শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সাহিত্য পাঠে জোর দিতে হবে, ভাষাটাও যাতে শুদ্ধচর্চা হয় -----সোলায়মান আহসান

প্রথম কবে বইমেলায় গিয়েছেন মনে আছে?
উত্তর : ১৯৭৮ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে সিলেট আলীয়া মাদরাসা প্রাঙ্গণে পক্ষকালব্যাপী ‘বইমেলা’র মাধ্যমে এ ধরনের বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। বইয়ের এতো বিশাল সম্ভার দেখে প্রথম দিন আবেগে আপ্লুত হয়েছিলাম। মফস্বল শহরে বাস করে লাইব্রেরীতে যেখানে পাঠ্য বইয়ের ভেতর অপাঠ্য মানে সাহিত্যের বই পাওয়া ছিল দুষ্কর, সেখানে মেলায় হাতের কাছে প্রিয় লেখকদের বই পেয়ে ‘বইপাগল’ মনটা ভীষণ খুশি হয়েছিল সেদিন।
২০১৭ বইমেলায় আপনার কয়টি বই বের হয়েছে?
উত্তর :  এবার বইমেলায় দু’টো প্রকাশ হয়েছে। একটি কিশোর গল্প সংকলন ‘সেই বিজয়ের গল্প’ সিলেট শহর থেকে। হঠাৎ করে সিলেটের একজন তরুণ লেখক এবং শিশু পত্রিকার সম্পাদক আমাকে ফোনে বইয়ের পা-ুলিপি চাইলেন। নতুন প্রকাশক জিবলু রহমান, আমি যাকে চিনি না, তবে তার লেখা পড়েছি। বইটি বিগত বছর একটি প্রতিষ্ঠিত ঢাকার প্রকাশক আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু আঁকায় শিল্পী পাওয়া ছিল দুষ্কর বলে এ বছর তা প্রকাশের অভিপ্রায় জানান। সিলেট থেকে বইটি প্রকাশের ইচ্ছা জানিয়ে তরুণ লেখক যোগাযোগ করায় নিজ জন্মভূমি থেকে একটা বই প্রকাশ পাক-আবেগ আমাকে তাড়িত করেছে।
দ্বিতীয় বইটি আমার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’। প্রকাশিত ৭টি কাব্যগ্রন্থ থেকে বাছাই করা এ সংকলনটি প্রকাশ করেছে ঢাকার প্রকাশক মাতৃভাষা প্রকাশের স্বত্বাধিকারী নেসারউদ্দিন আয়ুব। ১৪ ফর্মার বইটি আমার কাব্যচর্চার এক উৎকৃষ্ট সম্ভার বলা যায়।
বইয়ের বিষয়বস্তু কি?
উত্তর : উল্লিখিত প্রথম বইটি ছোটদের গল্পের। গল্পগুলোর শিশু মনস্তত্বের নানা বিষয় আশয় উঠে এসেছে। এছাড়া আধুনিক জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে বড়রা ছোটদের প্রতি অজান্তে কি অযতœ করে ফেলছেন যা করা উচিত নয়, গল্পে এসব উঠে এসেছে। এছাড়া শিশু মনের সুকুমার বৃত্তির বিকাশে ইতিবাচক দিকগুলোও আছে গল্পে।  আর আমার কাব্যভূবন মূলত মানব জাতিকে কল্যাণের দিকে আহ্বান জানান। মুক্তির জন্য লড়াইয়ে ব্যাপৃত মানুষের প্রতি সমর্থন ও উৎসাহ আমার কাব্য বিষয়। মূলত গোটা বিশ্বে যে আদর্শহীনতায় মানুষের পাশব সত্বার উন্মেষ ঘটছে-এর বিরুদ্ধে এক নীরব দ্রোহ। মূলের দিকে মানবম-লী ফিরে আসার চিরন্তন আহ্বান এ কাব্য সম্ভারের মৌলিক মেসেজ।
বর্তমান মেলার সঙ্গতি-অসঙ্গতি বলুন
উত্তর : পঞ্চাশের শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদ আশির দশকে ঢাকাকে বাঙলা সাহিত্যের রাজধানী দাবি করেছিলেন কুড়ি/পঁচিশ বছরে তা প্রমাণিত। বাঙলা সাহিত্যের চর্চা, লালন, আনন্দ, আহলাদ যা কিছু হয়, বাঙলাদেশেই। আর বছরের একটি মাস ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে বাঙলা একাডেমী আয়োজিত বইমেলাকে ঘিরে যে উপচেপড়া আবেগ, যা স্পর্শ করেছে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী জনতাকেও-এটা আমাদের আত্মশ্লাঘার বিষয় বৈকি! বলতে বলতে মেলার প্রাঙ্গণের চৌহদ্দি বেড়েছে। এতে বইপ্রেমীদের জন্য আরও প্রশস্ত হয়েছে ছড়িয়ে পড়তে। আড্ডা জমাতে, হেঁটে হেঁটে পছন্দের বইটা খুঁজে পেতে।
মেলায় কিছু উপদ্রব লক্ষ্য করা যায়, বখাটে ছেলের দল মেলায় এসে নারী বইপ্রেমীদের উত্ত্যক্ত করতে প্রয়াস পায়। এব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের কিছু করার থাকে। তাছাড়া কিছু কিছু দুর্ঘটনা বিগত সময়ে ঘটার কারণে সন্ধ্যা উতরে গেলে মেলায় আসা লেখক গ্রন্থপ্রেমীরা নিরাপত্তা আশঙ্কায় ভোগেন। হয়তো সামাজিক অবক্ষয়ের সঙ্গে এমনটা হচ্ছে, কিন্তু যাদের দেখার দায়িত্ব এসব তাদের সতর্কতা এড়াতে পারে অনেক কিছুই।
বাংলাভাষার ক্রমবিকাশে আর কী পদক্ষেপ জরুরী বলে মনে করেন?
উত্তর : স্বাধীনতার পর আমরা জাতি হিসেবে অনেক বিষয়ে এগিয়ে গেছি। সাহিত্য-সংস্কৃতি সেই অগ্রগতির ধারায় রয়েছে। আর এসব অগ্রগতি এমনিতে হয়নি। এদেশের মানুষ সীমিত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জন করেছে। দু’একটা বিষয়ে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে ‘ব্র্যান্ড ভেল্যু’ অর্জন করেছি। যেমন, গার্মেন্টস শিল্প এবং মানব-শ্রম বিশ্বব্যাপী আস্থা অর্জন করেছে। এর পেছনে সরকারগুলোর নিরলস সহযোগিতা ও প্রণোদনা না থাকলে এতোটা সফলতা আমরা পেতাম না। ‘বাঙলা ভাষা’ প্রায় ৩০ কোটি মানুষের ভাষা। তাই এর সাহিত্যের ভোক্তাও বিশাল জনগোষ্ঠী। এর একটা বাজার মূল্যও রয়েছে। কিন্তু এব্যাপারে যে পৃষ্ঠপোষকতা থাকা উচিত ছিল, তা আমরা পাচ্ছি না। বরং অনেক ক্ষেত্রে চিত্রটা খুব নেতিবাচক। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাঙলা ভাষা চর্চা, লালন ও বিকাশের দায়িত্ব কাঁধে রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানের, তাদের ভূমিকা খুবই সংকুচিত। অর্থের দিক দিয়ে তো সংকোচ রয়েছেই, মনের দিক থেকেও তারা উদার নন। একটা সংকীর্ণ চিন্ততা, গোষ্ঠীপ্রীতি, তুষ্ট করার স্তাবক ভূমিকা ইত্যাদি উদার সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকছে। প্রতিভাবান যারা তাদের এসব প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত ঘটে কম। আড়ালে থেকে যান এক বিশাল অংশ। তাছাড়া, ঢাকার বাইরের অনেক প্রতিভাবান লেখক সাহিত্যিক এবং তাদের সাহিত্যকর্ম থেকে যায় অপ্রকাশিত প্রায়। এতে আমাদের সাহিত্যের সমৃদ্ধি ঘটছে না, যেভাবে ঘটা উচিত।
তাছাড়া, তথ্য প্রযুক্তির হঠাৎ প্রবেশ, অনুপ্রবেশ আমাদের জেনারেশনকে খানিকটা টালমাটাল করছে বৈকি! বইয়ের চেয়ে মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাপ ইত্যাদি তাদের হাতে শোভা পাচ্ছে। ফলে সাহিত্যের সঙ্গে বিচ্ছেদ তো ঘটছেই ভাষার সঙ্গেও চলছে আড়াআড়ি। ভারসাম্য আনতে হবে দ্রুত। এটা আনতে হলে শিক্ষাদান পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সাহিত্য পাঠে জোর দিতে হবে। ভাষাটাও যাতে শুদ্ধচর্চা হয় সেদিকেও।
এসব যা বললাম, এর প্রায় সিংহ ভাগ দায় সরকারের কাঁধেই বর্তায়। সরকার উদার হয়ে খরচ করছেন কত কিছুতে, এদিকে কবে তারা দৃষ্টি দেবেন?
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : রেদওয়ানুল হক

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ