শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

পরিবহন ধর্মঘট প্রসঙ্গে

গত মঙ্গলবার সকালের দিক থেকে হঠাৎ করেই ধর্মঘট শুরু করেছিল পরিবহন শ্রমিকরা। আগে থেকে না জানিয়ে করা এই ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছিল রাজধানীসহ সারাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা। লাখ লাখ যাত্রীর যাতায়াতই শুধু বাধাগ্রস্ত হয়নি, পণ্য পরিবহনও বাধাগ্রস্ত হয়েছে মারাত্মকভাবে। দৈনিক সংগ্রাম এবং জাতীয় সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে দু-চারটি বাস-ট্রাক চলাচল করলেও রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনালসহ দেশের সকল টার্মিনালকে প্রকৃতপক্ষে অচল করে দেয়া হয়েছিল। এর ফলে রাজধানীবাসী তো বটেই, দূরবর্তী গন্তব্যের যাত্রীরাও খুবই বিপদে পড়েছেন। নারী-শিশুসহ হাজার হাজার মানুষ বাস টার্মিনালগুলোতে আটকে থেকেছেন, কাছাকাছি দূরত্বের অনেকে বাধ্য হয়ে হেঁটে যাতায়াত করেছেন। চিকিৎসা এবং চাকরি ও ব্যবসার মতো জরুরি প্রয়োজনেও তারা যানবাহন পাননি। কারণ, যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম গণপরিবহনের চলাচলই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, বহু এলাকায় টিকেট করে আসা যাত্রীদের জোর করে এবং ভয়-ভীতি দেখিয়ে যানবাহন থেকে পথের মধ্যে নামিয়েও দেয়া হয়েছে। ধর্মঘটের কারণে পণ্য পরিবহনেও মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। দেশের বিভিন্নস্থানে স্তূপ জমেছে নানা ধরনের পণ্যের। চট্টগ্রাম ও মংলাসহ প্রতিটি নৌ বন্দরের বহির্নোঙ্গরে এবং অন্যান্য ঘাট এলাকায় আটকে পড়েছে অসংখ্য পণ্যবাহী জাহাজ। এসব জাহাজের পণ্য খালাস করা সম্ভব হয়নি। বেনাপোল ও হিলিসহ স্থল সীমান্তগুলোতেও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মঘটের ফলে পণ্যের বাজারও অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অনেক পণ্যেরই দাম বেড়ে গেছে। 

উল্লেখ্য, ঢাকা ও মানিকগঞ্জের পৃথক দুটি আদালতের রায়ে সম্প্রতি একজন চালককে মৃত্যুদণ্ড এবং অন্য একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয়ার প্রতিবাদে পরিবহন শ্রমিকরা এই ধর্মঘটে গিয়েছিল। এমন কর্মসূচি আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়লেও শ্রমিক নেতাদের বোঝানোর এবং ধর্মঘট থেকে নিবৃত্ত করার ব্যাপারে সরকারের দিক থেকে কোনো উদ্যোগই লক্ষ্য করা যায়নি। আইনমন্ত্রী শ্রমিকদের উদ্দেশে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থেমে পড়েছেন। তার পাশাপাশি সেতু ও সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই আশাবাদ ব্যক্ত করেই দায়িত্ব শেষ করেছেন যে, শ্রমিকরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেবে। 

অন্যদিকে প্রশ্নসাপেক্ষ ভূমিকা রেখেছেন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি বলেছেন, শ্রমিকরা ধর্মঘট করেনি, বরং ‘অবসরে’ গেছে! জনাব শাজাহান খানের অবস্থান নিয়ে আলোচনা জমে ওঠার কারণ, তিনি শুধু প্রভাবশালী মন্ত্রীই নন, একই সঙ্গে পরিবহন শ্রমিক ও মালিক- উভয় পক্ষের প্রধান নেতাও। শুধু তা-ই নয়, প্রকাশিত খবরে একথাও জানানো হয়েছে যে, মূলত তার গোপন ইন্ধনেই শ্রমিকরা হঠাৎ করে ধর্মঘটে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছে। কথাটা বলার কারণ, খবরে এ তথ্যও জানা গেছে, সোমবার দিবাগত গভীর রাতে মন্ত্রী শাজাহান খানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকেই নাকি ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় বলা হয়েছে, শাজাহান খান চাইলে একদিকে ধর্মঘটে যাওয়া থেকে শ্রমকদের বিরত রাখা সম্ভব হতো, অন্যদিকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করানো যেতো অনতিবিলম্বে। কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী পালন করেছেন রহস্যজনক ভূমিকা। শ্রমিকদের ‘অবসরে’ যাওয়া সংক্রান্ত বক্তব্য নিয়েও সঙ্গত নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের অনেকে এমনকি এই অভিযোগও করেছেন যে, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সম্ভাব্য আন্দোলন প্রতিহত করার পাশাপাশি মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি থেকে জনগণের দৃষ্টি ও মনোযোগ সরিয়ে দেয়ার কৌশল হিসেবেই সরকার মন্ত্রী শাজাহান খানকে দিয়ে হঠাৎ ধর্মঘট করিয়েছে।

অন্তরালের প্রকৃত সত্য যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, কঠিন সত্য হলো, পরিবহন শ্রমিকদের গত মঙ্গলবারের আকস্মিক ধর্মঘটের কারণে সৃষ্ট অচলাবস্থায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতিও মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এমন অবস্থা কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা মনে করি, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে এভাবে ধর্মঘট করার অর্থ আসলে আদালত অবমাননার শামিল। দায়সারাভাবে বললেও আইনমন্ত্রীর বক্তব্য এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল করার বিধান ও সুযোগ রয়েছে। শ্রমিকদের উচিত আইনসম্মত সে পথেই দণ্ডিত চালকদের দণ্ড মওকুফ ও মুক্তির জন্য চেষ্টা করা। অন্যদিকে শ্রমিকরা যাত্রী তথা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করেছে, যার ফলে মানুষের অবর্ণনীয় ক্ষতি তো হয়েছেই, জাতীয় অর্থনীতিও বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েছে। আমরা আশা করতে চাই, শ্রমিকরা ধর্মঘটের পথে যাওয়ার পরিবর্তে আইনী পন্থার আশ্রয় নেবে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মসূচির পুনরাবৃত্তি ঘটাবে না। বলা দরকার, মানুষকে কষ্ট, ভোগান্তি ও ক্ষয়ক্ষতির শিকার না বানানো হলে জনগণও শ্রমিকদের পক্ষেই অবস্থান নেবে। তাদের প্রতি সমর্থন জানাবে। 

আমরা মনে করি, সেটাই এখন সময়ের দাবি। আমরা একই সাথে এমন আয়োজন নিশ্চিত করার আহবান জানাই, শ্রমিকদের যাতে কয়েক মাস পর পর ধর্মঘটে যেতে না হয়। মনে রাখতে হবে, জনগণকে জিম্মি করার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতির ক্ষতি হয় এমন কর্মকাণ্ডের জন্য শ্রমিকরা তো বটেই, মালিকরাও দায়দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না। সমানভাবে দায়ী থাকবে সরকারও।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ