মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

পাঁচবার শিরোপা জিতলো খুলনা বিভাগ

আব্দুর রাজ্জাক রানা : জাতীয় ক্রিকেট লীগের ১৮তম পর্বের পর্দা নেমেছে। লংগার ভার্সনের এই টুর্নামেন্ট শেষ হয়েছে গত শুক্রবার। এ টুর্নামেন্টে টানা দ্বিতীয় শিরোপা জিতেছে খুলনা বিভাগ। এ নিয়ে মোট পাঁচ বার জাতীয় ক্রিকেট লীগের শিরোপা জিতলো তারা। একদিন আগেই তারা জয় উল্লাসে মাতে। পুরো লীগে অসাধারণ পারফর্ম করে খুলনা বিভাগ। এর আগে ২০০২-০৩, ২০০৭-০৮, ২০১২-১৩ ও ২০১৫-১৬ মওসুমে জাতীয় লীগের শিরোপা ঘরে তুলেছিল খুলনা। এই শিরোপায় বড় অবদান দলের দুই গুরু ইমদাদুল বাশার রিপন ও মনোয়ার আলী মনুর। সর্বশেষ তিন মওসুমে দলের সাথে মূল কোচের দায়িত্ব পালন করছেন ইমদাদুল বাশার রিপন। প্রথমবারে তার হাত ধরে রানার্স আপ হয় খুলনা বিভাগ। আর পরের দুইবারই দলকে চ্যাম্পিয়ন করেন তিনি। সমান কৃতিত্ব দলের সহকারি কোচ মনোয়ার আলী মনুর। এই সহকারী দলের সাথে টানা পাঁচ মওসুম। ১৪তম আসরে প্রথম দায়িত্ব নিয়ে সেবারই দলকে শিরোপা এনে দেয়ার ভাগিদার তিনি। দলের কোচ রিপন শিরোপা জয়ে খেলোয়াড়দেরই পুরো কৃতিত্ব দিলেন। পাশাপাশি খুলনার টিম স্পিরিট, ড্রেসিং রুমের শৃঙ্খলতা ও ক্রিকেটারদের আন্তরিকতা দলকে অনেকটা এগিয়ে রেখেছে বলে জানান তিনি। একই রকম মন্তব্য করেন সহকারী কোচ মনোয়ার আলী মনুও। খুলনার শিরোপা জয়ে কোচদের ভূমিকা আছে জানিয়ে মূল কোচ রিপন বলেন, আসল কৃতিত্ব খেলোয়াড়দেরই। মাঠে খেলাটা আসলে তাদেরই খেলতে হয়। খুলনার টিম স্পিরিট সব সময়ই খুব ভালো। দলের সিনিয়র বা জুনিয়র ক্রিকেটার সবাই একই রকম থাকেন। নতুন কোন খেলোয়াড় দলে আসলে তাকে আলাদা চোখে দেয়া হয় না। তেমনি দলের সিনিয়র ক্রিকেটাররাও কখনও নিজেদেরকে আলাদা করে ভাবেন না। যে কোন দলের এই স্পিরিটই দলকে এগিয়ে রাখবে। প্রতিটি ক্রিকেটারই খেলার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। এই আন্তরিকতাই খুলনার শিরোপা জয়ে এটা সবথেকে বেশী কাজ করেছে। খুলনার শিরোপা জয়ে ক্রিকেটারদেরই কৃতিত্ব আগেই জানিয়েছিলেন, তবু আলাদা করে কারও নাম বলতে চান কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, তুষার ইমরান ধারাবাহিকবাবে ভালো পারফর্ম করেছে। এনামুল হক বিজয়ও নিয়মিত রানে ছিলেন। অধিনায়ক আব্দুর রাজ্জাকের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। নতুন হিসেবে হাসানুজ্জামান ভালো করেছেন। বোলিংয়ে আল আমিন-আশিক ও আব্দুর রাজ্জাকের কথা স্বীকার করতে হবে। খুলনা দলে সব সময়ের একটি সমস্যা নিয়মিত খেলোয়াড়দের ছেড়ে দিতে হয়। জাতীয় দল, ‘এ’ দল বা হাই পারফরমেন্স যে কোন দল ব্যাস্ত হয়ে পড়লে সবথেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় খুলনা। তবে আমাদের পাইপ লাইন এতই ভালো যে, এর খুব একটা প্রভাব আমরা পড়তে দেই না। নিজের অনুভুতি প্রকাশ করতে গিয়ে কোচ রিপন বলেন, দলের এমন সাফল্যে আমি দারুণ খুশী। নতুন বছরটা চ্যাম্পিয়ন দিয়ে শুরু করতে পারলাম। টানা দুই মওসুম খুলনার শিরোপার ভাগিদার হতে পেরে নিজেকে গর্বিতও মনে করছেন তিনি। উল্লেখ্য, ইমদাদুল বাশার রিপন এ মওসুমে বিপিএল-এ খুলনা টাইটান্সেরও সহকারী কোচ ছিলেন। সেখানেও দলকে সেরা চারে নিয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়া ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে ভিক্টোরিয়ার কোচ তিনি। বিসিবি’র গেম ডেভলেপমেন্টে খুলনা বিভাগ উত্তরের দায়িত্বও তার হাতে। এদিকে আরেক কোচ মনোয়ার আলী মনু খুলনার সাফল্যে নিজেকে অংশীদার মনে করেন। নিজের অনুভূতিতে তিনি বলেন, দলের সাফল্যই তার কাছে বড়। ক্রিকেটাররা মাঠে সেরাটা দিয়েছে। আমরা তাদেরকে গাইডের কাজ করেছি।  উলে¬খ্য, মনু টানা পাঁচ মওসুম জাতীয় লীগে খুলনা বিভাগীয় দলের সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করছেন। এর পাশপাশি বিসিবি’র গেম ডেভলেপমেন্টের খুলনা দক্ষিণের কোচ তিনি। এছাড়া ৭ বছর জেলার কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন। বয়স ভিত্তিক বিভিন্ন দলের সিলেকটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
গত ৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ফতুল্লার খান সাহেব আলী ওসমানী স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ ও শেষ রাউন্ডের ম্যাচে ঢাকা মেট্রোকে ৩৯৮ রানের বড় ব্যবধানে পরাজিত করে শিরোপা নিশ্চিত করে খান আব্দুর রাজ্জাকের দল। টানা দ্বিতীয় শিরোপা জয়ের পথে বড় চ্যালেঞ্জ পার করতে হয়েছে এ দলকে। বৃষ্টি বাঁধায় প্রথম তিনটি ম্যাচে জয়ের মুখ দেখতে পারেনি খুলনা। শুধু জয় দেখেনি তাই না, কোন বোনাস পয়েন্টও পেতে পারেনি। তবে শেষ তিন রাউন্ডে স্বরূপে জ্বলে ওঠে খুলনা। পরের তিন ম্যাচের দু’টিতে সরাসারি জয় পায়, পাশাপাশি বোনাস পয়েন্টও পায় তারা। ফলে শেষ রাউন্ডে একদিন বাকি থাকতেই আবারও শিরোপা উৎসবে মেতে উঠে খুলনার ক্রিকেটাররা। তবে এ শিরোপা জয়ের পথ খুব একটা সহজ ছিল না খুলনার। শুরু থেকেই জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা ছিলেন না দলে। যারা দলে ছিলেন তারাও বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দলের ক্যাম্পে থেকে দলের বাইরে ছিলেন। এসবের পরেও শিরেপা অক্ষুন্ন রাখে খুলনা। খুলনার শিরোপা জয়ে অনেকখানি কৃতিত্ব এক সময়ের জাতীয় দলের তারকা খেলোয়াড় তুষার ইমরানের। খুলনাকে শিরোপা এনে দিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তিনি। ৬ ম্যাচে এ ওপেনার ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছেন সর্বসাকুল্যে ৭ ইনিংস। আর তাতেই ৫১৮ রান করেন তিনি। মোট তিনটি শতক আছে তার এই ৭ ইনিংসে। আছে একটি অর্ধশতকও। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ায় এনামুল হক বিজয়ের সামনে জাতীয় লিগ বাদে প্রমাণের কিছুই ছিল না। আর সে যাত্রায় অনেকটাই সফল এই ওপেনার। প্রথম দুই ম্যাচে তেমন কিছু করতে না পারলেও পরের দিকে নিজেকে চিনিয়েছেন। জানিয়েছেন এখনও তাকে নিয়ে ভাববার সময় শেষ হয়ে যায়নি। ৬ ম্যাচে ৮ ইনিংস ব্যাট করে খুলনার এই ব্যাটসম্যান করেছেন ৪৫১ রান। শিরোপা জয়ের ম্যাচসহ তার রয়েছে দুইটি শতক। শেষ রাউন্ডে জিতেছেন ম্যাচ সেরার পুরস্কারও।
প্রথমদিকে খুলনাকে অনেকটা এগিয়ে নিয়েছেন তরুণ উদীয়মান ব্যাটসম্যান মেহেদী হাসান। ৬ ম্যাচে তার থেকে খুলনা পেয়েছে ২২৭ রান। মূলত বোলার হলেও লিগের প্রথম রাউন্ডে নিশ্চিত হারতে থাকা ম্যাচ বাঁচিয়েছিলেন খুলনার অধিনায়ক আব্দুর রাজ্জাক। বরিশালের বিপক্ষে খুলনায় অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচে ৯৭ রানের এক ঝকঝকে ইনিংস খেলেন তিনি। ব্যাট হাতে শেষ রাউন্ডের প্রথম ইনিংসেও হাল ধরেছিলেন তিনি।
খুলনার শিরোপায় শুধু ব্যাটসম্যানরা নয়, সমান ভূমিকা রেখেছেন বোলাররাও। বারবার জাতীয় দল থেকে ভাগ্য ফেরা আল আমিন দারুণ বোলিং করে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। শিরোপা জয়ের ম্যাচেতো একাই গুড়িয়ে দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোকে। দ্বিতীয় ইনিংসে খুলনাকে ১১০ রানে অলআউট করতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তিনি। প্রতিযোগিতার শুরুতে খুলনার হয়ে খেললেও ইংল্যান্ড সিরিজ চলাকালে জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পান এই পেসার। ফলে দু’টি ম্যাচ খেলতে পারেননি তিনি। তবে মাত্র ৪ ম্যাচ খেলেই খুলনার হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক তিনি। ৪ ম্যাচে নিয়েছেন ২৩টি উইকেট। শেষ ম্যাচে ৯ উইকেটসহ সাফল্য পেয়েছেন অনেকটা ধারাবাহিকভাবেই।
সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রহের তালিকায় সব সময় উপরের দিকে থাকা খুলনার অধিনায়ক আব্দুর রাজ্জাক এবার একটু পিছিয়ে থাকলেও প্রয়োজনের সময় জ্বলে ওঠেন তিনি। মাঝে একটি ম্যাচ খেলতে পারেননি ইনজুরির কারণে। ৫ ম্যাচে ১৮ উইকেট নিয়ে খুলনাকে শিরোপা এনে দেয়ার অন্যতম কৃতিত্ব তার।
হঠাৎ আবিষ্কার আশিকুজ্জামানেরও অনেকটা অবদান রয়েছে খুলনার শিরেপায়। চতুর্থ রাউন্ডের ম্যাচে পেসার সংকটে কোচ ইমদাদুল বাশার রিপনের পছন্দে দলে জায়গা পান সাতক্ষীরার ছেলে আশিক। এসেই বাজিমাত করেন তিনি। প্রথম ম্যাচেই দুই ইনিংসে নেন ৯ উইকেট। এই সাফল্যের ধারাবাহিকতা ছিল তার পরের দুই রাউন্ডের ম্যাচেও। মোট তিনটি ম্যাচ খেলে ১৬টি উইকেট নেন তিনি।
ম্যাচের তৃতীয় দিনে ৫০৯ রানের বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে খুলনার বিপক্ষে মাত্র ১১০ রানে ঢাকা মেট্রো অল আউট হয়ে গেলে বড় জয়ের পাশাপাশি শিরোপাও নিশ্চিত হয় খুলনার। এ জয়ের ফলে ৬ ম্যাচ থেকে দু’টি জয় ও ৪টি ড্র করে ৫৮ পয়েন্ট নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলো খুলনা। অপর ভেন্যুতে বরিশালের বিপক্ষে জয় পেলেও খুলনাকে ধরা হবে না ঢাকা বিভাগের।
এদিকে এ ম্যাচে হারের ফলে জাতীয় লীগের প্রথম স্তর থেকে নেমে গেলো ঢাকা মেট্রো। এ নিয়ে টানা দ্বিতীয়বার ও মোট পঞ্চম শিরোপা অর্জন করে খুলনা বিভাগ। আগের দিন ৩ উইকেটে ২৭২ রান থেকে শুরু করে এদিন আরও ২ উইকেট হারিয়ে ১৫১ রান যোগ করে দ্বিতীয় ইনিংসে মোট ৪২৩ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে খুলনা। ৭৩ রানে অপরাজিত থাকা তুষার ইমরান এদিন শতকের দেখা পান। তার ব্যাটে যোগ হয় দলের সর্বোচ্চ ১৩৮ রান। ১৬৯ বলে ১৪টি বাউন্ডারি ও ৩টি ওভার বাউন্ডারির সাহায্যে এ রান করেন। অর্ধশতের দেখা পান অপর অপরাজিত ব্যাটসম্যান মোহাম্মাদ মিথুনও। ৫৮ বলে ৫টি বাউন্ডারির সাহায্যে ৫০ রান করে আউট হন তিনি। শেষদিকে জিয়াউর রহমান ১৭ ও নাহিদ ১৩ রান করেন।
এর আগে খুলনার হয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরি করেন এনামুল হক বিজয়। ১৫৩ বলে ১২টি বাউন্ডারি ও ৫টি ওভার বাউন্ডারির সাহায্যে ১২২ রান করেন জাতীয় দলের সাবেক এই তারকা ব্যাটসম্যান। এছাড়া হাসানুজ্জামান ৫৫ রান করেন। ঢাকা মেট্রোর হয়ে একটি করে উইকেট নেন আবু হায়দার, ডলার মাহমুদ, আরাফাত সানি, শরীফুল্লাহ ও মেহরাব জুনিয়র। ৫০৯ রানের বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরু থেকেই খুলনার বোলারদের তোপের মুখে পড়ে ঢাকা মেট্রো। শেষ পর্যন্ত মাত্র ১১০ রানেই গুটিয়ে যায় তারা। খুলনার বোলারদের সামনে মেট্রোর কোন ব্যাটসম্যানই প্রতিরোধ গড়তে পারেননি। খুলনার বোলারদের সামনে মেট্রোর কোন ব্যাটসম্যানই প্রতিরোধ গড়তে পারেন নি। শুরু থেকেই নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারায় তারা। দলীয় ১৬ রানে প্রথম উইকেট হারায় তারা। এরপর একে একে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে ঢাকার অন্য ব্যাটসম্যানদেরও প্যাভিলিয়নে পাঠান খুলনার বোলাররা। দলের হয়ে সর্বোচ্চ ২৯ রান করেন মার্শাল আইয়ুব। এছাড়া জাবিদ হাসান করেন ২০ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে বিধ্বংসী বোলিং করে খুলনার জয়কে সহজ করেন জাতীয় দলে উপেক্ষিত পেস বোলার আল আমিন। মাত্র ৪১ রান খরচায় প্রতিপক্ষের ৬ ব্যাটসম্যানকে একাই প্যাভিলিয়নের পথ চিনিয়েছেন তিনি।
এছাড়া অধিনায়ক আব্দুর রাজ্জাক ৩টি ও আশিকুজ্জামান অপর উইকেটটি নেন। এর আগে টসে জিতে ম্যাচের প্রথম দিন আগে ব্যাট করে খুলনা প্রথম ইনিংসে মাত্র ২০৭ রান করে অল আউট হয়ে যায়। প্রথম ইনিংসে খুলনার হয়ে সর্বোচ্চ ৬২ রান করেন এনামুল হক বিজয়। ঢাকা মেট্রোর ডলার মাহমুদ ৫ উইকেট নেন। জবাবে প্রথম ইনিংসে ঢাকা মেট্রো মাত্র ১২২ রানে অল আউট হয়ে যায়। দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৩৮ রান করেন শরীফুল্লাহ। খুলনার হয়ে আল আমিন, আশিকুজ্জামান ও আব্দুর রাজ্জাক তিনটি করে উইকেট নেন। দুই ইনিংসে ৯ উইকেট নেওয়ায় ও সেঞ্চুরি ও হাফ সেঞ্চুরি করায় ম্যাচ সেরার পুরস্কার ভাগাভাগি করে নেন আল আমিন ও এনামুল হক বিজয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ