নব্য জেএমবির প্রধান হিসেবে সারোয়ার জাহানকে নিয়ে র্যাবের বক্তব্য নাকচ করে দিল পুলিশ
স্টাফ রিপোর্টার : সম্প্রতি র্যাবের অভিযানে নিহত সারোয়ার জাহানকে কথিত জঙ্গি সংগঠন 'নব্য জেএমবি'র প্রধান বলে পুলিশের এই বিশেষ বাহিনী দাবি করলেও গতকাল বুধবার তা নাকচ করে দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম র্যাবের পক্ষ থেকে করা দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেন, নিহত সারোয়ার জাহান জঙ্গি সংগঠনটিতে ততটা গুরুত্বপূর্ণ কোনও নেতা ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন তৃতীয় সারির একজন নেতা।
র্যাব সম্প্রতি আশুলিয়ায় নিহত সারোয়ার জাহানকে 'নব্য জেএমবির' প্রধান বলে দাবি করে। কিন্তু ঢাকা মহানগর পুলিশ বা ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, "তার নাম আমাদের কাছে এসেছে তামিমের ইমিডিয়েট পরের নেতা হিসেবে"। এরপর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সারওয়ার জাহানকে তৃতীয় সারির নেতা বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
র্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ বলেছিলেন, কথিত সংগঠন নব্য জেএমবির প্রধান সারোয়ার জাহানের নেতৃত্বে ইতালির চেজারে তাবেলা হত্যাকান্ড ঘটানো হয়।
র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ যে বক্তব্য দিয়েছেন সে প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নে মনিরুল ইসলাম বলেন, "আমি সাক্ষাৎকার শুনিনি। আমার ধারণা উনি এটা বলেননি। বিচারাধীন কোনও বিষয়ে কোন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এমন মন্তব্য করেত পারেন না"।
গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মহাপরিচালক দাবি করেন, ইতালির নাগরিক চেজারে তাবেলা হত্যাকান্ডে 'নব্য জেএমবি' জড়িত। সারোয়ার জাহানের নেতৃত্বে হামলার শিকার হয়েছিলেন তাবেলা।
র্যাবের পক্ষ থেকে এও বলা হয়েছিল যে সারোয়ার জাহান নামের এই ব্যক্তি শায়খ আব ইব্রাহিম আল-হানিফ নামেও পরিচিত ছিলেন। আর মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট শায়খ আব ইব্রাহিম আল-হানিফকে বাংলাদেশে তাদের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে দাবি করেছিল।
অন্যদিকে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ বলছে, তাবেলা হত্যাকান্ডে বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ুম জড়িত। তাঁকে অভিযুক্ত করে পুলিশ চার্জশিটও দেয় এবং মঙ্গলবার ঢাকার একটি আদালত এ ব্যাপারে অভিযোগ গঠন করে।
র্যাব ও পুলিশের এই তথ্যের পার্থক্যের ব্যাপারে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, চেজারে তাবেলা হত্যার অভিযোগপত্র তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে। এখানে মন্তব্য করার কোনও সুযোগ নেই। ডিবি বা গোয়েন্দা বিভাগের মামলার তদন্ত কাজ সম্পাদন হয় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। এটি কোনও রচনা কর্ম নয় বা ক্রিয়েটিভ হওয়ার কোন সুযোগ নেই"।
গুলশানে ইতালিয়ান নাগরিক তাবেলা হত্যার তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন , ‘তদন্ত সংস্থা ফৌজদারি কার্যবিধির সব নিয়ম কানুন মেনেই তদন্ত করেছে। এখানে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। সেটা এখন আর গ্রহণ যোগ্য করে।’তিনি বলেন, ‘তাবেলা হত্যা মামলা একটি বিচারাধীন মামলা। এ নিয়ে মন্তব্য করার কোনও সুযোগ নেই। আপনারা জানেন যে, গোয়েন্দা বিভাগ একটি পরীক্ষিত গোয়েন্দা সংস্থা। এটা প্রতি মাসে দুই একটি মামলার রহস্য উন্মোচন করছে। এগুলোর বিচার এবং সাজা হচ্ছে। ডিবির মামলার তদন্তের মান অনেক ভালো।’
সিটিটিসি প্রধান আরও বলেন, ‘ফৌজদারি তদন্ত আসলে পরিচালিত করা হয় সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে। এখানে রচনা বা ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ক করার সুযোগ নেই। তথ্য-প্রমাণ বা সাক্ষ্য প্রমাণে যা আছে সেটি করা হয়। এক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির সব নিয়ম মেনেই তদন্ত কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে একদল পেশাদার অফিসার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সাহায্য করে তদন্ত সম্পন্ন করছে। যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার কাজও শুরু হয়েছে। কাজেই এ ঘটনায় যাদের সম্পৃক্ততা আমরা পেয়েছি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।’
বিএনপি নেতা কাইয়ুমের অবস্থান সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তিনি দেশের বাইরে থাকায় তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। দেশে আসলেই তাকে গ্রেফতার করা হবে।’
তাবেলা হত্যায় নব্য জেএমবি জড়িত-র্যাবের এমন দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যখন এ কথা বলা হয়েছে তখন আমি দেশের বাইরে ছিলাম। আমি সাক্ষাৎকারটি শুনিনি। আমি মনে করি উনি (বেনজীর আহমেদ) একথা বলেননি। প্রশাসনের দায়িত্বশীল কোনও ব্যক্তি এমন মন্তব্য করতে পারেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। ’
শুক্রবার ওই সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, নারায়ণগঞ্জে তামিম চৌধুরীকে যখন ঘিরে ফেলা হয়, তখন তার সঙ্গে সারোয়ার জাহানের খুদে বার্তা বিনিময় হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মনিরুল বলেন, ওই দিন সকাল সোয়া ছয়টার দিকে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের সদস্যরা তামিমকে ঘিরে ফেলেন। এরপরে তামিম চৌধুরীর হাতে খুব কম সময় ছিল। সে সময় সামান্য যে যোগাযোগ তিনি করতে পেরেছিলেন, তা তানভীর কাদেরী ও মেজর জাহিদের সঙ্গে।
র্যাব দাবি করেছিল, ‘নব্য জেএমবির’ সদস্য আছে আর মাত্র ২১ জন। এ প্রসঙ্গে মনিরুল বলেন, এ ধরনের কোনো তথ্য পুলিশের কাছে নেই। তবে খবর আছে, শীর্ষস্থানীয় নেতারা অভিযানে নিহত হওয়ায় ‘নব্য জেএমবির’ মাঝারি বা নিচের সারির কিছু নেতা এখন দায়িত্ব নিয়েছে।
চার মাস আগে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) তাবেলা হত্যাকান্ড নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর দুর্বৃত্তদের গুলীতে নিহত ইতালিয়ান নাগরিক তাবেলা হত্যাকান্ডের ঘটনায় বিএনপির স্থানীয় নেতাসহ সাত জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ২৭ জুন আদালতে সাত জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় পুলিশ। অভিযোগপত্রে থাকা আসামীরা হলেন- ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতা ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার এমএ কাইয়ুম, তার ভাই আব্দুল মতিন, তামজিদ আহমেদ ওরফে রুবেল ওরফে শুটার রুবেল, রাসেল চৌধুরী ওরফে চাক্কি রাসেল, মিনহাজুল আরেফিন রাসে ওরফে ভাগনে রাসেল, শাখাওয়াত হোসেন শরিফ ও সোহেল ওরফে ভাঙারি সোহেল।
এখন কারা নব্য জেএমবি পরিচালনা করছে-এ প্রশ্নে জবাবে মনিরুল বলেন, ‘যাদের এখন আটক করা সম্ভব হয়নি তারাই এখন নব্য জেএমবির দায়িত্ব নিয়েছে। নব্য জেএমবির সঙ্গে পুরনো জেএমবির কয়েকজন যোগ দিয়েছে। তবে তাদের মধ্যে এখনও অন্তর্দ্বন্দ্ব রয়েছে। যার ফলে পুরনো জেএমবির কাউকে নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ পদে দেয়নি বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।’