শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মৃত্যু ও পুরস্কার

সোমবারের এই কলাম লেখার জন্য আজ (রবিবার) অনলাইন নিউজ-এ চোখ রাখতেই শ্রীযুক্ত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাবুর মৃত্যু সংবাদ বিষয়ক খবর দেখতে পেলাম।  একদা মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট ও বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা শ্রীযুক্ত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর মৃত্যু সংবাদ পেলাম ভোরে। যদিও রাত থেকেই অনলাইন ও ফেসবুকে তাঁর মৃত্যুর খবর নিয়ে গুজব তৈরি হয়। সকালে নিশ্চিত খবর জানান তাঁর চিকিৎসক শ্রীযুক্ত ডা. বরেণ চক্রবর্তী। বাংলানিউজ২৪-এর খবরে জানা যায়, শ্রীযুক্ত সেনগুপ্ত বাবু শেষ ইচ্ছা পোষণ করেছেন, তাঁকে যেন চন্দন কাঠ দিয়ে দাহ করা হয়। হিন্দু শাস্ত্রাচার অনুযায়ী তাঁর মরদেহ ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নেওয়া হয় এবং অনেকের সঙ্গে ভারতীয় হাইকমিশনারও গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। একটি সম্প্রদায়ের শীর্ষ স্থানীয় প্রতিনিধি হিসাবে তিনি তাঁর সমর্থকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। যদিও রেলমন্ত্রী থাকাকালে বিরাট আর্থিক কেলেংকারীর ঘটনার পর তিনি দৃশ্যত ¤্রয়িমাণ হয়ে পড়েন। তথাপি সমালোচিত-আলোচিত রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত বাবু জীবনভর নিজের বিশ্বাস ও আদর্শের রাজনীতি একাগ্রতার সঙ্গে প্রতিপালন করেছেন। যখন যে দলেই থাকুন না কেন, নিজের সমর্থক, সম্প্রদায়, আদর্শ ও বিশ্বাসকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে তিনি আপোষহীন ছিলেন।  কোনো ভয়-ভীতি তাঁকে নিজের রাজনৈতিক পথ থেকে টলাতে পারে নি।
সুরঞ্জিত বাবু ছিলেন আওয়ামী লীগে সোভিয়েত-মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের অনুপ্রবেশের অগ্রপথিক ও প্রথম সারির একজন। তিনি এবং মতিয়া চৌধুরী সর্বাগ্রে দল ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তারপর একে একে অনেকেই আসেন। শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ, নূহ-উল আলম লেনিন, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরসহ বহুজন সে পথ অনুসরণ করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ে আসীন হন। প্রায়ই যে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সাবেক কমিউনিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত, সেই ধারার সূচনাকারীও তিনিই। তিনি তাঁর রাজনৈতিক-আদর্শিক আনুগত্যের জন্য আওয়ামী লীগের কাছ থেকে যথাযথভাবে সম্মানিত ও পুরস্কৃত হয়েছেন। তাঁর অনুসারী, সমর্থক ও সম্প্রদায়ও তাঁর অবদানকে অনেক দিন স্মরণ করবে।
পুরস্কার প্রসঙ্গে আরেকটি খবর দেখলাম। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েও নিন্দিত হয়েছেন নিয়াজ জামান নামক একজন অনুবাদক। পুরস্কার পাওয়ার পর বিতর্কের ঝড় ওঠে। বলা হয় নানা কথা। নিয়াজ জামান পুরস্কার প্রদানের দিন উপস্থিত থাকেন নি। জানানো হয় তিনি অসুস্থ। পুরস্কার দেওয়ার আগে সব দিক না দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিণাম হলো এসব বিত-া। পুরো বিষয়টিই এতে বিশ্রী আকার ধারণ করে। পুরস্কারদাতা ও গ্রহীতা উভয়েই এর ফলে অসম্মানিত হয়। পুরস্কার সব সময় যে জীবদ্দশায় দেওয়া হয়, এমন নয়। বহু বিখ্যাতজন জীবিতকালে পুরস্কৃত হন নি। মৃত্যুর পর তাঁদের মেধা ও কৃতিত্বের সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে। আবার অনেক সময় বিরুদ্ধবাদীরা ক্ষমতায় থাকলে যোগ্যদের পুরস্কার দেয় না; পুরস্কৃত করে বশংবদদের। ক্ষমতার বদল হলে প্রকৃত মেধাবী ও যোগ্যরা পুরস্কৃত হয়। ফলে পুরস্কার একটি আপেক্ষিক বিষয়। এর সঙ্গে জড়িত স্থান, কাল, পাত্রসহ নানা বিষয়।
উদাহরণ দেওয়া যায় ব্রিটিশ আমলের। তখন ইংরেজদের দালালি করলে খান বাহাদুর, রায় বাহাদুর, নবাব বাহাদুর, রাজা বাহাদুর ইত্যাদি পদক ও পুরস্কার দেওয়া হতো। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইংরেজদের যারা দালালি করেছিলেন, তারা নিশ্চয় জনগণের বন্ধু ছিলেন না। ইংরেজদের দালালি করতে গিয়ে তারা জনগণের ক্ষতি করেছেন। ফলে সেটা ছিল জনগণের বিরোধিতা করার পুরস্কার। অতএব পুরস্কার শুধু গুণের জন্যই দেওয়া হয় না; দোষের জন্যও দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। পুরো ইংরেজ আমলেই আলেম-ওলামা, ফারায়েজি, ওহাবীদের হত্যা ও জেলে পুরা হয়েছে। বলা হয়েছে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী। পুরস্কার নয়, তিরস্কারই তাদেরকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসল চিত্র কি বলে? উপমহাদেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁরা আন্দোলন করেছিলেন। হাজি শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর লড়েছিলেন কৃষক ও নিপীড়িত মানুষের জন্য। তাদেরকে ইংরেজ পুলিশ ও বশংবদরা আক্রমণ করেছে। মামলা দিয়েছে। হত্যা করেছে। আর পুরস্কৃত করেছে হামলাকারীদের।
কিন্তু তাকে কি হয়েছে? হামলাকারীরা পুরস্কার পেয়ে বিখ্যাত হয়েছে? নাকি জনগণের পক্ষে কাজ করে আক্রান্তরা বিখ্যাত হয়েছেন? ইতিহাসের পাতায় তাকালে উজ্জ্বলতরভাবে মীর নেছার আলী তিতুমীরকে দেখা যায়। বিপ্লবী হাজি শরীয়তুল্লাহকে পাওয়া যায়। কোনো খান বাহাদুর বা রায় বাহাদুরকে দেখা যায় না। জনগণ দালালি করে পদক-পুরস্কার পাওয়াদের মনে রাখে নি। ইংরেজ আমলের মতো আজকেও নানা কারণে এবং নানা সুবিধার জন্য পুরস্কার প্রাপ্তরা দালালির বেতনই পাচ্ছে, জনগণের মনের গভীরের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা মোটেও পাচ্ছে না।
আসলে সম্মান ও পুরস্কার আসে সমাজ ও জনগণের কাজ থেকে। জনগণের বৃহত্তর অংশের স্বার্থে কাজ করার মাধ্যমে। এই পুরস্কারই স্থায়ী এবং অমলিন। দালালির পুরস্কার চমক দেখালেও দীর্ঘস্থায়ী বা আসল সম্মান নয়। কোনো দল বা গোত্র বা সম্প্রদায়ের পক্ষে কাজ করার নামে সমগ্র জাতিসত্তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য যে পুরস্কার, তা আমাদেরকে ইংরেজ আমলের পদক-পুরস্কার বিতরণের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
মৃত্যু নানাভাবে হতে পারে। রোগে, শোকে, দুর্ঘটনায়, লড়াই করে। ন্যায়ের আন্দোলন করে বীর মরে যুদ্ধ ক্ষেত্রে বা ফাঁসির মঞ্চে। এ মৃত্যু সম্মানের অক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়। এজন্যই বলা হয় বীরের মৃত্যু নেই আর কাপুরুষ মরে বার বার। অবধারিত মৃত্যুকে তাই সাহসের সঙ্গেই মোকাবেলা করা দরকার। জনগণের পক্ষে থেকে, দেশ ও জাতির স্বার্থে কাজ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করাও এক মহৎ দৃষ্টান্ত। সমাজ ও মানুষ এক সময় না এক সময় সেই দৃষ্টান্তকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। পুরস্কৃত করে। এবং মাথায় তুলে রাখে। এ কথাটি কেবল অতীতের জন্য প্রযোজ্য নয়। বর্তমানেও সত্য।
সক্রেটিস আড়াই হাজার বছর আগে ন্যায়ের জন্য মৃত্যুকে বরণ করে যেমন স্মরণীয় হয়েছেন; আজকেও যারা ন্যায় ও সত্যের পক্ষে লড়াই করছেন, তারাও সম্মানিত হচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী নানা দেশে সা¤্রাজ্যবাদী গণতান্ত্রিক নেতাদের হত্যা করছে। স্বৈরাচারের হাতে প্রাণ দিচ্ছেন বহুজন। ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে অনেককেই। স্বৈরাচারের এ কুকর্মে যারা সহযোগী, তাদেরকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে।
যেমন মিসরের কথা বলা যায়। গণতান্ত্রিভাবে নির্বাচিত নেতাদের হত্যা ও নির্যাতনের পুরস্কার হিসাবে জেনারেল সিসি’কে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। কিন্তু এই পুরস্কার দালালির এবং নির্মমতার। মানুষ শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে এই পুরস্কারকে স্বীকার করে না। ইতিহাসেও একদিন নির্মমতার পুরস্কার হিসাবে ক্ষমতা প্রাপ্তির বিষয়টি চরম ঘৃণার সঙ্গে চিহ্ণিত হবে। বরং যারা প্রাণ দিয়েছেন মিসরের স্বৈরতন্ত্রের হাতে, তারাই বরং সম্মানিত হবেন।
অতএব যারা দেশে দেশে ন্যায়ের জন্য, আদর্শের জন্য, অন্যায় হামলার শিকার হয়েছেন, জীবন দিয়েছেন, তারা অম্লান হয়েই থাকবেন। স্বৈরাচারের কালো অধ্যায় শেষে জনগণ তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন। কারণ জনগণই প্রকৃত পুরস্কারের দাতা। আর যারা দালালি ও তাঁবেদারির মাধ্যমে স্বৈরাচারের কাছ থেকে পুরস্কার পাচ্ছেন, গোত্র ও সম্প্রদায়ের নামে হানাহানি করছেন, তারা প্রকৃত সম্মান কখনোই পাবেন না। বরং জনগণ একদিন তাদের তথাকথিত পুরস্কার ও সম্মানকে পদদলিত করবে। আজকে কি কেউ রায় বাহাদুর বা খান বাহাদুরকে সম্মান করে? খোদ বাহাদুরগণও কি ইংরেজের দালালির পদক-পুরস্কার নিয়ে সমাজে দাঁড়াতে পারে? না, পারে না। প্রভুর পতনের পর মোসাহেব, দালাল, তাঁবেদার, পুরস্কারপ্রাপ্তরাও পতিত হয়েছে। এটাই ইতিহাসের বিচার। এই বিচার চলমান। এই অমোঘ বিচারের বাইরে এসে কেউই বাগাড়ম্বর করতে পারবে না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ