শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক বাঘা যতীন

ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক বাঘা যতীন। বাঘা যতীন একজন বাঙালী বিপ্লবীর নাম। ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লববাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বের সর্বাধিনায়ক। তিনি বাংলার সশস্ত্র বিপ্লববাদী দল যুগান্তর-এবং পরে সকল বিপ্লববাদী দলের প্রধান নির্বাচিত হয়েছিলেন। জার্মানদের সহায়তায় ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানোর পরিকল্পনার উদ্যোগতাও তিনি। সেই ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক বাঘা যতীনের স্বপ্নের সব নাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়ার মাটিতে পোঁতা। দীর্ঘ বছর আগের কিছু স্মৃতি, কিছু চিহ্ন তাঁর বাস্তু ভিটায় আজ খুঁজে পাওয়া বড়ই দুস্কর। ইতোমধ্যে এ মহান বিপ্লবের বাস্তুভিটাসহ বেদখল হয়ে গেছে ২২ বিঘা জমি। স্বাধীনতা পরবর্তী বাঘা যতীনের স্বজনেরা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমানের সাথে দেখা করলে তিনি বাঘা যতিনের বাস্তুভিটায় একটি মিলিটারী একাডেমী স্থাপনসহ বেশ কিছু প্রকল্প স্থাপনের কথা বললেও কোন প্রকল্প আজও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে এতদিন রক্ষনা-বেক্ষেনের অভাবে চরম অনাদর আর অবহেলায় পড়ে থাকা তাঁর বাস্তুভিটা- যার সবকিছুই এখন প্রভাবশালীদের দখলে। স্মৃতি বলতে অবশিষ্ট রয়েছে তাঁর নিজ হাতে নির্মিত একটি থিয়েটার ক্লাব ও একটি ফুটবল মাঠ। এলাকাবাসী মনে করেন, বঙ্গবন্ধু সরকারের সে সময়ে নেয়া প্রকল্পগুলো এখন বাস্তবায়ন হলে এ প্রজন্মের শিার্থীদের জন্য সহজেই বাঘা যতীনের জীবনকর্ম ও সঠিক ইতিহাস জানার পাশাপাশি তাঁকে নিয়ে গবেষণারও অপার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সরকারী এ উদ্যোগকে কেন্দ্র করে সেখানে গড়ে উঠতে পারে সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্রও।
শুধুমাত্র একটি ছোরা দিয়ে একাই একটি বাঘকে হত্যা করতে যিনি সক্ষম হয়েছিলেন সেই বাঘা যতীনের জন্ম ১৮৭৯ সালের ৮ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতার নাম শরৎশশী। বাঘা যতীনের মা বিধবা শরৎশশী দেবী ছিলেন স্বভাবকবি। স্বামীর স্বর্গারোহণ, শ্মশান, সংসার প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই বাঘা যতীনকে সাহসী করে তোলার পেছনে তার মা শরৎশশীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৮৯৯ সালে এই মহীয়সী রমণী ছেলে বাঘা যতীন ও মেয়ে বিনোদবালাকে রেখে মৃত্যুবরণ করেন। মাতার মৃত্যুর পর বোন বিনোদবালা বাঘা যতীনকে মায়ের স্নেহে গড়ে তোলেন। তৎকালীন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করা শিতি বোন বিনোদবালাও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। বাঘা যতীনের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন তার এই বোন বিনোদবালা। যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাঘা যতীন হয়ে ওঠার পেছনে তার মামারা অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষ করে বড় মামা বসন্ত কুমার মুখোপাধ্যায়। চুয়াডাঙ্গা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন প্রথম জীবনে। পরে তিনি নিজেকে আইন পেশায় নিয়োজিত রেখেছিলেন এবং ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। যতীনের বড় মামা বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পরামর্শ নিতে আসতেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-পার্শ্ববর্তী শিলাইদহে তার জমিদারী সংক্রান্ত নানা প্রয়োজনে।
বিখ্যাত বিপ্লবী এমএন রায় মন্তব্য করেছিলেন, আমি বাঘা যতীন ও লেনিন দুজনকেই দেখেছি। এ দুজনের মধ্যে বাঘা যতীনই শ্রেষ্ঠ। বিপ্লবী এমএন রায় তার এই মন্তব্যের মাধ্যমে মহামতি ভ.ই. লেনিনকে ছোঁ করেননি বরং বাঘা যতীন যে একজন বিশাল মাপের মানুষ সেটিই তার এই মন্তব্যের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন। পলাশীর প্রান্তরে ১৭৫৭ সালে বাংলার সূর্য অস্তমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দেশ ব্রিটিশদের দখলে চলে যায়। প্রায় পৌনে দু’শ বছর শাসন করে ব্রিটিশ। তখন দেশমাতৃকাকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করতে যে ক’জন মহামানব ও মহাবিপ্লবী তাদের জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন এবং জীবন দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে বাঘা যতীন অন্যতম
বাঘা যতীনের চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে একটা সময় কয়া গ্রাম যেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের দুর্গে পরিণত হয়। বাঘা যতীন সরকারি চাকরিরত অবস্থায় নেপথ্যে অবস্থান করে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন। ১৯০৮ সালে কলকাতার মানিকতলায় গোপন বোমার কারখানার নেতাকর্মীরা পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। এসব নেতাকর্মীর নেতা ছিলেন বাঘা যতীন। কিন্তু সরকারি চাকরি করার জন্য তাকে সন্দেহ করত না পুলিশ। ১৯০৮ সালেই বাঘা যতীন শিলিগুড়ি স্টেশনে উচ্চপদস্থ ইংরেজ সামরিক কর্মচারীদের প্রহার করেন। বেশক’টি কারণে বাঘা যতীনের ওপর পুলিশের সন্দেহ ক্রমেই বাড়তে থাকে। হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে জড়ানো হয়। পনের মাস মামলা চলার পর সরকার তাকেসহ আরও ৪৬ জনকে দোষী সাব্যস্ত করতে ব্যর্থ হলে ১৯১১ সালের এপ্রিল মাসে বাঘা যতীন মুক্তি পান। সহকর্মী অতুল কৃষ্ণ ঘোষের কাছে নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে বাঘা যতীন আন্দোলনের কৌশল পাল্টিয়ে ফেলেন। যশোরে এসে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। আর এই ব্যবসার আড়ালে বিপ্লবের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। ব্রিটিশের শত্রু জার্মানি তখন বিপ্লবীদের ব্যাপকভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা করত। এমন এক সময়ে বাঘা যতীন জানতে পারেন, জার্মান জাহাজ ম্যাভারিক ত্রিশ হাজার রাইফেল,  ব্রি লাখ কার্তুজ ও দুই লাখ টাকা নিয়ে জুন মাসে সানফ্রান্সিসকো থেকে যাত্রা করবে। জাহাজের এসব জিনিসপত্র বুঝে নেয়ার জন্য বাঘা যতীন তার সহকর্মীসহ বালেশ্বরের দিকে রওনা করেন এবং এক পর্যায়ে কাপ্তিপোদায় অবস্থান নেন। এ খবর পেয়ে সরকারের লোকজন বালেশ্বর চলে যায় এবং বিপ্লবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় ইউনিভার্সাল এম্পোরিয়াম নামে একটি দোকানে তল্লাশি চালিয়ে সেখান থেকে বাঘা যতীনের অবস্থান জানতে পেরে গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন কাপ্তিপোদার দিকে অগ্রসর হয়। সেখানে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ব্যাপক সংখ্যক পুলিশ। এত বড় সুসজ্জিত বাহিনী নিয়েও বাঘা যতীনকে গ্রেফতার করা সম্ভব নয় জেনে তারা কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। চারদিকে তাদের লোক ছড়িয়ে দিয়ে প্রচার চালায় যে, একদল ডাকাত এই পথ ধরে পালিয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে গ্রামবাসীর ধাওয়া খেয়ে, দীর্ঘ নদী সাঁতরে পার হয়ে একটা বনের মধ্যে অবস্থান নেন ক’দিনের প্রায় অভুক্ত বাঘা যতীনসহ তার সহকর্মীরা। বনের ভেতর অবস্থিত একটি টিলা থেকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করেন বাঘা যতীনসহ তার সহকর্মীরা। মাত্র ৪ জন সহকর্মী নিয়ে তিন ঘণ্টা যুদ্ধ করে যখন বগলে ও পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাঘা যতীন ধরা পড়লেন, তখন তার রণকৌশলে আশ্চর্যান্বিত হয়ে মাথার টুপি খুলে তাকে সম্মান জানিয়েছিল ব্রিটিশ অফিসাররা। ১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর এই অকুতোভয় মহাবিপ্লবী বাঘা যতীন মৃত্যুবরণ করেন। বাঘা যতীনের চেতনায় লালিত হয়ে গোটা ভারতবর্ষে অসংখ্য বাঘা যতীনের জন্ম হয় এবং এক পর্যায়ে এই অসংখ্য বাঘা যতীনের আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশরা এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। যতীন বেঁচে ছিলেন মাত্র ৩৬ বছর। তিনি যুবক কিশোরদের অনুপ্রেরণা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ