বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

সংখ্যালঘুদের উপর হামলায় জড়িতদের বিচার হবে তো?

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয়ে হামলা এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলেও এখন পর্যন্ত তাদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। তবে অপকর্মের হোতা যারা তাদের জনতা হাতেনাতে ধরতে পেরেছে। তাদের পরিচয় তারা অধিকাংশই সরকারি দলের সমর্থক। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও গাইবান্ধায় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার সাথে সরকারি দলের জড়িত থাকার কথাই সামনে আসছে। এ নিয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে বিচারের দাবিতে সবাই সরব হয়ে উঠেছে। কিন্তু সরকারি দল এটাকে ভিন্নকাতে প্রবাহিত করার নানা অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এবারো যে কোনোভাবে বিএনপিসহ বিরোধী জোটকে এর সাথে জড়িত করার চেষ্টাা চালানো হচ্ছে। ভিকটিমদের প্রথম দাবি বিচার বিভাগীয় তদন্তের। কারো দাবি- তদন্ত হোক জাতিসংঘের উদ্যোগে। দেশবাসী বলে, সত্য উদঘাটন  হোক, শান্তি আসুক সবার জীবনে। কিন্তু ভুক্তভোগী সংখ্যালঘুরা কি আশা করেন যে, তদন্তটা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বা যুদ্ধাপরাধ বিচারের মতোই হবে?
সূত্র মতে, নির্বাচনোত্তর অতীতেও এমনি ধরনের অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে থাকলেও এবারের ঘটনাবলি নানা কারণে ভিন্ন মাত্রা পেরেছে। সরকার সমর্থিত কয়েকটি কাগুজে এহেন নাশকতাকে ভিন্নভাবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করছে। সরকার ও সরকারের ধামাধরা কিছু মিডিয়া আগে থেকে করে রাখা বিবৃতি ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে আগের মতো এবারো যুগপৎ দেশবাসী ও বিশ্ববিবেককে বিভ্রান্ত করতে চাইল যে, এটি জামায়াত-শিবিরের কাজ। বিশেষজ্ঞরা বরছেন, এভাবে কখনো প্রকৃত সমস্যার সমাধান আসবে না। কারণ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ এবার ঠিক ঠিক সত্য প্রকাশ করে মিডিয়া এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলি প্রসঙ্গে এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী যথার্থই বলেছেন, ‘বিএনপি ও জামায়াত-শিবির সংখ্যালঘু নির্যাতন করছে এটি একটা স্লোগান হয়ে গেছে’। এডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত বলেছেন, ‘সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা আওয়ামী লীগই বেশি করছে’। ব্যারিস্টার জ্যোতিময় বড়ুয়ার মূল্যায়ন ‘সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাসহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলো সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করে বিশেষ করে আওয়ামী লীগ’। কয়েক বছর ধরে সংঘটিত ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করলে সবক্ষেত্রেই কিছু অভিন্ন বা বাস্তবতা পাওয়া যায়, যা প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে বিশেষভাবে সহায়ক।
প্রতিটি ঘটনার পরপরই কোনো তথ্যানুসন্ধান ছাড়াই জামায়াত-শিবিরের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে, এর বিপরীতে সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ কোনো সন্ত্রাসী ঘটনারই এ পর্যন্ত নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি।
এ পর্যন্ত দুষ্কর্মের সাথে জড়িত যাদের হাতেনাতে ধরা গেছে। হামলাকারীদের ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। তাদের কারো সাথেই জামায়াত-শিবিরের দূরতম সম্পর্কও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং কথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক’ গোষ্ঠীর সাথে ঘনিষ্ঠতার প্রমাণই পাওয়া যায়। প্রতিটি ঘটনার পরপরই পুলিশ কখনো ওপরের নির্দেশ কখনো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিএনপি-জামায়াত-শিবির ধরার অভিযানে নেমে গেছে। এবারো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিএনপি’র এক ইউনিয়ন সভাপতিকে গ্রেফতার করেছে। অথচ সেখানে হামলার সাথে জড়িত যাদের নাম এসেছে তারা সবাই সরকার দলীয়। ভিকটিমরা নিজেই গণমাধ্যমে জানিয়েছে।
এর আগে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হামলা হলো, অলঙ্কার চুরি হলো, কোনো প্রমাণ বা তদন্ত ছাড়াই দায়ী করা হলো ‘কেষ্টা’কেই। রামুর বৌদ্ধপল্লী, লাকসামের হিন্দুপাড়ায় হামলার জন্যও কেষ্টাকেই দোষী সাব্যস্ত করে মামলার জন্য সংখ্যালঘুদের কতভাবেই না প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হলো। ক্ষতিগ্রস্তরা মিথ্যে অভিযোগ দিতে রাজি না হলে কী হবে, পুলিশ নিজেই কেষ্টা খোঁজে লেগে গেল। অভিযোগের তীর সরকারের দিকে আর পুলিশ খোঁজে বিএনপি-জামায়াত।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ বলেন, ‘তোমরা অমুসলিমদের দেব- দেবীকে গালি দিয়ো না। তাহলে অজ্ঞতাবশত তারাও তোমাদের আল্লাহকে গালি দেবে’। একজন সাধারণ মুসলমানও ভুলেও কখনো অন্যদের দেব-দেবী বা ধর্মপ্রচারকদের গালি দেন না, দিতে পারেন না। বরং তাদের নামও মুখে নেন সম্মানের সাথে, যদিও বিনিময় দেড় হাজার বছর ধরেই তাদের নবী (সাঃ)’কে গালি দেয়া হচ্ছে- কুৎসা রটনা করা হচ্ছে বিরতিহীনভাবে।
এখন এমন কোনো পাগলও এ কথা কি বিশ্বাস করবে যে, কথিত মৌলবাদীরা কুরআনের বিধান লঙ্ঘন করে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করছে, ভাঙছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে মূর্তি ঘরদোর ও মন্দির? অথচ কুরআন পাকের যুদ্ধাবস্থাও প্রতিপক্ষের বাড়িঘর, ফসল, বৃক্ষ ও বেসামরিক জনপদের জানমাল হেফাজতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, বিরত থাকতে বলা হয়েছে অন্যায় রক্তপাত ও বাড়াবাড়ি থেকে। বলা হয়েছে, যে অন্যায়ভাবে কোনো মানুষকে হত্যা করল সে যেন পুরো মানবতাকেই হত্যা করল। পক্ষান্তরে, যে একজন মানুষের জীবন রক্ষা করল সে যেন রা করল পুরো মানবতাকে’।
সরকার এতটাই বিরোধী মত দমনে সচেষ্ট যে, সাগর-রুনি, ত্বকী, ব্লগার রাজীবসহ বলতে গেলে সব খুন-খারাবির দায় নিতে হয়েছে এ বিরোধী মতকেই। এরও আগে রমনা বটমূলে উদীচীর মঞ্চে, নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ অফিসে, দেশজুড়ে জেএমবি’র বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলা, সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ হত্যাসহ সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিপক্ষকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাস জ্বালিয়ে দেয়ার অভিযোগও আনা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ওখানে গিয়ে কেঁদে ছিলেন, প্রতিজ্ঞা করেছিলেন অপরাধীদের শাস্তি বিধানে কিন্তু সন্ত্রাসী পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তার চোখের পানি নিমিষেই শুকিয়ে গেল।
নানা রাজনৈতিক সমীকরণ সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক উত্তাপ-উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা বাংলাদেশে যেন একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। যে কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য সম্প্রদায়গত সহাবস্থান ও সহমর্মিতা সবারই কাম্য। কোনো ধর্মের প্রকৃত শিক্ষার মধ্যে অন্য ধর্মে বিশ্বাসীদের নিরাপত্তা বিধানের শিক্ষা রয়েছে। এর ব্যতিক্রম যারা ঘটায় তারা ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে সরে পড়ে। এরপরও উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী অনেকে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে এ ধরনের ঘটনার সাথে যুক্ত হয়।
আবার অনেক সময় তারা এর দায় ধার্মিকদের ওপর চাপানোর জন্যই এটি করে থাকে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে এ ধরনের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এসব ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য প্রকৃত যারা দায়ী এবং এসব ঘটনার যারা নায়ক, তাদের চিহ্নিত করতে তদন্তের আগেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দায়ী করে সরকারের সর্বোচ্চপর্যায় থেকে মন্তব্য করা হয়। এর ফলে ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত না হয়ে সরকারের শীর্ষপর্যায়ের সেই নির্দেশিত পথেই তদন্ত হতে দেখা যায়। এতে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। ফলে বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে।
আমরা মনে করি, সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের সব ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। এ ব্যাপারে কেউ অপরাধে যুক্ত থাকলে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু এটাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বা আদর্শগত প্রতিপক্ষকে এর শিকার বানানো অথবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অন্যায্য হস্তক্ষেপ করা হলে এর পরিণতি রাষ্ট্রের জন্য শুভ হবে না। সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু সবার পরিচয় হলো মানুষ। সবার জানমালের নিরাপত্তা বিধানে একই ধরনের দায়িত্ব রয়েছে রাষ্ট্রের।
বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর, কয়েকজন হিন্দু দুর্বৃত্তের ঘটানো অগ্নিকাণ্ডে বাঁশখালীতে নিহত হওয়া, পাবনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, রাজধানীতে একটি হিন্দু পরিবারের ভিটেবাড়ি দখল এবং তাদের ওপর হামলা, এসব এখন পুরনো খবর। কিন্তু তাদের উপর এই হামলা কারা করল? বিচার কেন হচ্ছে না? এখন যে হিন্দু বাড়ি, মন্দিরে হামলা হলো, ধর্ষিতা হলো হিন্দু বোনেরা, তার যথাযথ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত হবে কি? 
ই-মেইল: [email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ