শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

রাসূলুল্লাহ (স:)এর সামাজিক যোগাযোগ

জাফর আহমাদ : সাধারণত যারা রাজনৈতিক নেতা, সরকারের মন্ত্রী বা বড় কোন প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তি হন, তারা সর্বশ্রেণীর জনমানব থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকেন। তারা এতবেশী ব্যস্ত থাকেন যে, তাদের দিকে মনোযোগ দেয়ার সময় সুযোগ ও মানসিক চিন্তা-চেতনা কোন কিছু থাকে না। তাদের ভাব-গম্ভীর চেহারা, রুক্ষ মেজাজ ও বাংলা পাঁচ-এর মতো মুখখানা দেখে কোন সাধারণ মানুষ তাদের ধারে-কাছে যাওয়ার সাহস করেন না। কেউ কেউ আবার দাম্ভিকতার কারণে মাটিতে পা রাখেন না। ফলে সাধারণ মানুষ তার চেহারা মোবারকখানাও দেখতে পায় না। সাধারণ মানুষের মুখ যাতে দেখতে না হয় অথবা সাধারণ মানুষ যাতে তার চাঁদ মুখখানা না দেখতে পারে সে জন্য তিনি কালো গ্লাসের গাড়ি ব্যবহার করেন। আমাদের সৌভাগ্য যে, মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সাধারণ মানুষের সাথে কথা-বার্তা, চলাফেরা ও তাদের সুখ-দু:খে অংশ গ্রহণ করার তাওফিক দিয়েছেন। যে সৌভাগ্য উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গকে দেয়া হয়নি।   
কিন্তু রাসুলুল্লাহর (স:) আকাশচুম্বী মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ও পৃথিবীর প্রবল স্রোত পরির্বতনকারী বিশ্ববিজয়ী নেতা হয়েও তিনি সমাজের সর্বস্তরের জন-মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। কখনো একাকী, কখনো দলবদ্ধ অর্থাৎ স্থান, কাল ও পরিবেশ অনুযায়ী তিনি সর্বস্তরের জনগণের কাছে ছুটে যেতেন। এই যোগাযোগ ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ থেকে শুরু করে ছোট্ট ছোট্ট কোন বিষয় বাদ যেত না। সমাজের নিম্নস্তর যেখানে সাধারণত কারো নযর পড়ে না, রাসুল (স:) সেখানেও নির্দ্ধিধায় পৌঁছে যেতেন। ইতিহাসের  পাতায় অসংখ্য এ ধরণের যোগাযোগের উদাহরণ রয়েছে।
একটি ছোট্ট ঘটনা যা আপনার কাছে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে। কিন্তু আমি মনে করি যে, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। ছোট্ট সেই ঘটনাটি হলো, ‘একবার খেলার মাঠে এক শিশুকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ঐ লাল পাখীটা কোথায়? ছেলেটি আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল আপনি এতদিন আগের কথা মনে রাখলেন কি করে?’ হাজারো কাজ, হাজারো ব্যস্ততায় এবং হাজারো শিশুর মাঝে একটি শিশুর পাখীর কথা মনে রাখাকে আপনি রাসুলের (স:) যোগাযোগ ব্যবস্থাকে কিভাবে মূল্যায়ণ করবেন?      
তাঁর যোগাযোগের রীতি ছিল নিম্নরূপ :
রাসুলুল্লাহ (স:) যার দেখা হতো তিনি প্রথমে সালাম দিতেন। কাউকে খবর দিলে সালাম পাঠাতে ভুলতেন না। কেউ সালাম পৌঁছালে সালামের প্রেরক ও বাহক উভয়কে পৃথকভাবে সালাম দিতেন। শিশু. মহিলা, বন্ধু-বান্ধব ও পরিবার-পরিজন সকলকে সালাম দিতেন। সকলের সাথে হাত মেলাতেন. আলিঙ্গন করতেন। 
তিনি বৈঠকাদিতে হাজির হতেন। বৈঠকের এক পাশে বসে পড়তেন। ঘাড় ডিংগিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেন না। হযরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স:) বলতেন, আল্লাহর একজন সাধারণ বান্দা যেভাবে ওঠাবসা করে, আমিও সেভাবে ওঠাবসা করি।’ নিজের হাঁটু সংগীদের চেয়ে আগে বাড়িয়ে বসতেন না। কেউ তাঁর কাছে এলে তাঁকে নিজের চাঁদর বিছিয়ে দিতেন। আগন্তুক নিজে না ওঠা পর্যন্ত তিনি বৈঠক ছেড়ে উঠতেন না। ফজরের জামাতের পর বৈঠক বসতো এবং সাহাবায়ে কেরামের সাথে অনেক কথাবার্তা বলতেন। যে বিষয়ে উপস্থিত লোকদের মুখম-লে বিরক্তি ভাব ফুটে উঠতো, তিনি সেই বিষয় পরিবর্তন করতেন।
কোন অবাঞ্ছিত লোক তাঁর কাছে এলে হাসিমুখে তাকে স্বাগত জানাতেন। একবার এমন এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এল, যাকে তিনি সংশ্লিষ্ট গোত্রের নিকৃষ্টতম ব্যক্তি বলে জানতেন। কিন্তু তিনি তার সাথে মনোযোগের সাথে অমায়িকভাবে কথাবার্তা বললেন। এটা দেখে হযরত আয়েশা রা: বিস্ময় প্রকাশ  করে বললেন, ‘আল্লাহর কসম যে ব্যক্তির দুর্ব্যবহারের ভয়ে লোকেরা তার সাথে মেলামেশাই বন্ধ করে দেয়, কিয়ামতের দিন সে আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি বলে গণ্য হবে।’
কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে দরজার ডান বা বাম দিকে একটু সরে গিয়ে নিজের উপস্থিতির জানান দিতেন। ভেতরে প্রবেশের অনুমতির জন্য তিনবার সালাম দিতেন। সালামের উত্তর না পেলে কোন প্রকার বিরক্তি ছাড়াই ফিরে যেতেন। রাতে সাক্ষাতে গেলে এমন আওয়াযে সালাম দিতেন যাতে সজাগ থাকলে শুনতে পায় আর ঘুমিয়ে থাকলে যাতে তার ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়। কেউ ডাক দিলে ‘লাব্বাইক’ বলে ডাক শুনতেন। খারাপ ব্যবহারের উত্তর তিনি খারাপ ব্যবহারের মাধ্যমে দিতেন না। বরং তিনি ক্ষমা করতেন। অন্যদের অপরাধ ক্ষমার প্রতীক হিসাবে তিনি তাদের জন্য উপহার পাঠাতেন।
তিনি রোগী দেখতে যেতেন। শিয়রে বসে জিজ্ঞেস করতেন, তুমি কেমন আছো? কপালে ও ধমনীতে হাত রাখতেন। কখনোবা বুকে পেটে ও মুখমন্ডলে স্নেহের হাত বুলাতেন। সান্তনা দেয়ার জন্য বলতেন,‘ চিন্তার কোন কারণ নেই, ইনশা’আল্লাহ অচিরেই তুমি রোগমুক্ত হবে। রোগ মুক্তির জন্য দোয়া করতেন। হযরত সা’দের জন্য তিনবার দোয়া করেছিলেন। মোশরেক চাচাদেরও রোগব্যাধি হলে দেখতে যেতেন। একজন ইহুদী শিশুকে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন। (শিশুটি পরবর্তিতে ঈমান এনেছিল)। এ ধরণের যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোন সময় বা দিন নির্ধারিত ছিল না। বরং যখনই খবর পেতেন এবং সময় পেতেন দেখতে যেতেন।
কেউ মারা গেলে সেখানে চলে যেতেন। মুমূর্ষ অবস্থার খবর পেলে বা ডাকা হলে গিয়ে তাওহীদ ও আল্লাহর ব্যাপারে মনোযোগ আকর্ষণ করতেন। মৃত ব্যক্তির আত্মীয় স্বজনকে সমবেদনা জ্ঞাপন করতেন, ধৈর্যের উপদেশ দিতেন এবং চিৎকার করে কাঁদতে নিষেধ করতেন। সাদা কাপড়ে দাফন দিতে তাগিদ দিতেন এবং দ্রুত কাফন দাফন সম্পন্ন করতে বলতেন। নিজে জানাযা পড়াতেন এবং গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করতেন। তিনি মৃতের পরিবারের জন্য খাবার পাঠাতেন। আনুষ্ঠানিক শোক সভা কয়েকদিন পর্যন্ত চলাকে খুবই অপছন্দ করতেন।
প্রবাস থেকে ফিরে কেউ সাক্ষাতে এলে আলিঙ্গন করতেন, কখনো কখনো কপালে চুমু দিতেন। প্রবাসে যাওয়ার সময় তাকে অনুরোধ করতেন: দোয়া করার সময় আমাদের কথা মনে রেখ। স্নেহ ও ভালোবাসার আতিশয্যে কারো কারো সাথে এতটাই অমায়িক হয়ে যেতেন যে, তাদেরকে সংক্ষেপ নামে ডাকতেন।
শিশুদের প্রতি ছিল তাঁর অত্যধিক দুর্বলতা। তাদের কাছে পেলে কোলে তুলে নিতেন, তার মাথায় হাত বুলাতেন, আদর করতেন, দোয়া করতেন। শিশুদের মন ভুলানোর জন্য চমক লাগানো কথা বলতেন। যেমন বলতেন, ‘টিকটিকিরা ভাই রাতে মশার চোখে ঘা মারে দাঁতে।’ একবার এক শিশুকে চুমু খেতে খেতে বলেছিলেন: শিশুরা আল্লাহর বাগানের ফুল। শিশুদের নাম রাখতেন। কখনো কখনো শিশুদেরকে লাইনে দাঁড় করিয়ে পুরস্কারের ভিত্তিতে দৌড়ের প্রতিযোগীতা করাতেন যে, দেখবো কে আগে আমাকে ছুঁতে পারে। শিশুরা দৌড়ে আসতো, কেউ তার পেটের ওপর, কেউ বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তো। তাদের সাথে হাসি তামাশা করতেন। যেমন হযরত আনাসকে কখনো কখনো বলতেন, ‘ও দুই কান ওয়ালা!’ হযরত আনাসের ভাই আবু উমাইয়ের পালিত পাখির ছানাটি মরে গেলে সে উদাস ভাবে বসেছিল। রাসুল (স:) তাদের বাড়ি এসে ডাক দিলেন,‘ও আবু উমাইয়ের, কোথায় তোমার নুগায়ের (পাখির শাবক)? আরেক শিশু আব্দুল্লাহ বিন বশির-এর মাধ্যমে তার মা রাসুল (স:) কে আংগুর পাঠালেন। সে পথিমধ্যে সব আংগুর খেয়ে ফেললো। পরে জানাজানি হয়ে গেল, রাসুল (স:) আদরের সাথে তার কান ধরে বললেন,‘ ওরে ধোঁকাবাজ, ওরে ধোঁকাবাজ’। প্রবাস থেকে আসার পথে যে শিশুকে পথে দেখতেন, সওয়ারীর পিঠে চড়িয়ে আনতেন। ছোট্ট শিশু হলে সামনে ও বড় শিশু হলে পিছনে বসাতেন। মৌসুমের প্রথম ফলমূল আনা হলে তা বরকতের দোয়াসহ কোন শিশুকে আগে খেতে দিতেন।   
বুড়োদের তিনি খুবই শ্রদ্ধা করতেন। মক্কা বিজয়ের সময় হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা: নিজের অন্ধ প্রবীণ পিতাকে ইসলাম গ্রহনের জন্য যখন রাসুলের (স:) কাছে নিয়ে এলেন, তখন তিনি বললেন: ওঁকে কষ্ট দিয়েছো কেন? আমি নিজেই তাঁর কাছে চলে যেতাম।
তিনি বিভিন্ন আলাপ আলোচনায়ও অংশ গ্রহণ করতেন। চাই তা দুনিয়ারী হোক বা আখিরাত কেন্দ্রিক। এমনকি খানা-পিনার আলোচনায়ও অংশ গ্রহণ করতেন। কিন্তু এসব সত্বেও রাসুল (স:) কসম খেয়ে বলেছেন যে, আমার মুখ দিয়ে সত্য কথা ও ন্যায্য কথা ছাড়া আর কিছুই বের হয়নি। কুরআন সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, ‘তিনি মনগড়া কিছু বলেন না।’ উম্মে মাবাদ তাঁর প্রসংশায় বলেছেন, তাঁর কথা যেন মুক্তোর মতো। প্রয়োজনের চেয়ে কথা বেশীও বলতেন না, কমও বলতেন না। অশোভন, অশ্লীল ও নির্লজ্জ ধরনের কথাবার্তাকে ঘৃণা করতেন। কথাবার্তার সাথে সাধারণত একটি মুচকি হাসি উপহার দিতেন।
তিনি নিখিল বিশ্বের নবী রাসুল ও নেতা ছিলেন। প্রচার, শিক্ষাদান, সংস্কার ও সংশোধন এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত তৎপরতা চালানোর জন্য তাঁকে জনগণের সাথে যোগাযোগ করাটা ছিল অত্যাবশ্যক। তাই বলে এর বাইরে মানবজীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত অন্যান্য যোগাযোগ তৎপরতা বন্ধ করে দিয়েছিলেন তা নয়। গুরুভার দায়িত্বের বোঝা তাঁর অন্যান্য যোগাযোগে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারেনি। দায়িত্বের কঠিন বোঝা নিয়েও তিনি মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছেন। মানুষের সমস্যাবলির সুষ্ঠু সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। বিপদগ্রস্তদের উদ্ধারে তিনি বড় বড় উদ্যোগ নিয়েছেন। একবার তিনি আবু জেহেলের কাছ থেকে ভিনদেশী পাওনাদারের পাওনা আদায় করে দিয়েছিলেন।
উল্লেখিত কিঞ্চিত ও বিচ্ছিন্ন কয়েকটি উদাহরণ তাঁর বিশাল জীবনের জন্য যৎসামান্যই। আমরা যারা ইসলামী আন্দোলনের নেতা, তাদের সম্পর্কে একটি অভিযোগ শুনতে হয় যে, তারা আন্দোলনের বাইরে অন্যান্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগে খুবই দুর্বল। ঠিক একই ধরণের অভিযোগ রয়েছে আমাদের কতিপয় ইসলামী স্কলার, কবি, সাহিত্যিক বা কোন কোন ইসলামী প্রতিষ্ঠানের কর্তা বা মালিকদের ব্যাপারে। তারা তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্যান্য যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন। যা রাসুলের জীবন চরিতের অনেকটা অসদাচরণ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ