শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

এখনও রাত্রি নামে

তাহনিয়া তরিক : ‘যাক মেয়েটা তাহলে বেঁচে গেল?!’ - কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র প্রফেসর ড. শামীম। হ্যাঁ। স্যার! আমরা তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। আসলে ওর বাবা-মার ভাগ্য।’- অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর তনিমা এসে বসল সোফায়। টিচার্স লাউঞ্জে ঢুকলেন ড. রেহানা। তনিমার শেষের কথাটুকু শুনতে পেয়ে বললেন - মেয়েটা তো বাঁচল। কালপ্রিটগুলো কি ধরা পড়েছে?’ সালমা মাথা নাড়ল। মোহনার জন্য মানববন্ধনে লিড দিচ্ছে ও। সাথে জামিল আর শওকত হেল্প করছে তাকে। কোণার দিকের একটা সোফায় বসে নীরবে চায়ে মনোনিবেশ করছেন ড. ফৌজিয়া। সবার কথা শুনছেন। ম্যাডাম ফৌজিয়া! আপনি কিছু বলছেন না যে!’ জামিল তাকিয়েছে এই দিকে। ফৌজিয়ার চেয়ে বছর পাঁচেক ছোট হবে, তবুও ও ভাই বলেই সম্বোধন করে। বলল - জামিল ভাই! কি বলব? শুনছি সবার কথা।’ তারপর চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল- আমার মনে হয় কি জানেন? মোহনা মরে গেলেই বরং বেঁচে যেত।’ পুরো লাউঞ্জ হতবম্ব হয়ে তাকিয়েছে ড. ফৌজিয়ার দিকে। কি বলছেন ম্যাডাম!’ - আকাশ থেকে পড়েছে শওকত। অন্য সবার চোখেও একই অভিব্যক্তি। কি যা-তা বলছ ফৌজিয়া? মরে গেলে আবার কেউ বেচেঁ যায়?’ ড. হুসনে আরা এগিয়ে এলেন। মরে গেলে আর কেউ বেঁচে না যাক, ফৌজিয়া তো বেঁচে যেতেন! গতকাল সাদিয়াকে দেখার পর থেকে কোথায় যেন একটা কাঁটা খচ্খচ্ করেই চলেছে। টিচার্স লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে আসলেও মনের ঝড় থামে না তার। ফৌজিয়া এখন ড. ফৌজিয়া হয়ে কি লাভ হয়েছে? গতকাল সাদিয়া জিজ্ঞেস করেছিল - তুই এখন কেমন আছিসরে?’ মুখে মৃদু হাসি টেনেছিলেন - এই তো চলছে।’ হ্যাঁ চলছেই তো ড. ফৌজিয়ার চল্লিশ বছরের জীবনটা-শিশুপার্কের খেলনা ট্রেনের মত, শুধুই চলার জন্য চলা। কলেজ ফ্রেন্ড সাদিয়ার কত ভরা সংসার! স্বামী-সন্তান, ভালোবাসা মাখা স্বপ্নের নীড়! অথচ...! সামনের টেবিলে কফির কাপ রেখে গেল রহিমা। বারান্দার ওধারে একটি চড়ই কলরব জুড়েছে। চড়ইটার মতই আজ বড় একা তিনি। স্টুডেন্টদের চোখে শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন স্বল্পভাষী শিক্ষিকাটি নিজের কাছে আজ বড়ই অসহায়। নিজের হাতে গড়া ঝকঝকে ফ্লাটে তাকে বুঝবার কেউ নেই, ছুটির দিনে সাথে নিয়ে ঘুরবার অথবা হাতের মুঠোয় হাত পুরে আশ্বাস দেবার মত কোন মানুষ নেই তার পাশে। পছন্দের জিনিসটা মুখে তুলে দেবার কিংবা সব দায়িত্ব কাধেঁ তুলে নেবার মত একটি সত্ত্বার অভাব মাঝে মাঝেই ছুঁয়ে যায় তাকে। আরমানের কথা মনে পড়ে। বাবারে বাবা! কি আগুন ঝারিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলো সেদিন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব! সব ভুলে ঝাঝিয়ে উঠেছিল -‘ইজ ইট ট্রু অর ফল্স? সাহস থাকলে অস্বীকার কর।’ নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ হয়ে চেয়েছিলেন ফৌজিয়া। তার বলবার কিছু ছিল না। একদিন অবুঝের মত যে বিষবৃক্ষের চারা বুনে ফেলেছিলেন তার বিষাক্ত শ্বাস এসে লাগে সদ্য নির্মিত স্বপ্ন সৌধে। সব ভালোবাসা আর শাশ্বত বন্ধন তুচ্ছ হয়ে যায় নিমিষে। সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন - বাবা অর্থের জোয়ারে সব ঢেকে রাখতে চাইলেও, সব ঢেকে রাখা যায় না। মাত্র একটি দিন! উচ্চ বিদ্যাপীঠের প্রথম অধ্যায়ে তারুণ্যের উদ্দ্যমে ভাসা অভিশপ্ত সেই সেই দিনটিতে জীবনের সাদা খাতায় যে কালোর পোঁচ লেগেছিল, তা কখনো মুছবার নয়। ছোটবেলায় লেখায় কোন ভুল হয়ে গেলে ফৌজিয়া কেঁদে ফেলতেন। মা ইরেজার হাতে দিয়ে বলতেন - মুছে ফেল, বোকা মেয়ে!’ মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন ফৌজিয়া, ঠিক মোহনা যেভাবে ফিরে এসেছে; কিন্তু সেই দাগ মুুছে ফেলার সামর্থ্য নেই কোন পদার্থের। আজও লাল গোলাপের ছড়াছড়ি দেখেন দিনটাতে, কিন্তু গোলাপের রক্তিম শোভার নিচে কাঁটাগুলোই প্রতিনিয়ত বিক্ষত করে ইংরেজীর তুখোর অধ্যাপিকা ফৌজিয়াকে। হয়তো মোহনাকেও করবে। তবুও প্রতিবছর লালের ছদ্মাবরণে রাত্রি নামতেই থাকবে নতুন কোন ফৌজিয়া-মোহনার জীবনে!
জীবনের প্রভাত বেলাতেই গোধূলীর শূন্যতা টের পাওয়া ড. ফৌজিয়াকে আজ সাদিয়ার শুভ্র-সফেদ গতিপথ বড়ই কাছে টানছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ