শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মাওলানা কবির উদ্দিন রহমানী

এম এস শহিদ : যেসব প্রবাদপুরুষ বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচার, প্রসার ও মুসলিম সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করে পবিত্র কোরআন ও হাদীসের আলোকে পরিচালিত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন তন্মধ্যে মাওলানা কবির উদ্দিনের অবদান নেহাতই কম নয়। এ মহান পুরুষ ভাওয়াল পরগণার বড়কয়ের গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ছিল মুন্সী আবদুল খালেক ও মাতার নাম ছিল হাজেরা খাতুন। কবির উদ্দিন ছিলেন বাবা মায়ের কনিষ্ঠতম সন্তান। ধর্মীয় জ্ঞান অন্বেষার জন্য শৈশবকালেই তার বাবা তাকে দূরে পাঠিয়ে দেন। ১০ বছর বয়সে কবির উদ্দিন ধর্মীয় জ্ঞান আহরণের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন এবং মনীষী রকিব উদ্দিনের সাথে তিনি ঢাকায় এসে পৌঁছান। এ সময় ঢাকার বিখ্যাত হাম্মাদিয়া স্কুল শিক্ষক মফিজউদ্দিনের সাথে তার পরিচয় হয় এবং শিক্ষক মফিজউদ্দিনের তত্ত্বাবধানে তিনি বংশালের দারুল উলুম মাদ্রাসায় অধ্যয়ন শুরু করেন। সে সময় বাংলার মুসলামানদের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞান সম্পর্কে নানা মতভেদ ছিল। এর ফলে মানুষ বিভ্রান্ত হতো। ফারায়েজী আন্দোলনের প্রবক্তা হাজী শরীয়তুল্লাহ্র ছেলে হাজী দুদু মিয়া ও মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরীর মাঝে ধর্মীয় ব্যাপারে মতপার্থক্য ছিল। ধর্মীয় ব্যাপারে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা ভিন্ন মত পোষণ করতেন। এ মতভেদ মুসলিম সমাজে নানা প্রশ্নের জন্ম দিত। এ সময় ভাওয়াল অঞ্চলে তুমুলিয়াসহ বেশ কয়েকটি গির্জা স্থাপিত হয়। এসব গির্জার প্রভাব ও হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারে রাঙ্গামাটি ও তুমুলিয়ার অভাবগ্রস্ত মানুষ ধর্মান্তরিত হচ্ছিল। কবির উদ্দিনের বাবা খালেক মুন্সী ওই সময় খুবই প্রভাবশালী ও ধনী ব্যক্তি ছিলেন। ধর্মীয় ব্যাপারেও তার পান্ডিত্য ছিল।
তাই তিনি মনস্থির করলেন, ধর্মীয় জ্ঞান আহরণের জন্য কনিষ্ঠ ছেলে কবির উদ্দিনকে যতদূরে যেতে হয়, ততোদূরে পাঠাবেন। বাবার উৎসাহে কিশোর কবির উদ্দিন জ্ঞান আহরণের জন্য যাত্রা করলেন। তিনি দিল্লীতে এসে উপস্থিত হলেন। দিল্লীতে তিনি ১২ বৎসর অতিবাহিত করেন। এ সময় কবির উদ্দিন উর্দু ভাষায় যথেষ্ট পান্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি উর্দু ভাষায় বক্তৃতা করতেও তুখোড় ছাত্র, ভালো বাগ্মী ও তার্কিক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। কবির উদ্দিনের অসাধারণ পান্ডিত্যে দিল্লী জামে মসজিদের ইমাম মুগ্ধ হন এবং তিনি কবির উদ্দিনকে মসজিদে ও তার বাইরে বিভিন্ন ইসলামী সেমিনারে বক্তৃতা দেয়ার জন্য নিয়ে যেতেন। সে সময় ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলছিল। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ভারতকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে জনসাধারণের মধ্যে দেশাত্ববোধ জাগ্রত করতে তৎপর ছিল। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তুরস্কের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং এ সময় তুরস্ককে ঘিরে মুসলিম জাহানে নানা বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পাঁয়তারা চলছিল। যুবক কবির উদ্দিন পড়াশোনা শেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে বাংলায় ফিরে এলেন এবং মুসলিম জাতির উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। দেশে ফিরে এসে তিনি রহমানিয়া মাদ্রাসার শিক্ষকতা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ঢাকার অদূরে বালু নদীর তীরে বড় বেরাইদে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষকতা শুরু করেন। তার খ্যাতি ও যশ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কিছুদিনের মধ্যে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং বংশাল জামে মসজিদের ইমাম ও একই সাথে দারুল হাদিস মাদ্রাসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ মাদ্রাসায় শিক্ষকতাকালে তার হাতে অনেক মেধাবী ছাত্রের জন্ম হয়। এদের মধ্যে ড. মুহাম্মদ মজিবুর রহমান, মাওলানা আনিসুর রহমান, হাফেজ হাসান ও হাফেজ মান্নাফ এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মাদ্রাসা আলীয়া কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর মাওলানা কবির উদ্দিন সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগকে নিয়ে গর্ব করত। এ বিভাগের সম্প্রতি প্রয়াত প্রফেসর ইমেরিটাস ড. সিরাজুল হক মাওলানা কবির উদ্দিনের ছাত্র ছিলেন। তিনি মাওলানা কবির উদ্দিনকে এ বিভাগে যোগদান করার অনুরোধ জানান। কিন্তু কোনো কারণবশত এ বিভাগে তিনি যোগদান করেননি। লালবাগ মাদ্রাসার মাওলানা শামসুল হক সহীহ্ বোখারী শরীফ বাংলায় অনুবাদ করার সময় মাওলানা কবির উদ্দিনের সহযোগিতা নিয়েছিলেন। আলীয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা শুদ্ধ বাংলায় লেখার জন্য তার সহযোগিতা নিতেন। আবরি কবিতা পড়ার সময় তা তিনি বাংলায় তরজমা করে শোনাতেন। হাদিস ও কোরআন সম্পর্কে জানার জন্য অসংখ্য ছাত্রছাত্রী বংশাল মসজিদে প্রতিদিন তার কাছে আসতেন। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের হাদিস ও কোরআন শরীফ বাংলায় এবং উর্দু তরজমায় পড়াতেন। তিনি অধুনালুপ্ত ‘তরজুমানু হাদিস’ প্রকাশনার সময় শুদ্ধরূপে বিশ্লেষণ ও প্রুফ রিডিং করতেন। তিনি ছিলেন কাঠোর পরিশ্রমী মানুষ। সে সময় মিসর থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত প্রত্রিকা ‘আল-জাদিদে’ তিনি লিখতেন। একদা তুমুলিয়া গির্জার ফাদার এক গরীব মুসলিম পরিবারকে খৃস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার উদ্যোগ নেন। এ কথা জানার সাথে সাথে তার্কিক কবির উদ্দিন ফাদারের সাথে বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে যুক্তির মাধ্যমে তাকে পরাস্ত করেন এবং শেষ পর্যন্ত পরিবারটি মুসলমান থেকে যায়। এ ঘটনা আজও তুমুলিয়া, রাঙ্গামাটি এলাকায় উপকথার মতো বিদ্যমান আছে। বিংশ শতকের চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তার্কিক কবির উদ্দিনের যুক্তি খণ্ডন করার মতো লোক খুব কমই ছিল। মাওলানা কবির উদ্দিন তার জন্মস্থান ভাওয়াল পরগণার বড়কয়ের গ্রামে ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে ফসলের মাধ্যমে খাজনা দেয়ার রীতি প্রবর্তন করেন। খেলাধুলা ও সুস্থ বিনোদন জীবনের অংশ এ মনোভাব তিনি তার আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। তিনি রসিকতা করতেও পছন্দ করতেন। তিনি সহজ-সরল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। স্বল্প উপার্জনে কিভাবে সমৃদ্ধ সংসার জীবন-যাপন করা যায় তার উদাহরণ ছিলেন তিনি। সেলাই করে জামায় নক্শা করার কাজ তিনি নিজ হাতে পরিবারের মেয়েদের শেখাতেন। তিনি নৌকাভ্রমণ ও নৌকাবাইচ খেলা পছন্দ করতেন। পাকিস্তানের সোয়াবে মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। মাওলানা কবির উদ্দিনের মধ্যে ধর্মীয় ও জাগতিক চিন্তার অপূর্ব সমন্বয় ছিল। মওলানা আকরম খাঁর সাথে কবির উদ্দিনের সুসম্পর্ক ছিল। কোনো সমস্যা দেখা দিলে অনেক সময় তিনি মাওলানা আকরম খাঁর শরণাপন্ন হতেন। ১৯৬৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মহান পুরুষ মাওলানা কবির উদ্দিন ইন্তেকাল করেন। একদা মওলানা আকরম খাঁ কবির উদ্দিনকে বলেছিলেন, তুমি আমার জানাজাটা পড়ো। কিন্তু মওলানা আকরম খাঁর মৃত্যুর আগেই কবির উদ্দিন মারা যান। তাই মওলানা আকরম খাঁ আফসোস করে বলেছিলেন, আমিই তাকে আমার জানাজা পড়তে বলেছিলাম কিন্তু এখন আমাকেই তার জানাজা পড়তে হলো।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ