শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ফিরে দেখা : নবেম্বর ২০১৫

আলী আহমাদ মাবরুর : [আমার শহীদ পিতা আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ তার শেষ সাক্ষাতে আমাদের উদ্দেশে কী কথা বলেছিলেন তা তার শাহাদাতের চার দিনের মাথায় আলহামদুলিল্লাহ সকলের সহযোগিতায় লিখতে সক্ষম হয়েছিলাম। ঐ লেখাটি সেসময় বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ঐ প্রসংগে আর নতুন করে কিছু তাই লিখতে চাইনি। এই প্রসঙ্গের বাইরে, শহীদ আলী আহসান মোঃ মুজাহিদের শাহাদাতকে কেন্দ্র করে আমাদের পরিবার এক বছর আগের এই সময়গুলোতে যেসব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল তা শেয়ার করার জন্যই মূলত এই লেখা। এটা মূলত একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ।]
দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে এল। নভেম্বর ২০১৫ থেকে নভেম্বর ২০১৬। তবুও সেই দিনগুলো প্রতিটি মুহূর্তে আমার চোখে ভাসে। জীবনের সেই অভিজ্ঞতাগুলো বুকের ভেতরে এমনভাবে গেঁথে বসে আছে যে কোনভাবেই তাকে যেন ভোলা যায় না। আর আমি তা ভুলতেও চাই না কখনো।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শুরুতেই মনে পড়ছে আমাদের মামলার রিভিউ শুনানি হওয়ার দিন ধার্য্য ছিল ২ নভেম্বর, ২০১৫। আমরা জানতাম এই তারিখ কোনভাবেই আর পেছানো সম্ভব নয়। সেই মোতাবেক প্রস্তুতিও নিচ্ছিলাম। নিয়মিতভাবে আইনজীবীদের চেম্বারে গিয়ে তাদের সাথে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সমস্যা শুরু হলো, অক্টোবর মাসের শেষ দিক থেকে। আমাদের মামলার অন্যতম কৌঁসুলি এডভোকেট শিশির মনির ভাইকে হয়রানি করা শুরু করল পুলিশ। তার বাসায় ৪/৫ দফা তল্লাশি হলো। তার বাসা থেকে কম্পিউটারসহ অনেক নথি নিয়ে যাওয়া হলো। যেগুলোতে তিনি মামলার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহে রেখেছিলেন। শিশির ভাই’র সাথে আমি সর্বোচ্চ দুই থেকে তিনবার তার বাসায় মামলার কাজে বসেছিলাম। বেশির ভাগ সময়ই তার চেম্বারেই বসতাম। এরপরও কেন তার বাসায় হানা দেয়া হলো, তা বুঝতে পারছিলাম না। তবে এতটুকু বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারলাম যে, শিশির ভাইকে হেনস্তা করার মুল টার্গেট হলো আমাদের মামলার প্রস্তুতিতে ব্যঘাত ঘটানো।
সেই উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নে তারা বেশ সফলও হয়েছিলো। মামলার প্রস্তুতিতে ভীষণ রকম ঝামেলায় পড়ে গেলাম। শিশির ভাই আত্মগোপনে চলে গেলেন। কোনভাবেই তার সাথে আমি যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। অক্টোবরের ২৭/২৮ তারিখ পর্যন্ত তাকে কোনভাবেই খুঁজে পাইনি আমি। অথচ তার কাছেই আমাদের যাবতীয় পিটিশন, যাবতীয় তথ্যাদি। সিনিয়র এডভোকেট খন্দকার মাহবুব সাহেব আদালতের শুনানিতে অংশ নিলেও তাকে তৈরী করার কাজটি শিশির ভাই করতেন। এখন এই শূন্যতা কে দূর করবে?
সিদ্ধান্ত হলো বিকল্প আইনজীবীকে নিয়ে কাজ করা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের পক্ষে মাত্র দুদিনে এই বিশাল মামলার প্রস্তুতি নেয়া ছিল দুঃসাধ্য। এখানে উল্লেখ্য যে, মানবতা বিরোধী অপরাধের এই মামলাগুলো বাংলাদেশের প্রচলিত ক্রিমিনাল আইন বা সিআরপিসি অনুযায়ী পরিচালিত হয় না। এটা একটা বিশেষ এ্যাক্ট, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) এ্যাক্ট, ১৯৭৩ এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তাই আগে থেকে এর সাথে জড়িত না থাকলে দুদিনের মধ্যে এই মামলার প্রস্তুতি নেয়া বেশ কঠিন। খুব সমস্যায় পড়ে গেলাম।
আইনজীবীদের একটি পক্ষ থেকে মতামত আসলো মামলার শুনানিতে আর অংশ না নেয়ার জন্য। অনেকেই বললেন, যেই আইনজীবী শুনানিতে অংশ নিবেন, তার পরিণতি শিশিরের মতই হবে। তাছাড়া রিভিউ করেও তো কোন লাভ নেই, এই পর্যন্ত সকল রিভিউ রিজেক্ট হয়েছে, এটাও হবে। সেই বিবেচনায় শুনানি বয়কট করলেই বরং লাভ বেশী হবে। এরই মধ্যে একদিন আব্বার সাথে দেখা হলো একুশে আগস্টের কোর্টে। তিনি বললেন, যত কষ্টই হউক, কোন না কোনভাবে ম্যানেজ করে নিতে। রিভিউ শুনানি যেন কোনভাবেই মিস না হয়। আমি সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে পরিবারের সাথে বসলাম। তাদের মতামতও আব্বার মতই অর্থাৎ রিভিউ শুনানী করার পক্ষে। আম্মা বিশেষভাবে দায়িত্ব দিলেন আমাকে, যাতে আমি ঠা-া মাথায় আইনজীবীকে ম্যানেজ করে কাজটা চালিয়ে নিতে পারি। পরবর্তীতে সংগঠন ও আইনজীবীসহ সকলের প্রচেষ্টায় ভিন্ন একটি আইনজীবী টিম নিয়ে আমি খন্দকার মাহবুব সাহেবের সাথে মামলার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বসি। কয়েক দফা বৈঠকও হয়। সেই বৈঠকে পর্যাপ্ত প্রস্তুতিও না থাকা এবং আবার শিশির ভাইয়ের উপর হয়রানির বিষয়টা তুলে শুনানি পেছানোর জন্য আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২ নভেম্বর শুনানি। ঠিক তার আগের দিন ১ নভেম্বর খবর পেলাম, আমার মেঝ ভাইকে তার কর্মস্থল থেকে জোরপূর্বক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আমি নিজে ২০১৩ সালের ৫ মে থেকে বেকার ছিলাম। এবার আরো একজন এই তালিকায় যুক্ত হলো।
এরকম এক পারিবারিক ও আইনগত জটিল পরিস্থিতিতে শুনানীর জন্য কোর্টে গেলাম। খন্দকার মাহবুব সাহেব সময় চেয়ে আবেদন করলেন। কার্যতালিকায় আমাদের পরের সিরিয়ালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেবের মামলা ছিল। আমাদের আইনজীবী শিশির ভাই নাই বিধায় আমরা সময় চাইলাম। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেবের এই ধরনের কোন সংকট না থাকায় তারা আলাদা করে সময় চাইল না। কিন্তু আদালত সময় আবেদন মঞ্জুর করে আমাদের দুটি মামলারই রিভিউ শুনানির জন্য নতুন তারিখ ১৭ নভেম্বর নির্ধারণ করে দিলেন। সেদিনই আমার প্রথমবারের মত মনে হলো যে আমাদের দুই মামলার পরিণতি একই দিকে একই সাথে এগুচ্ছে।
হাতে ১৫ দিন সময় পেয়ে আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করলাম। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে নতুন করে মামলার প্রস্তুতির সিদ্ধান্ত নিলাম। এর মধ্যে শিশির ভাইও একদিন হাইকোর্টে হাজির হলেন। তিনি আদালতে পুলিশি হয়রানি এবং তার বিরুদ্ধে করা মামলা দেখিয়ে আদালতের কাছে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলেন। আদালত ৪ সপ্তাহের জন্য তাকে হয়রানি বা আটক না করার নির্দেশ দিলো। ফলশ্রুতিতে আমরা তাকে নিয়েই আবার মামলার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম।
৯ নভেম্বর, ২০১৫ তারিখে আমার শহীদ পিতাকে শেষবারের মত একুশে আগস্টের কোর্টে হাজির করা হয়। ঐদিন তার সাথে আমি আদালতের ভেতরে সাক্ষাতও করেছিলাম। আমার আব্বাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই মামলায় ২০১১ সালে একটি সম্পূরক চার্জশীটের মাধ্যমে আসামী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সালে আমার আব্বার শাহাদাতের আগের সপ্তাহ পর্যন্ত তাকে নিয়মিতভাবে এই মামলায় হাজির করা হয়। প্রতি সপ্তাহে দুদিন আবার কখনো কখনো ৩ দিন এই মামলায় তাকে হাজির করা হতো। কিন্তু ৯ নভেম্বরের শুনানীর পরের সপ্তাহে কোন তারিখ দেয়া হলো না। তারিখ দেয়া হলো একবারে ২৪ নবেম্বর। এরকম ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। ১৭ নভেম্বর আপীল বিভাগের শুনানি তো আগেই ২ নবেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছিল। আর আপীল বিভাগে তো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে হাজির করা হয় না। সুতরাং একুশে আগস্টের আদালত ইচ্ছে করলে পরের সপ্তাহে তারিখ দিতে পারতেন। কিন্তু কেন যেন দিল না।
আমি আদালত থেকে বের হয়েই অন্যান্য অভিযুক্তদের আইনজীবীদের প্রশ্ন করলাম, ভাই আপনাদের কারও কোন মামলার তারিখ আছে সামনের সপ্তাহে, আপনারা কেউ কি সময় চেয়ে আবেদন করেছিলেন? সকল আইনজীবী অস্বীকার করলেন। বললেন, আমরা কেউই কোন টাইম চাইনি। জজ সাহেব নিজেই কোন আবেদন ছাড়াই এক সপ্তাহ বাদ দিয়ে পরের সপ্তাহে তারিখ দিয়েছেন। আমার মনে কেমন যেন একটা আঘাত লাগলো। মামলার দৌড়াদৌড়ি ৬ বছরে যা করেছি তাতে তো কিছুটা হলেও অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমার মনে হলো, নিশ্চয়ই প্রশাসনের পক্ষ থেকে জজ সাহেবকে কোন ম্যাসেজ দেয়া হয়েছে। তার মানে এই সময়ের মধ্যেই আব্বার রায় কার্যকর করেও ফেলতে পারে।
১৭ নবেম্বরের শুনানিতে সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন অসাধারণ পারফরমেন্স করলেন। অনেকেই বের হয়ে বললেন এটা তার বেস্ট রিভিউ শুনানি। আমি যতটুকু শুনতে পেরেছি আমারও তাই মনে হয়েছে। আপীল বিভাগের শুনানীতে ঐদিন আইনজীবীর বাইরে অন্য লোকদের প্রবেশে খুব কড়াকড়ি থাকায় পুরো শুনানী আমি শুনতে পারিনি। আমাদের মামলার পরে মাহবুব সাহেব সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার রিভিউতেও অংশ নেন। তবে সেটা খুব একটা বড় হয়নি। একদিনেই তাই দুই মামলার রিভিউ শুনানি শেষ হয়ে যায়। রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ হয় পরের দিন অর্থাৎ ১৮ নবেম্বর।
রায় ১৮ তারিখ যথারীতি খারিজ হলো। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। এর মধ্যেও সাংবাদিক ও মিডিয়ার সাথে ঠাণ্ডা মাথায় কথা বললাম। আইনজীবীদের সাথে আলাপ করলাম, আর কী করার আছে। সকলের সাথে আলাপ করে মনে হলো, আব্বার সাথে পরিবারের সাক্ষাতটা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। জেলখানায় যোগাযোগ করতে শুরু করলাম। সাক্ষাতের দরখাস্ত জমা দিলাম। জেলের যে কর্মকর্তারা আগে ফোন ধরতেন সহজেই, হঠাৎ তারা যেন অপরিচিত হয়ে গেলেন। অনেকবার যোগাযোগ করে ১৯ নভেম্বর সাক্ষাতের অনুমতি পেলাম।
১৯ তারিখে সাক্ষাত করতে গিয়ে আব্বাকে আরও দেখতে সুন্দর ও বলিষ্ঠ মনে হলো। দেখে বুঝলাম তিনি খোদার দরবারে হাজির হওয়ার প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছেন। নানা কথা হলো। আব্বা আমার কাছে জানতে চাইলেন, ট্রাইব্যুনালের মামলার তো ফায়সালা হলো, একুশে আগস্টের মামলার কী হবে? ২৪ তারিখ তো হাজিরা আছে। আমি বললাম, আমি জানিনা, ঐ মামলার পরিণতি কী হবে এটা আইনজীবীরা ভাল বলতে পারবেন। তখন তিনি বললেন, রাষ্ট্রপতি যেহেতু সংবিধান অনুযায়ী দেশের এক নম্বর ব্যক্তি আবার একজন আইনজীবীও বটে; তাই তার কাছে আমি এই বিষয়টা জানতে চাইবো। আমাকে দায়িত্ব দিলেন আইনজীবীদের সাথে একটা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার জন্য। আর বললেন, যদি আইনজীবীরা সাক্ষাতের অনুমতি না পায়, তাহলে আমরাই যেন মিডিয়ার মাধ্যমে তার এই প্রশ্নটা জাতির সামনে উত্থাপন করি।
আব্বার প্রশ্নটি ছিল অনেকটা এরকম, তাকে তো যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসি দেয়া হলো। এই মামলাটি বিশেষ এ্যাক্টের অধীনে হওয়ায় তার সকল ধরনের নাগরিক ও সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার স্থগিত ছিল। তাছাড়া এই মামলাটি প্রচলিত ক্রিমিনাল আইন বা সিআরপিসি দিয়েও চলে না। তাই যুদ্ধাপরাধের মামলায় যে অভিযুক্ত হয়, তার অবস্থা হয় অনেকটা হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গভীর কুয়োর ভেতরে পড়া মানুষের মত। কিছুই করার থাকে না। বলা যায়, মামলা শুরু করার আগেই রায় নির্ধারণ করা হয়ে যায়। কিন্তু একুশে আগস্টের অপর যে মামলায় তাকে নিয়মিত হাজির করা হচ্ছে, সেই মামলাটি প্রচলিত ক্রিমিনাল আইনে হচ্ছে। এই মামলায় তার আইনী ও মৌলিক অধিকার আর দশটা সাধারণ নাগরিকের মতই বলবৎ আছে। তাই তার পূর্ণাঙ্গ অধিকার আছে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার। যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসি কার্যকর করার জন্য যদি একুশে আগস্ট থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়, তার মানে কিন্তু এটা নয় যে তিনি সেই মামলায় খালাস পেয়েছেন। বরং ভিন্ন মামলায় মৃত্যুদ- কার্যকর করায় তাকে অব্যাহতি দেয়া হবে। কিন্তু তিনি মনে করেন একুশে আগস্টের মামলায় তার খালাস পাওয়ার সব রকমের চান্স ছিল। কেননা তখনও পর্যন্ত ১৫০ এর উপর সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছিলেন এবং তাদের কেউই একবারের জন্য শহীদ মুজাহিদকে অভিযুক্ত করাতো দূরের কথা, তার নামটিও উচ্চারণ করেনি। তাই তিনি শেষ পর্যন্ত লড়াই করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন।
সেদিনের সেই সাক্ষাতে আব্বা আরও বললেন, মাফ তিনি চাইবেন না, তিনি কোন অপরাধ করেননি, তাহলে মাফ কেন চাইবেন। আর মাফ চাওয়া মানে নিজের অপরাধ স্বীকার করা যা কখনোই সম্ভব নয়। তবে মাফ না চাওয়ার এই বিষয়টা তিনি আইনজীবীদের সাক্ষাতের পর তাদেরকে দিয়েই বলাবেন। আর মিডিয়ায় কথা বলার জন্য তিনি নিজেই আম্মাকে পরিবারের মুখপাত্র হিসেবে নির্বাচন করলেন। আমরা সেইদিন আব্বার জানাযা কে পড়াবেন, দাফন কোথায় হবে এই সব বিষয় নিয়েও আলাপ করলাম। আমার বড় ভাই এই কঠিন কাজটি করলেন। সন্তান হিসেবে জীবিত সুস্থ পিতাকে প্রশ্ন করা যে, আপনাকে কোথায় কবর দিবো, আপনার কোন চয়েজ আছে কি না, এটা যে কি কঠিন একটি অনুভূতি, তা অন্য কারও বোঝা সম্ভব নয়। এই মানসিক চাপটা আমাদের প্রত্যেককেই মানসিকভাবে অনেকটা অসুস্থ করে দিয়েছে বলে আমার মনে হয়। এই অসুস্থতা থেকে আমরা এখনও রেহাই পাইনি।
বের হয়ে আমরা মিডিয়ার সাথে সেই অনুযায়ী কথা বলেছি। এরপর আমি ফিরে গিয়েছিলাম চেম্বারে। আর অন্যরা বাসায়। আমি আইনজীবীদের সাক্ষাতের জন্য একটি দরখাস্ত লিখে আমাদের আইনজীবী এডভোকেট গাজী তামিমকে কারাগারে যাওয়ার অনুরোধ করলাম। বেচারা ঐদিন অনেকটা সময় জেলগেটে বসে থেকে সন্ধার পরে আমাকে জানালেন, সাক্ষাতের অনুমতি তো দিচ্ছেই না, এমনকি দরখাস্তের কপিও রিসিভ করছে না। আমি চলে আসতে বললাম। পরের দিন অর্থাৎ ২০ নবেম্বর সকালে আবারও আমি তাকে ফোন দিয়ে রিকুয়েস্ট করলাম যাতে তিনি আবারও জেলগেটে দরখাস্তটি নিয়ে যান। সেদিনও সারা দিন বসে এডভোকেট তামিম আমাকে জানালেন যে, সাক্ষাত মনে হয় আর এলাউ করবে না।
এর আগে শহীদ কামারুজ্জামান চাচার রিভিউ রায় বাতিল হওয়ার পরেও একটা আইনজীবীদের সাক্ষাৎ হয়েছিল। কিন্তু আমাদের বেলায় যখন দরখাস্তটাই রিসিভ করছে না, তখন আমার মনে কেমন যেন একটা খটকা লাগলো। মনে হলো ওদের মনে কোন দুরভিসন্ধি আছে।
আমার যতটা মনে পড়ে, ১৯ তারিখ রাত থেকে শুরু করে ২০ তারিখ রাত পর্যন্ত আমরা দফায় দফায় বাসায় আলোচনায় বসেছি, মিটিং করেছি। বিশেষ করে শেষ সাক্ষাতে কারা কারা যাবেন, কাদেরকে বাদ দিবো। যারা যাবেন তাদের আইডি কার্ড জোগাড় করা, তাদেরকে রেডী থাকতে বলা। এত সব লোক কিভাবে যাবেন, তাদের ট্রান্সপোর্ট আয়োজন করা। আল্লাহর রহমতে প্রতিটি সময়ে সংগঠনের দায়িত্বশীলদেরকে কাছে পেয়েছি, তাদের কাছ থেকে সার্বিক সহযোগিতা পেয়েছি। কিন্তু কখন যে শেষ সাক্ষাতের ডাক আসবে এটা তো কেউই জানি না, তাই এতগুলো সাক্ষাৎপ্রার্থী মানুষকে আটকে রাখাও কঠিন ছিল।
যাই হউক সময় বয়ে যাচ্ছিল। মিডিয়ার ভাবসাব আর রিপোর্ট দেখে মনে হচ্ছিল ফাঁসি ২১ তারিখ হয়েই যাবে। অথচ তখনও পর্যন্ত আইনজীবীদের সাক্ষাৎ করাতে পারলাম না। আম্মাসহ বাসার সবার সাথে আলাপ করলাম। তাদেরকে মনে করিয়ে দিলাম যে, আব্বাতো বলেছিলেন, যদি আইনজীবীদের সাক্ষাৎ করতে না দেয় তাহলে তার ২১ আগস্টের মামলার পরিণতি সংক্রান্ত প্রশ্নটা যাতে আমরাই জাতির সামনে তুলে ধরি, সেটাতো করতে হবে, কখন কি হয়ে যায় বলা যায় না।
আম্মা সিদ্ধান্ত দিলেন ২১ তারিখেই সংবাদ সম্মেলন করার। সংগঠনকে জানালাম আমরা মামলার প্রয়োজনে এই সংবাদ সম্মেলনটা করতে চাই। তারা অনুমতি দিলেন। শুধু তাই নয়, তাদেরই ব্যবস্থাপনায় সুপ্রিম কোর্ট বার মিলনায়তনটি সংবাদ সম্মেলনের ভেন্যু হিসেবে ঠিক হয়। আমি নিজে সাংবাদিকদের ফোন করে করে সংবাদ সম্মেলনের দাওয়াত দিলাম। ২০ তারিখ কয়েকদফায় ড্রাফট করে অবশেষে সংবাদ সম্মেলনে আম্মার দেয়া বক্তব্যটি ফাইনাল করি। গভীর রাতে এক প্রতিবেশী ভাইয়ের বাসা থেকে প্রিন্ট করে সাংবাদিকদের জন্য বক্তব্যের কপি তৈরী করি। ঐ ভাইয়ের বাসায় প্রিন্টার ছিল না। তিনি আরেকজনের বাসা থেকে শুধু আমাদের কাজের জন্য ঐ প্রিন্টার জোগাড় করেছিলেন। কাজ শেষ করতে করতে রাত ১টা বেজে গেল। সেনসিটিভ সময়। তিনি তো কোনভাবেই আমাকে সেই রাতে আর বের হতে দিবেন না। কিন্তু আমার মনটা এত বেশী অস্থির ছিল আমি থাকতেই চাইলাম না। বাধ্য হয়ে সেই রাতের বেলায় প্রতিবেশীর কাছ থেকে চাবি নিয়ে সেই ভাইটি আমাকে মেইন গেটের তালা খুলে দিলেন। আমি রাত দেড়টার দিকে বাসায় ফিরলাম। এই সব ভাইদের ভূমিকা এখনও মনে পড়ে প্রতিক্ষণই। এই সংগঠনের অজস্ত্র মানুষকে আমি চলার পথে পেয়েছি, যাদেরকে কোনভাবে আমাদের প্রয়োজনের কথা বলা মাত্রই তারা নিজেদের সব কষ্টকে বেমালুম ভুলে গিয়ে আমাদেরকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। দায়িত্বশীলদে প্রতি তাদের এই ভালবাসা ইসলামী আন্দোলনের অনন্য-সাধারণ সৌন্দর্যকেই প্রকাশিত করে।
পরের দিন আমরা আম্মার নেতৃত্বে সুপ্রীম কোর্ট বার অডিটোরিয়ামে যাই। সেখানে আম্মা তার বক্তব্য পেশ করেন। পরে আম্মাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা বাসায় রওয়ানা দেন। আমি একাই পল্টন আইনজীবীদের চেম্বারে চলে যাই। চেম্বারে যাওয়ার পথেই সাংবাদিকদের ফোন পেতে শুরু করি। আব্বা নাকি রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লিখেছেন। চেম্বারে গিয়ে টিভিতে দেখলাম, আমার বাবা আর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দুজনই নাকি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। আগের দিন আমার মনে ওদের দুরভিসন্ধি নিয়ে যে খটকাটা লেগেছিল সেটা তখন আমি বুঝতে পারলাম। এর মাধ্যমে আসলে আমার বাবার শেষ সময়েও তাকে নিয়ে ইতিহাসের জঘন্যতম মিথ্যাচার শুরু হয়। আমি বুঝলাম, আইনজীবীদের সাক্ষাত করতে দেয়নি, যাতে আব্বার প্রকৃত অবস্থান ও চিন্তা বাইরের পৃথিবীতে বেরিয়ে আসতে না পারে। লুকোচুরি খেলে তারা আব্বাকে জাতির সামনে ভীতু প্রমাণের চেষ্টা চালিয়েছে। তাকে নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা-সংক্রান্ত নাটক রচনার জন্যই আমার বাবাকে তার শেষ চাওয়া অনুযায়ী আইনজীবীদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পর্যন্ত দেয়া হয়নি।
ঐদিন (২১ নভেম্বর) দুপুর বিকাল সন্ধায় টিভির স্ক্রল অনুযায়ী আব্বার লেখা সেই তথাকথিত মার্সি পিটিশনটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্টপ্রতির কাছে ঘুরেছে। অথচ আমরা এরই মধ্যে (রাত ৮টা নাগাদ) শেষ সাক্ষাতের জন্য ডাকও পেয়ে গেলাম। সুতরাং যাদের কমন সেন্স আছে তারা এমনিতেই বুঝতে পারবেন, যদি ক্ষমাই চাইতেন তাহলে তার ফায়সালা না হওয়ার আগে আমাদেরকে শেষ সাক্ষাতের জন্য ডাকা হতো না।
অবাক লাগে, আব্বাকে যখন দাফন করে ঢাকায় ফিরছি, তখনও অনেক সাংবাদিক ফোন দিয়ে বলেছেন, আপনি অস্বীকার করছেন, কিন্তু আইনমন্ত্রী তো বলছেন আপনার বাবা ক্ষমা চেয়েছেন। আমি বললাম, আব্বা তার শেষ সাক্ষাতে ক্ষমা চাওয়ার দাবিটি হাস্যকর ও মিথ্যাচার বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তারপরও আপনারা যখন এটা বলেই যাচ্ছেন তাহলে আমি চ্যালেঞ্জ করলাম, ওনার লেখা সেই তথাকথিত ক্ষমা চাওয়ার আবেদনটি জাতির সামনে প্রকাশ করা হউক। আমি আব্বার হাতের লেখা চিনি। আমিও দেখতে চাই তিনি কী লিখেছেন বা আদৌ কিছু লিখেছেন কি না।
আজ প্রায় এক বছর হয়ে এলো। এখনও সেই চ্যালেঞ্জের কোন উত্তর পেলাম না। আসলে সত্য এভাবেই বিজয়ী হয়। আর মিথ্যা সাময়িক লম্ফঝম্প করলেও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে না। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এই জন্যই ঘোষণা করেছেন, সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসারিত, মিথ্যার পতন অবশ্যম্ভাবী। আমার শহীদ পিতা তার শাহাদাতের মাধ্যমে শুধু যে ইসলামী আন্দোলনের ভিত্তিকে মজবুত করে গেছেন বা ইসলামের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাই নয়; তার শাহাদাতের মধ্য দিয়ে তার সাথে হওয়া ইতিহাসের জঘন্যতম মিথ্যাচারকেও জাতির সামনে উন্মোচিত করে গিয়েছেন।
তিনি তার শেষ সাক্ষাতে পরিবারের সদস্যদেরকে যা বলে গেছেন, তা যুগের পর যুগ অজস্ত্র ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মী ও মুক্তিকামী জনতার জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করবে। আপনাদের সকলের কাছে আমার শহীদ পিতার জন্য দোয়া চাই। আল্লাহ তায়ালা যেন তার শাহাদাত কবুল করেন এবং তার শাহাদাতকে বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামী আন্দোলনের বিজয়ের আজান হিসেবে কবুল ও মঞ্জুর করে নেন।
-লেখক : শহীদ আলী আহসান মোঃ মুজাহিদের ছোট ছেলে

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ