শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

মিস্টার চ্যাং-এর ঢাকা সফর

আশরাফ জামান : এক.
চ্যাং ভাবে, মাকে না জানিয়ে একদিন ওদের আস্তানা থেকে বেরিয়ে পড়বে। উদ্দেশ্য একজনার পথে বেরুবে যেখানে কোন বাধা বিঘ্ন নেই। মায়ের শাসন আর অনেকগুলো ভাইবোনের ঘ্যানঘ্যানানি ওর ভালো লাগে না। তাছাড়া ভালো লাগে না বন্ধ একটা নর্দমায় এভাবে মাসের পর মাস পড়ে থাকা। মানুষে বলে কুগের ব্যাঙ নাকি বাইরের দুনিয়ার খবর রাখে না। তাই কুয়োর ব্যাঙ হয়ে বসে থাকতে চায় না।
স্বাধীনতা প্রিয় চ্যাং বসে থাকার জন্য জন্ম নেয়নি। মাকে বলতে গেলে নানা বাধা নানা বিপত্তি। তাছাড়া ব্যাঙরা মাছের মতই শত শত বাচ্চার মাঝে একটা হারিয়ে গেলে কেউ তার খবরই রাখে না। সুবর্ণ তলি নামের ছোট্ট একটি গ্রামের পচা একটা ডোবায় চ্যাংয়ের জন্ম। যে ডোবাতে সারা বছর পানি থাকে না। বিষ্টিত বন্যার সময় পানি জমে আর তা অন্তত: মাস খানেক থাকে। কৃখস পার্টি কেটে এখানে ভিজিয়ে রাখে। পাট পচে গিয়ে এমন দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয় যা সহ্য করতে কষ্ট হয় চ্যাংয়ের তাছাড়া আছে, শ্রুত সাফের উপদ্রব।
সুবর্ণ তলি গ্রাম নানাগুণে সমৃদ্ধ। ওর ডোবার পাশে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। যেখানে প্রায়ই শিশুকিশোর ছেলেমেয়েদের পড়তে দেখে চ্যাং। পড়াশুনা খুব ভালো লাগে চ্যাংয়ের। মাকে না জানিয়ে মাঝে মাঝেই সে স্কুলের ক্লাসরুমে গিয়ে মাস্টার সাহেবের চেয়ারের নিচে গিয়ে বসে বসে শুনতো।
ছেলেমেয়েরা সমন্বয়ে কি সুন্দর করে পড়ছে অ, আ, ই, ঈ, ও শব্দ করছে নিজের ভাষায়। অবশ্য শব্দ করতে গিয়ে দুষ্ট ছেলেদের নজরে পড়েছে। এক দিন দু-তিনটি ছেলে ওর ঘ্যাকো শব্দ শুনে দৌড়ে চাইলো। কিন্তু কি করে পারবে তাদের সঙ্গে। ক্লাসে শিক্ষক সাহেব ছিলেন, তিনি ধমক দিয়ে ফেরালেন ছেলেদের। বাঁচলো চ্যাং।
এরপর চ্যাং অন্য পলিসি নিল। কিছু পড়াশুনা তাকে শিকতে হবে। স্কুলে যেতে হবে সম্পূর্ণ নিঃশব্দে যেন সে নিজেও শব্দ না পায়। আর কোন মতেই তার পৈতৃক কণ্ঠটি প্রকাশ করা যাবে না।
কুনো ব্যাঙেরা যেভাবে চুপচাপ মরার মত ঘরের কোনে পড়ে থাকে তাকেও তাই করতে হবে। চ্যাং তাই করলো। স্কুলের নেশা তাকে পেয়ে বসলো, মনুষ্য জগতের পড়াশুনা সে রপ্ত করার চেষ্টা শুরু করলো। প্রতিদিন চ্যাং যায় ছেলে-মেয়েরা ক্লাসে ঢুকার আগে। চুপচাপ বসে থাকে রুমের এক পাশে হয়তো বেঞ্চের আড়ালে অথবা বেড়া ঘেসে। যতটা সম্ভব নিরাপদ দূরত্ব থেকে শিক্ষকের পাঠদান ও ছাত্রছাত্রীদের পড়া সে মনোযোগ দিয়ে শুনে। শুনে বুঝবার চেষ্টা করে।
এমনিভাবে দিনের পর দিন যায়। চ্যাং সকলের আড়ালে থেকেও পড়তে শিখে মানুষের কথা বুঝতে শিখে। সে শুনেছে এ দেশের নাম বাংলাদেশ। এদেশের মানুষ যে ভাষায় কথা বলে তার নাম বাংলা ভাষা। মানুষেরা তাই বাঙালি। চ্যাং নিজেকে প্রশ্ন করে আমি তো এ দেশেই জন্মগ্রহণ করেছি। আমার মা-বাবা সকলেই তো এদেশেই জন্মেছে তাহলে আমি নিজেও কি বাঙালি?
প্রশ্নের জবাব সে পায়নি। তার জবাব তার মা দিতে পারেনি। মানুষের যেরূপ দেশের প্রতি ভালোবাসা আছে তারও তো আছে।
শিক্ষক সাহেব একদিন পড়ালেন ছেলেমেয়েদের ‘আমি হক সকাল বেলার পাখি’
চ্যাং ভাবলো ওটা নিছক পড়া। মানুষ কখনো পাখি হতে পারবে না আর সেও হতে পারবেনা মানুষ। কিন্তু তবু তার সাধ জাগে, যদি সে মানুষ হতে পারতো?
শিক্ষক সাহেব ক্লামে পড়ান ‘মানুষ মানুষের ভাই, মানুষ মানুষেরই জন্য।
চ্যাংভারে কি সুন্দর কথা। মানুষে মানুষে ভাই ভাই সম্পর্ক। মানুষ নাকি মানুষের জন্যই। কি দুর্ভাগ্য সে ব্যাঙ কূলে জন্ম গ্রহণ করেছে। যেখানে শুধু হিংসা আর ক্ষুধা। একজনে অন্যজনকে ধরে খেয়ে ফেলে। একটু ছোট প্রাণী পেলে অপরে আস্ত গিলে খায়। তাদের জন্ম যেন শুধু অন্যের গ্রাসের জন্যই।
প্রতিটি জল প্রাণী একে-অপরের শত্রু। সকলের দৃষ্টিতে শুধু হিংস্রতা লোলুপতা অপরণে গ্রাস করার মতলব।
ছোট ছোট মাছ ধরে যায় বড় মাছেরা। কীটপতঙ্গ ছোট ছোট মাছ ধরে খায় ব্যাঙেরা। চ্যাং ভাবে, কি ভয়ানক হিংস্র তার স্বজাতিরা। ছোট্ট ব্যাং পর্যন্ত বড় ভেঙেরা ধরে খায়। এমনকি কোন কোন মায়ে পর্যন্ত তার বাচ্চাকে ধরে খায়। অবশ্য চ্যাংয়ের মা এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র। মা তাকে সত্যিই খুব ভালবাসে।
দুই
গ্রামের নোংরা পরিবেশ ভালো লাগে না চ্যাং-এর। ডোবানালা কাদা শুধু। তাছাড়া স্কুলে সে শিক্ষকের মুখে সুনেছে শহর নাকি খুব ভালো। বিশেষ করে এদেশের রাজধানী ঢাকা মহানগরী নানা সাজে সজ্জিত। চ্যাং-এর মনে সাধ জাগলো সে স্বপ্ন সাধের ঢাকা নগর দেখবে। কিন্তু কি করে তা সম্ভব? সেতো মানুষের মত চলতে পারে না। চেনে না পরিয়ে রাস্তা গাড়ি ঘোড়া কোন কিছু।
চ্যাং-এর ছোট্ট দেহটার দিকে তাকিয়ে খুব রাগ হয় বিধাতার প্রতি। খোদা তাকে এই আকৃতির করে সৃষ্টি করেছেন? সে শুনেছে শিক্ষক স্কুলে ছেলেমেয়েদের বলেছেন, আল্লাহ্তায়ালা মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীব করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন।
কিন্তু তার দোষ কি? কি পাপ করেছে সে? সে ক্ষুদ্র ব্যাঙ যার কোন মূল্য নই। পানিতে অন্য সেসব প্রাণী বাস করে যাদের নাম মাছ তারাও অন্তত: খাদ্য বলে মানুষ আদর যত্ন করে। ওরা তো তাও পায় না।
আবার চ্যাং ভাবে, যাক খাদ্য হলে হয়তো সেকবেই মানুষের কেটে চলে যেতো। অন্তত: জীবনটা কিছুদিন হলেও বাঁচিয় রাখা যাবে।
১৯৮৮ সাল। দেশব্যাপী এক প্রবল বন্যা গ্রাম শহর ছাপিয়ে দিল। যেন নহের বন্যা সে বন্যার তোড়ে ভেসে চললো চ্যাংক অজানার উদ্দেশ্যে। কোথায় কোন দেশে গিয়ে পৌঁছবে সে নিজেও জানে না। তবে তার আশা ছিলো রাজধানী ঢাকা মহানগরীতে যাওয়ার।
পানিতে একাকার হয়ে গেছে গ্রামকে গ্রাম পচা ডোবা ভরে গিয়ে পরিষ্কার, পানি এসেছে। কি সুন্দর তার গন্ধ। আহলাদের সাথে সাঁতার কাটতে থাকে চ্যাং। মা ভাইবোনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বেশ কিছুদিন হয়। তারা কোথায় হারিয়ে গেছে জানে না। ওতে আফসোস নেই।
চ্যাং ভাসতে থাকে। কখনো লম্বা ডুবখানা সাঁতার। এমনিভাবে ভাসতে ভাসতে উঠলো একটি পাকা সড়কে। সে সড়ক দিয়ে প্রতিদিন শত শত বাস, ট্রাক, ট্যাক্সি ঢাকা টাঙ্গাইল আসা যাওয়া করে। রাস্তার এক পাশে গিয়ে দাড়ালো চ্যাং। যেখানে গাড়ি থামে, লোকজন উঠানামা করে। পাশা পাশি দু’তিনটি গাড়ির ভিড়ের জন্য ঢাকাগামী একটি কোচ একটু বেশি সময়ই দাঁড়িয়ে ছিল। এই সুযোগ বাসের ঙঙ দানিতে লাফিয়ে উঠলো চ্যাং। লোক উঠানামার ভিড় এত ছিল যে কেউ খেয়ালই করেনি। তাছাড়া নিচের দিকে তাকায়ই বা কে?
চ্যাং রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গাড়ির লোকজনের ডাকাডাকিতেই বুঝে নিয়েছিল এটাই ঢাকাগামী বাস। তাছাড়া বাস কনডাক্টরের ঢাকার যাত্রীদের জন্য ডাকাডাকি শুনেও সে অনেকটা অনুমান করেছিল যে, এদিক যাবার বাসেই ঢাকা যাওয়া যাবে।
(চলবে)

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ