শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

নিয়ন্ত্রণহীন ই-বর্জ্য বাড়াচ্ছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি

ইবরাহীম খলিল : নিয়ন্ত্রণহীন ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কোন শৃঙ্খলা না থাকায় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। এতে করে বাড়ছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। একদিকে ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কোনো আইন বা বিধান নেই। অন্যদিকে নেই কোনো সরকারি উদ্যোগও। নষ্ট হয়ে যাওয়া টেলিভিশন, ফ্রিজ, কম্পিউটার, মোবাইলফোন, বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাতিসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম স্বাস্থ্য ও পরিবেশের নতুন ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণা বলছে, দুই বছর আগেও দেশে দৈনিক গড়ে ৫০০ টনের বেশি ই-বর্জ্য তৈরি হতো। বর্তমানে তা আরও বেড়েছে। কিন্তু এসব বর্জ্য ধ্বংস, রক্ষণাবেক্ষণ বা ব্যবস্থাপনার জন্য দেশে কোনো কাঠামো নেই। নেই আইন কিংবা সচেতনতাও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলেক্ট্রনিক বর্জ্যরে বিষয়টি এখন বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। এর স্বাস্থ্যঝুঁকিও মারাত্মক। এ ক্ষেত্রে এখনই ব্যবস্থা না নিলে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।

আশঙ্কার কথা হলো-দেশের মানুষ প্রতিবছর কী পরিমাণ ইলেক্ট্রনিক পণ্য ব্যবহার করে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত সিরিয়াস মার্কেটিং অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ লিমিটেডের ন্যাশনাল মিডিয়া সার্ভে বলছে, সে সময় দেশে টিভি সেটের সংখ্যা ছিল দুই কোটির কাছাকাছি। বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল মার্চেন্ডাইজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, দেশের মানুষ প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকার ইলেক্ট্রনিক পণ্য ব্যবহার করে। বিটিআরসি হিসাবে, বর্তমানে দেশে ১৩ কোটির বেশি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। 

বাংলাদেশ মোবাইল ফোন বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, গত এক বছরে বৈধপথে আমদানি করা মোবাইল ফোনের সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লাখ। আর অবৈধ পথে এসেছে ৫০ লাখের বেশি। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির হিসেবে প্রতিবছর দেশে ব্যবহৃত ডেস্কটপ, ল্যাপটপ ও ট্যাবলেট কম্পিউটারের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত একেবারেই অব্যবহারযোগ্য হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন ইএসডিও পরিচালিত ই-বর্জ্য: বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র ২০১৪ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে বাতিল হয়ে যাওয়া ই-বর্জ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫১ লাখ মেট্রিক টন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দ্বিগুণ বেড়ে ১ কোটি ১০ লাখ টনে দাঁড়ায়। এর মধ্যে শুধু মুঠোফোন থেকেই তৈরি হয়েছে ৫১ হাজার ৫০০ টন বর্জ্য। আর টেলিভিশন এবং কম্পিউটার বর্জ্য তৈরি হয়েছে যথাক্রমে ৮ লাখ ৬০ হাজার ও ৩৪ হাজার ৪০০ টন। এদিকে বাংলাদেশে জাহাজভাঙা শিল্পের জন্য আমদানি করা প্রতিটি জাহাজে বিভিন্ন প্রকারের বিপুল পরিমাণ অব্যবহৃত বৈদ্যুতিক পণ্য থাকায় এ থেকে তৈরি হওয়া বর্জ্যরে পরিমাণই সর্বাধিক, যা প্রায় ৯০ লাখ মেট্রিক টনের কাছাকাছি। এর বাইরে সিএফএল বাতি, মার্কারি বাতি, থার্মোমিটারসহ নানা প্রকারের চিকিৎসা ও গৃহস্থালি যন্ত্র থেকে তৈরি হওয়া বর্জ্যরে পরিমাণ ২ লাখ ১০ হাজার ৩৩৬ মেট্রিকটন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকায় ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য ফেলার জন্য স্থায়ী কোনো ভাগাড় নেই। হকাররা ময়লা ফেলার স্থান থেকে বাতিল বৈদ্যুতিক পণ্য এনে ভাঙারি দোকানে জড়ো করেন। এগুলোর মতোই রেফ্রিজারেটর, ফটোকপি মেশিন, ওয়াশিং মেশিন, এয়ারকন্ডিশনার, টোস্টার, ডিভিডি প্লেয়ারের মতো বিভিন্ন নিত্য ব্যবহার্য বৈদ্যুতিক পণ্য এক হাজারের বেশি নানা মাত্রার বিষাক্ত ধাতু ও রাসায়নিকের উপস্থিতি রয়েছে। মানবদেহ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এসব ধাতু ও রাসায়নিক হচ্ছে সিসা,সিলিকন, টিন, রেজিন, ফাইবার গ্যাস, ক্যাডমিয়াম, পারদ, জিংক, ক্রোমিয়াম, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতি।

বিষেশজ্ঞরা বলছেন, একটি সিএফএল বাতিতে সাধারণত ৮ থেকে ১০ মিলিগ্রাম মার্কারি গ্যাস আকারে থাকে। ২০১২ সাল পর্যন্ত সরকার প্রায় ৮ কোটি সিএফএল বাতি বিনা মূল্যে বিতরণ করেছে। এখন যার সবই পরিত্যক্ত। সেক্ষেত্রে এ বাতিগুলো থেকে যে গ্যাস নির্গত হয়েছে, তার অধিকাংশই শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্কে পৌঁছেছে। এসব বাতিতে কঠিন আকারে যে সিসা আছে, সেটা মিশে যায় মাটিতে কিংবা পানিতে, যা খাদ্যশৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে পুনরায় মানুষের শরীরে চলে যায়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে মোবাইল ফোন, সিএফএল বাতি এবং কম্পিউটার বর্জ্য থেকে নির্গত বিষাক্ত পদার্থ ও রাসায়নিকেই মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। 

ইলেক্ট্রনিক বর্জ্যরে মধ্যে মারাত্মক ক্ষতিকর পদার্থগুলো হল- সিসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম, বেরিলিয়াম, আর্সেনিক, নাইট্রাস অক্সাইড ও ব্রোমিনযুক্ত অগ্নিনিরোধক দ্রব্য। সিআরটি টেলিভিশন বা কাম্পিউটার মনিটরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর ই-বর্জ্য থাকে। কম্পিউটারের বডি তৈরিতে ব্যবহৃত ব্রোমিনেটেড ফ্লেম রিটারডেন্ট প্লাস্টিক যা মানবদেহের ডিএনএ ধ্বংস করে। এছাড়া সিসাসহ অন্যান্য উপাদানের ক্ষতিও কম না। বিভিন্ন যন্ত্রে ব্যবহৃত ক্যাডমিয়াম কিডনির মার্কারি ও মস্তিষ্কের কোষের জন্য ক্ষতিকর। কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় সিলভার, সিলিকন, তেজস্ত্রিয় পদার্থসহ নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ।

ঢাকার রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, গৃহস্থালি বর্জ্য থেকে ই-বর্জ্যরে ক্ষতির মাত্রাটা অনেক বেশি। অপচনশীল এসব বর্জ্যের ধাতু এবং রাসায়নিক যেমন মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে, তেমনি এর প্রধান শিকার হয় গর্ভবতী নারী ও শিশুরা। এগুলোর কারণে ক্রনিক ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, কিডনি ও লিভারের বিভিন্ন সমস্যা এবং মস্তিষ্ক ও রক্তনালির বিভিন্ন রোগও হতে পারে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সাবেক সভাপতি মোস্তফা জব্বার বলেন, ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দেশে কোনো আইন ও নীতিমালা নেই। এ বিষয়ে কারো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। যে কারণে ভবিষ্যতে এর এক ভয়াবহতা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ