্তি ও সাহস যোগাও, দাও ধৈর্য্য ও সবর। যুলুমের হাত থেকে তুমি তোমার ঈমানদার বান্দাদের হেফাজত করো। আমিন॥
(লেখিকা-শহীদ মিয়া আকরামুজ্জামান রাজার স্ত্রী)

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ