শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ধুলার নগরীতে ‘ওয়াটার থেরাপি’!

এটা আর মোটেও নতুন খবর নয় যে, রাজধানী ঢাকা অনেক আগেই ধুলার নগরীতে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে জানার জন্য টিভি চ্যানেল বা সংবাদপত্রের সচিত্র রিপোর্টের ওপর নির্ভর করতে হয় না। ঢাকায় যারা বসবাস করেন তারা তো জানেনই, তারাও হাড়ে হাড়ে টের পানÑ বিভিন্ন কাজে যারা কয়েক ঘণ্টার জন্য ঢাকায় এসে থাকেন। বস্তুত উত্তরা-মিরপুর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত বৃহত্তর ঢাকা মহানগরীর এমন কোনো এলাকার নাম বলা যাবে না, যেখানে ঝলমলে আলোর মধ্যেও ধুলায় অন্ধকার না দেখতে হয়। এমন অবস্থার কারণ সম্পর্কেও নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। বছরের পর বছর ধরে নগরীর কোনো না কোনো এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ তো চলছেই, পাশাপাশি চলছে নানা উপলক্ষে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির মহাকর্মও। খোঁড়াখুঁড়ি চলছে মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণের জন্যও। এসব কাজে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয় শুধু নয়, উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও রীতিমতো প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে। 

সবই যেহেতু নগরবাসীর উপকার ও সুবিধার জন্য করা হচ্ছে, সেহেতু সাধারণভাবে আপত্তির কোনো কারণ থাকতে পারে না। অন্যদিকে আপত্তির সঙ্গে প্রতিবাদও জানানো হচ্ছে প্রধানত ধুলা আর নোংরা আবর্জনার কারণে। দেখা যাচ্ছে, খোঁড়াখুঁড়ি করে এবং যার যার মতো পাইপ বসিয়ে দিয়েই সরে পড়ছে সকল সংস্থার ঠিকাদার ও তাদের লোকজন। কেউই মাটি ভরাট করার কাজ করছে না, বরং রাস্তার পাশে মাটি ও আবর্জনার স্তূপ তৈরি করে চলে যাচ্ছে সকলে। তার ওপর আবার একই সড়কের দু’পাশে সিটি করপোরেশেনের ট্রাক এসে টনকে টন আবর্জনা ফেলে যাচ্ছে প্রতিদিন। ফলে দুর্গন্ধের সঙ্গে ধুলার শিকার হতে হচ্ছে মানুষকে। রাজধানী মহানগরীর প্রতিটি এলাকাতেই ধুলা ও দুর্গন্ধের কবল থেকে বাঁচার জন্য মানুষকে আজকাল নাকে কাপড়ের মাস্ক পরে কিংবা অন্য কোনোভাবে নাক ঢেকে চলাচল করতে হচ্ছে। এতেও রেহাই মিলছে না। সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, হাঁপানি এবং চর্মরোগের মতো বিভিন্ন মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের কষ্টের কোনো সীমা থাকছে না। পরিবেশবাদী একাধিক সংগঠনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব অসুখের চিকিৎসার জন্য মধ্য ও নি¤œবিত্তদের প্রতি মাসে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। অর্থাৎ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে মানুষের। তবুও সম্পূর্ণ মুক্তি মিলছে না অসুখের কবল থেকে।  

বিষয়টি অনেক পুরনো হলেও বর্তমান পর্যায়ে কথা ওঠার কারণ সৃষ্টি করেছে একটি আন্তর্জাতিক রিপোর্ট। গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুটি গবেষণা সংস্থার যৌথ জরিপের এই রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। শীর্ষ স্থানটি পেয়েছে ভারতের রাজধানী দিল্লি। ঢাকার পর রয়েছে পাকিস্তানের করাচী এবং চীনের রাজধানী বেইজিং। এসব অবস্থান নির্ধারণ করা হয়েছে বাতাসে ধূলিকণার উপস্থিতির ভিত্তিতে। গবেষণায় দেখা গেছে, দিল্লি ও ঢাকায় ধূলিকণার উপস্থিতির পরিমাণ যথাক্রমে ১২২ এবং ৯০। করাচীতে এই পরিমাণ ৮৮ আর বেইজিংয়ে ৮৫। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। রিপোর্টটিতে বায়ুদূষণের ক্ষতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, বায়ুতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর যেসব উপাদান রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক উপাদানটির নাম পিএম ২.৫। এই উপাদান নির্গত করার ক্ষেত্রেও চীন ও ভারতের পরেই রয়েছে বাংলাদেশ। বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর এক লাখ ২২ হাজার চারশ’জন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন গবেষকরা। একই কারণে শিশুমৃত্যুর হারের দিক থেকে বাংলাদেশ পাকিস্তানের পরের অবস্থানে পৌঁছে গেছে। 

বলার অপেক্ষা রাখে না, আন্তর্জাতিক দুটি সংস্থার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে বলে শুধু নয়, বাস্তব কারণেও রাজধানী ঢাকা মহানগরীর পরিবেশ অত্যন্ত বিপদজনক হয়ে উঠেছে। এমন অবস্থায় দরকার যেখানে ছিল সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে ধুলা ও আবর্জনার কবল থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া, দুই সিটি করপোরেশন সেখানে ‘ওয়াটার থেরাপি’র কার্যক্রম শুরু করেছে। গতকাল প্রকাশিত দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, প্রধান প্রধান কিছু সড়কে ওয়াটার বাউজার নামের পানি পরিবহনে ব্যবহৃত গাড়ি দিয়ে পানি ছিটানো হচ্ছে। এ উদ্দেশ্যে দুই সিটি করপোরেশন রাজধানীকে পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করে একটি রোড ম্যাপ তৈরি করেছে এবং সে ম্যাপ অনুসারেই পানি ছিটানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু খবর হিসেবে আশাব্যঞ্জক মনে হলেও বাস্তবে এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কারণ, বেছে বেছে প্রধান যে কয়েকটি মাত্র সড়কে পানি ছিটানো হচ্ছে সেগুলোর কোনোটিতেই দু-এক ঘণ্টার বেশি পানি থাকছে না। পানি শুকিয়ে যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই। ফলে কমার বা বন্ধ হওয়ার পরিবর্তে ধুলার পরিমাণ বরং বেড়ে যাচ্ছে। 

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, কেবলই হাস্যকর ওয়াটার থেরাপির মাধ্যমে পানি ছিটানো কোনো সুফল আনতে পারে না। এজন্য দরকার ধুলা নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা। দুই সিটি করপোরেশন এবং সরকারের উচিত ঠিকাদারদের জন্য এমন অবশ্যপালনীয় শর্ত জুড়ে দেয়া, তারা যাতে খোঁড়াখুঁড়ির পর প্রতিটি জায়গায় দ্রুত মাটি ভরাট করে এবং কোথাও যাতে মাটি বা অন্য কোনো আবর্জনা জমতে না পারে। প্রতিটি স্থানে ইট বিছিয়ে প্লাস্টার করার কাজও স্বল্প সময়ের মধ্যে করতে হবে। এর ফলে ধুলা সৃষ্টি হতে এবং আবর্জনা জমতে পারবে না। যেখানে-সেখানে যাতে আবর্জনা ফেলা না হয় সে ব্যাপারেও সরকার এবং দুই সিটি করপোরেশনকে কঠোর নজরদারি করতে হবে। পাশাপাশি ব্যবস্থা নিতে হবে পানি ছিটানোর জন্যও। পানি শুধু প্রধান কয়েকটি সড়কে ছিটালে চলবে না, ছিটাতে হবে পুরো রাজধানীতেই। এজন্য রাতের বেলায় সময় নির্ধারণ করতে হবেÑ যেমনটি বিশ্বের সকল বড় বড় শহরে করা হয়। রাস্তা থেকে আবর্জনাও রাতের বেলাতেই সরিয়ে নিতে হবে। 

আমরা আশা করতে চাই, ফ্লাইওভার বা মেট্রোরেলসহ যে কোনো ধরনের কোনো প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু করার আগে সরকার এবং দুই সিটি করপোরেশন ধুলা প্রতিরোধের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন দফতর-অধিদফতরকেও রাজধানীবাসীর স্বাস্থ্যের প্রশ্নে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। বলা দরকার, বছরে এক লাখ ২২ হাজার চারশ’ মানুষের মৃত্যু এবং শিশু মৃত্যুর হারের দিক থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলার খবর লজ্জাকর শুধু নয়, অত্যন্ত ভীতিকরও। এজন্যই পরিবেশের উন্নতি ঘটানোর লক্ষ্যে ধুলার বিস্তার অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। পরিচ্ছনতার অভিযানও চালাতে হবে নিয়মিতভাবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ