বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বাংলায় অন্তঃপ্রাণ উর্দুভাষী জয়নাল শয্যাশায়ী

স্টাফ রিপোর্টার: নিজে উর্দুভাষী হয়েও যিনি বায়ান্নতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছিলেন সোচ্চার, বাংলাদেশের টানে এখানে থেকে গেছেন স্বজনদের ছেড়ে; সেই জয়নাল আবেদীন এখন রোগশয্যায়।
নিভৃতচারী এই সাংবাদিক ৮০ বছর বয়সে এসে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগে এখন যকৃতের জটিলতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
একুশের দিন গতকাল মঙ্গলবার বিকালে বারডেমের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আজাদ খান বিএসএমএমইউতে গিয়ে জয়নাল আবেদীনকে দেখে এসেছেন।
নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকা জয়নাল আবেদীনের অবস্থা ‘ভালো নয়’ বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সাংবাদিক জয়নাল আবেদীন তার পেশার মানুষদের কাছে ‘বিহারী ঝনু’ নামে পরিচিত। সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্যকর্মেও সক্রিয় ছিলেন তিনি; জনপ্রিয় অনেক চলচ্চিত্রের কাহিনীও তার লেখা।
হাসপাতালে নির্জীবের মতো থাকা জয়নাল আবেদীন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের কথা বলতে গেলে এখনও আগের মতোই সজীব হয়ে ওঠেন। বলেন বায়ান্নতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পুরনো ঢাকায় দেওয়ালে দেওয়ালে উর্দু ভাষায় ‘হামারী জবান, বাংলা জবান (আমার ভাষা বাংলা ভাষা)’ স্লোগান লেখার কথা।
একুশ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষার জন্য এ রকম রক্ত দেয়ার ঘটনা বিশ্বে আর কখনও ঘটবে না। এজন্যই সারাবিশ্ব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারিকে বিলম্বে হলেও স্বীকৃতি দিয়েছে। সেইরকম একটি দেশের মানুষের সঙ্গী আমি, এটাই আমার বড় ভাগ্য।’
ভাষায় আন্দোলনের সময় ঢাকা কলেজে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন জয়নাল আবেদীন। তখন ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস ছিল ফুলবাড়িয়ায়। বামপন্থী রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কারণে দেওয়াল লিখনে হাত পাকিয়েছিলেন তিনি তখনই; ঘনিষ্ঠরা তাকে বলতেন- ‘মাস্টার অব ওয়াল রাইটার’।
ভাষা আন্দোলনের সময়কার কথা জানতে চাইলে তিনি ‘হামারি জবান বাংলা জবান (আমার ভাষা বাংলা ভাষা)’, ‘জুলুম ফের জুলুম হ্যায়, বার্তা হ্যায় তো তাবজাদা (জুলুম সেটাই জুলুম যেটা বাড়তে বাড়তে থমকে যায়)’ এসব স্লোগান লেখার কথা জানান।
জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২১ ফেব্রুয়ারির আগে পুলিশ যখন ১৪৪ ধারা জারি করে, তখন একটি বৈঠকে অনেক ভাষা সৈনিকের সঙ্গে তিনিও ছিলেন।
জয়নুল আবেদীনের জন্ম ১৯৩৭ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের রাজধানী এলাহাবাদে; শৈশব কেটেছে বিহারে, যেখানে তার বাবা মুহাম্মদ মোস্তফা ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে হেড ড্রাফটসম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর মোস্তফা পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে যোগ দেন, কর্মস্থল হয় বর্তমান নীলফামারীর সৈয়দপুরে।
সৈয়দপুরের হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাসের পর ঢাকা কলেজ থেকে আইকম ও বিকম পাস করেন জয়নাল আবেদীন। কলেজে থাকার সময় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন তিনি।
তার সাংবাদিকতা শুরু ১৯৫৭ সালে উর্দু দৈনিক জংয়ের মাধ্যমে। পরে তিনি মর্নিং নিউজ, বাংলাদেশ টাইমস, চলচ্চিত্র পত্রিকা চিত্রালী, ওয়াতন, সংবাদ সংস্থা এনায় কাজ করেছেন। জং এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
একশর বেশি চলচ্চিত্র কাহিনীর রচয়িতা জয়নুল আবেদীনকে রুপালি জগতের অনেকে ‘গুরু’ বলে মানেন। পরিচালক এহতেশাম, মুস্তাফিজ, শিবলী সাদেক, অভিনেতা রহমানের সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
কথাসাহিত্িযক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস খোয়াবনামা’ উর্দুতে অনুবাদ করেন জয়নুল আবেদীন।
১৯৫০ সাল থেকে জয়নুল আবেদীন ঢাকায় বসবাস করছেন। তার ঠিকানা তোপখানা রোডের জাতীয় প্রেস ক্লাব। সেখানেই তিনি থাকেন।
তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ভাই-বোনেরা কেউ বাংলাদেশে থাকেন না। দুই ভাই পাকিস্তানের করাচীতে থাকেন। একমাত্র বোন চার বছর আগে মারা যান।
পরিবারের সদস্যরা ভিডিও কল করে তার খোঁজ-খবর নেন বলে জানান জয়নাল আবেদীন। বাবা মোস্তফা ও মা জয়তুন বিবির কবর সৈয়দপুরে। প্রতিবছর তিনি কবর জিয়ারত করতে যান সেখানে।
‘আমি বাংলাদেশকে নিজের মায়ের দেশ মনে করি’, বলেন তিনি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ