শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

হরতাল চলাকালে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ॥ সাংবাদিক নির্যাতন

স্টাফ রিপোর্টার : বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধের দাবিতে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকা হরতাল চলাকালে শাহবাগে পুলিশের সঙ্গে পিকেটারদের ব্যাপক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। এ সময় পুলিশ হরতালকারীদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে। পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় আহত হয়েছেন সাতজন। হরতাল চলাকালে দুই সাংবাদিককে বেধড়ক পিটিয়ে পুলিশ। এ ঘটনায় শাহবাগ থানার এক এসআইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ দিকে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে আগামীকাল শনিবার ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি। ২৫ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে রাজপথে অবস্থান কর্মসূচির পর ১১ মার্চ খুলনা মহানগরীতে ‘উপকূলীয় মানুষদের নিয়ে’ সমাবেশের কর্মসূচিও দিয়েছে তারা। সরকারের নৈতিকতার পরাজয় হয়েছে উল্লেখ করে জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব আনু মুহাম্মদ বলেছেন, সরকার আমাদের ওপর সহিংস হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে, সরকারের কথায় কেউ বিশ্বাস করে না, তাই সরকার সহিংস হয়েছে।
সুন্দরবনের পাশে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার দাবিতে গতকাল ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালন করে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। গত ২৬ নবেম্বর শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে এ কর্মসূচি ডাকা হয়েছিল। জাতীয় কমিটির ডাকা হরতাল কর্মসূচিতে সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। এর বাইরে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, ছাত্রদলসহ কয়েকটি সংগঠন বিবৃতি দিয়ে সমর্থন জানিয়েছে। গত বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সবাইকে হরতাল পালনের আহ্বান জানান। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত সাত বছর ধরে সুন্দরবন বিনাশী রামপাল কয়লা প্রকল্প বাতিলসহ বিদ্যুৎ ও গ্যাস সমস্যা সমাধানের জন্য সাত দফা বাস্তবায়নে আমরা লংমার্চ, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ, মহাসমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করছি। কিন্তু সরকার এই প্রকল্প বাতিল না করে উল্টো সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর নানা তৎপরতা চালাচ্ছে। তাই আমরা বাধ্য হয়ে হরতাল পালনের কর্মসূচি দিয়েছি। পথচারী, সাইকেল-রিকশা-ভ্যান, অ্যাম্বুলেন্স, গণমাধ্যমসহ বিদ্যুৎ-ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, কাঁচাবাজার, ওষুধের দোকান হরতালের আওতামুক্ত ছিল।
হরতালের সমর্থনে ভোর থেকে শাহবাগে অবস্থান নেন জাতীয় কমিটির নেতাকর্মীরা। এ সময় পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে ও ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার শেল ও জলকামান নিক্ষেপ করে। জবাবে ইটপাটকেল ছোড়ে হরতাল সমর্থকরা।
শাহবাগ মোড়ের আগে পাবলিক লাইব্রেরি ও চারুকলার সামনে মূলত হরতালকারীরা অবস্থান নেয়। বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্রজোটের নেতাকর্মীরা হরতালের সমর্থনে ওই এলাকায় অবস্থান নেয়। হরতালেকারীদের অভিযোগ ভোর থেকে পিকেটিং শুরু হলে একপর্যায়ে পুলিশ তাদের ওপর চড়াও হয়। হরতাল সমর্থকদের ওপর দফায় দফায় টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। হরতালের পক্ষে মিছিল করার চেষ্টা করা হলে পুলিশ তা ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকা, শাহবাগ, আজিমপুরে সকাল থেকেই হরতালের সমর্থকরা অবস্থান নেন। বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে যান চলাচলে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। হরতালের সমর্থনে বেশ কয়েকটি স্থানে মিছিলও করতে দেখা যায়। তবে এসব এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
ঢাবি ক্যাম্পাস ও তার আশপাশের এলাকায় এবং রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, শাহবাগে বড় দুটি হাসপাতাল রয়েছে। রোগীরা চলাচল করে। এই দুটি রাস্তা আমরা বন্ধ করতে দিতে পারি না। মিছিল করতে করতে হরতালের সমর্থকরা শাহবাগ বন্ধ করতে এসেছিল। আমরা তাদের ফিরিয়ে দিয়েছি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
এ দিকে রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে ‘সুন্দরবন রক্ষার’ দাবিতে রাস্তায় নামা মিছিলে পুলিশের বাধা দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। সকাল সোয়া ৯টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। পরে হরতাল সমর্থকরা রাস্তার পাশে সমাবেশ করেন। মিছিলকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে। পুলিশের বাধার মুখে পরে হরতাল সমর্থকরা সরে গিয়ে সমাবেশ করতে বাধ্য হন।
এ ছাড়া রাজধানীর মোহাম্মদপুর, পল্টন, মিরপুর-১, মিরপুর-১০, সায়েদাবাদ, পোস্তগোলা, লালবাগ, তেজগাঁও ও আজিমপুর এলাকায় হরতাল সমর্থনে মিছিল শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে।
সকাল থেকে রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকার বিভিন্ন সড়কে হরতাল সমর্থকরা মিছিল নিয়ে বিভিন্ন সড়ক ঘুড়ে বেড়ায়। পল্টন মোড়ে জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেন, বাধ্য হয়ে হরতাল কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। সরকার যদি জনগণের কথা ভেবে আমাদের যুক্তিতর্ক বোঝার চেষ্টা করত, তাহলে হরতাল দেয়া দরকার হতো না।
হরতালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে পুলিশের রমনা জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) শিবলী নোমান বলেন, গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
হরতালে পুলিশের হামলায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফারজানা জানান, পুলিশের অতর্কিত হামলায় লাকী আক্তার ছাড়াও লাবণী ম-ল, উম্মে হাবিবা বেনজীর, রায়হান, নাসির, কাঁকনসহ সাতজন আহত হন।
আহত কয়েকজন জানায়, রামপালের ঘটনায় পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী তাঁরা শাহবাগে অবস্থান নেন। হরতাল চলাকালে পুলিশ তাঁদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এ সময় ওই এলাকা ত্যাগের সময় তারাসহ অনেকেই আহত হন।
দুই সাংবাদিককে মারধর : বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের ক্যামেরা পারসন আব্দুল আলীম ও রিপোর্টার এহসান বিন দিদারকে শাহবাগ থানার সামনে মারধর করার ঘটনায় শাহবাগ থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) এরশাদকে সাসপেন্ড (সাময়িক বরখাস্ত) করা হয়েছে। রাজধানীতে হরতালপালনকারী দুই জনকে আটক করে পুলিশ। এই ফুটেজ নেয়ার সময় এটিএন নিউজের দুই সাংবাদিককে মারধর করে পুলিশের ১৫-২০ জন সদস্য।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, সাংবাদিক মারধরের ঘটনায় একজন পুলিশ সদস্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি শাহবাগ থানার এএসআই এরশাদ। ছবিতে তাকে মারধর করতে দেখা গেছে। তিনি আরও বলেন, চিহ্নিত এএসআইকে সাসপেন্ড করা হচ্ছে। এই ঘটনার সঙ্গে আরও যারা জড়িত তাদেরও চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। ঘটনাটি ইচ্ছাকৃত কিনা তা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, ভুল বোঝাবুঝির কারণে এটা হয়েছে। তবে অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।
এটিএন নিউজের অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ প্রভাষ আমিন তার ফেসবুকে এক পোস্টে এ ঘটনা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘পুলিশ হরতাল সমর্থকদের পেটাচ্ছিল। তার ছবি তুলছিলেন এটিএন নিউজের ক্যামেরাপারসন আব্দুল আলিম। এ অপরাধে পুলিশ শাহবাগ থানার ভেতরে নিয়ে তাকে পেটাতে থাকে। বাধা দিতে গেলে রিপোর্টার ইশান দিদারকেও পিটিয়েছে পুলিশ। ২০/৩০ জন পুলিশ মিলে এই দুই সাংবাদিককে বেধড়ক পিটিয়েছে। এখন তাদের ঢাকা মেডিক্যালে নেয়া হয়েছে। আলিমের আঘাত গুরুতর, ইশানের আঘাতও কম নয়। আমাদের ক্যামেরাম্যান বা রিপোর্টার যদি বেআইনি কিছু করে থাকে, পুলিশ তাদের আটক করতে পারত। এমনও নয় রাস্তায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মাঝখানে পড়ে তারা মার খেয়েছে। ঠা-া মাথায় থানার ভেতরে নিয়ে ২০/৩০ জন মিলে ২ জন নিরস্ত্র সাংবাদিককে পিটিয়েছে। কেন? এই প্রশ্নের জবাব অবশ্যই চাই। শুধু লোক দেখানো ক্লোজ নয়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। সাংবাদিক নেতা ও সহকর্মীদের অনুরোধ জানাচ্ছি শাহবাগ থানায় গিয়ে এই প্রশ্নের জবাব চান। সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধ করুন।’
হরতাল-সমর্থকদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদ: রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাতিলের দাবিতে হরতাল-সমর্থকদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে আগামীকাল শনিবার রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করা হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রেসক্লাবের সামনে এক বিক্ষোভ সমাবেশে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। হরতাল শেষে প্রেসক্লাবে আনু মুহাম্মদ বলেন, ২৫ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ ‘সুন্দরবনবিনাশী’ সব প্রকল্প বাতিলের দাবিতে রাজপথে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে জাতীয় কমিটি। এছাড়া ১১ মার্চ খুলনা মহানগরীতে ‘উপকূলীয় মানুষদের নিয়ে’ মহাসমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে। ফেব্রুয়ারিতেই রামপাল প্রকল্পের অর্থনৈতিক চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার কথা। সুন্দরবনের কাছে হওয়ার কারণ দেখিয়ে শুরু থেকেই এ কেন্দ্রটির বিরোধিতা করছে বামপন্থী কয়েকটি সংগঠন।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে ইউনেস্কোঘোষিত বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রতিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে বলে প্রথম থেকে এর বিরোধিতা করে আসছেন পরিবেশবাদীরা। তবে সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী এর আগেও বিভিন্ন বক্তব্যে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলেছেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। শুরু থেকেই এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী আন্দোলনে রয়েছে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ