বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বিজ্ঞাপনের সত্যতা ২২ মার্চের মধ্যে প্রমাণ করতে হবে ইউনিলিভার’কে!

* ভিটামিন বি ৩-এ ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধির দালিলিক প্রমাণ নেই

স্টাফ রিপোর্টার : বহুজাতিক প্রসাধন কোম্পানি ইউনিলিভারের কথিত রঙ ফর্সাকারী ক্রিম ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির বিজ্ঞাপনে দেয়া বক্তব্যের পক্ষে তথ্য-প্রমাণ চেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। আগামী ২২ মার্চের মধ্যে এসব তথ্য প্রমাণ জমা দিতে হবে ইউনিলিভারকে। আত্মপক্ষ সমর্থনে বিজ্ঞাপনের সত্যতা প্রমাণে ইউনিলিভার সময় পেলো আরো ১৩ দিন।

বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (যুগ্মসচিব) মাহবুব কবীরের লিখিত অভিযোগের পর ২০ দিন আগে করা শুনানির তিন সপ্তাহ পর এই লিখিত আদেশ জারি করে অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়। অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মামুনুল হাসান গতকাল শুক্রবার রাতে দৈনিক সংগ্রামকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ক্রিমের ওই বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়েছিল, বাংলাদেশে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলিকে হারাতে পারেনি কেউ। এখন সারা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করছে তারা।

২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে মার্চ ২০১৫ সাল পর্যন্ত ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী ‘৫ কোটি টাকার চ্যালেঞ্জ চ্যালেঞ্জ’ ক্যাম্পেইনের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় বলে দাবি করছে ইউনিলিভার। বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয় দুবাই, সিঙ্গাপুর আর জাপানের কিছু বিখ্যাত ক্রিমকে হারিয়ে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী প্রথম হয়েছে।

বিজ্ঞাপনে বলা হয়, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও জাপানের বিখ্যাত সব ক্রিমকে হারিয়ে ‘আনবিটাবল’ ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী। এই ক্রীম ত্বককে দ্বিগুণ ফর্সা করে বলেও দাবি করা হয় বিজ্ঞাপনে।

বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক তার অভিযোগে বলছেন, বিজ্ঞাপনে প্রচারিত তথ্যগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তার যথার্থতা যাচাই করা প্রয়োজন, যাতে জনগণ প্রতারিত হতে না পারে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট পণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানকে তার পণ্যের বিজ্ঞাপনে প্রচারিত তথ্যের সপক্ষে প্রমাণ দিতে বলা যেতে পারে।

এই দাবি প্রমাণ করতে ব্যর্থতা হলে সেটি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ৪৪ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য বলেও মনে করেন এই সরকারি কর্মকর্তা।

গত ২০ অক্টোবর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়াধীন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে করা শুনানিতে মাহবুব কবীর এবং ইউনিলিভারের তিনজন আইনজীবী অংশ নেন। শুনানি গ্রহণ করেন ভোক্তা অধিদফতরের উপ-পরিচালক আব্দুল মজিদ।

ওই শুনানিতে ইউনিলিভারকে বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জ এবং বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করে যে বিজ্ঞাপন দিয়েছে সেটির সপক্ষে সকল কাগজপত্র ও প্রমাণ দিতে বলা হয়। তবে সেদিন লিখিত কোনো আদেশ জারি করা হয়নি।

ওই শুনানির ১৯ দিনের মাথায় গত সোমবার লিখিত আদেশ জারি করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। এতে বলা হয়, ‘বিজ্ঞাপনে বলা হয়, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও জাপানের বিখ্যাত সব ক্রীমকে হারিয়ে ‘আনবিটাবল’ ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী। দুবাই, সিঙ্গাপুর ও জাপানের কোন কোন ক্রীমকে হারানো হয়েছে, ওই ক্রীমসমূহের নাম, কোথায় কোথায় সেই প্রতিযোগিতা হয়েছে, কারা বিচারক ছিলেন, প্রতিযোগিতায় হারানোর সার্টিফিকেটসমুহ, কোন আন্তর্জাতিক মানের উপর ভিত্তি করে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে, প্রতিযোগিতা কি ওপেন না ক্লোজ ডোর, সে সবের প্রমাণ এবং দলিল দাখিল করতে হবে।’

আদেশে বলা হয়, ‘বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ- এই বক্তব্য সম্বলিত বিজ্ঞাপন পৃথিবীর আর কোন কোন দেশে দেখানো হয়, তার প্রমাণাদিও দাখিল করতে হবে।’

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের আরেক কর্মকর্তা জানান, এই আদেশ ইউনিলিভারের কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। তিনি জানান, অধিদফতরের উপপরিচালক আবদুল মজিদ বিষয়টি দেখছেন।

যদিও এই বিষয়টি নিয়ে ইউনিলিভারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোনটি ধরেন মোবারক নামে একজন কর্মী। তিনি এ বিষয়ে তাদের জনসংযোগ শাখার কর্মকর্তা তানভীর ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

তবে মোবারক এই তানভীর ফারুকের ফোন নম্বর দিতে রাজি হননি। এর আগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে শুনানির দিনও ইউনিলিভারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সেদিনও প্রতিষ্ঠানটির কোনো কর্মকর্তাই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাননি। তারা একজন অন্যজনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

অধিদফতরে ইউনিলিভারের পক্ষে শুনানি করা আইনজীবীরাও সেদিন কোনো কথা বলেননি। এমনকি তারা নিজেদের পরিচয় দিতে চাননি গণমাধ্যমকর্মীদেরকে। আসলে গণমাধ্যমের সামনে সেদিন তারা শুনানি করতে চাননি। আর তাদের চাপের মুখে গণমাধ্যমকর্মীদেরকে কক্ষ থেকে বের করে দিয়েই শুনানি হয় সেদিন। আর নজিরবিহীনভাবে বন্ধ রাখা হয় অধিদফতরের ক্যামেরাও।

এদিকে, বর্তমানে সারা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রসাধনী পণ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম এই ফেয়ারনেস বা রঙ ফর্সাকারী ক্রীম। আর ফেয়ারনেস ক্রীমের সঙ্গে অবধারিতভাবে যে নামটি চলে আসে, তা হচ্ছে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী।

বর্তমানে রঙ ফর্সাকারী ক্রীমগুলোর সবচেয়ে বড় বাজার দখল করে আছে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভারের পণ্য ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী। অবশ্য বাংলাদেশে এর বাজারটি মূলত নিয়ন্ত্রণ করে ইউনিলিভারের ভারত শাখা, হিন্দুস্তান ইউনিলিভার লিমিটেড। রঙ ফর্সাকারী ক্রীমের বাজারের শুরুটাও হয় ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর হাত ধরেই। ১৯৭৫ সালে বাজারে আসার পরপর দ্রুত ভারতের বাজারে জনপ্রিয়তা পায় এই ক্রীম। এখনও ভারতেই এর সবচেয়ে বড় বাজার রয়েছে, এরপর রয়েছে বাংলাদেশে। বিশ্বের মোট ৪০টি দেশে রফতানি হয় ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী। এশিয়ার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ল্যাটিন দেশগুলোয়ও বেশ জনপ্রিয় এটি।

সত্যিই কী রঙ ফর্সা করতে পারে বিশ্বখ্যাত ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী? যে ‘মিরাকল’-এর কথা বলা হয় ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর প্রতিটি বিজ্ঞাপনে, তা কতোটুকু সত্যি?

এর জবাবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ত্বকে গাঢ় বা উজ্জ্বল হওয়া মূলত নির্ভর করে মেলানিন নামে একটি রঞ্জক (পিগমেন্ট) পদার্থের ওপর, যা ত্বকের উপরের স্তরের (এপিডার্মিস) ঠিক নিচে থাকে। মেলানিনের উপস্থিতি বেশি হলে ত্বক গাঢ় বা কালো হয়, কম হলে উজ্জ্বল বা ফর্সা হয়। একই সঙ্গে মেলানিনের আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে- ত্বক সুরক্ষার কাজটিও এটি করে থাকে। ত্বকে মেলানিন বেশি থাকলে ত্বক তুলনামূলক সুস্থ থাকে ও বিভিন্ন চর্মরোগের ঝুঁকি তেমন থাকে না। কিন্তু মেলানিন কম হলে ত্বক সহজেই বাইরের আবহাওয়ায় আক্রান্ত হয়, সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। এই মেলানিনকে বাদ দিয়ে কোনোভাবেই ত্বকের আসল রঙ পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। শীতপ্রধান দেশে শ্বেতাঙ্গরা অতিরিক্ত ফর্সা ত্বকে ট্যান লোশন ব্যবহার করেন মেলানিনের ঘনত্ব বাড়ানোর জন্য।

মেলানিনকে প্রভাবিত করে ত্বক ফর্সা করতে পারে, এমন কিছু উপাদান হলো হাইড্রোকুইনোন, স্টেরয়েড, মার্কারি ইত্যাদি। আশির দশকে কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এগুলোর ব্যবহার শুরু করলেও মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে দ্রুত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। যেসব উপাদানের সরাসরি মেলানিনকে প্রভাবিত করে ত্বকের রঙ পরিবর্তন করার ক্ষমতা আছে, সেগুলো এতোই ক্ষতিকারক যে ব্যবহার করার চেয়ে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ নিয়ে হাজারগুণ ভালো।

ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর মতে, তাদের সৌন্দর্যের ফর্মুলা ভিটামিন বি৩, যার রাসায়নিক নাম নিকোটিনামাইড বা নায়াসিনামাইড। ১৯৭৫ সালে ইউনিলিভারের নিজস্ব গবেষণাগারে তৈরি করেন তাদের গবেষকরা। বিভিন্ন সানস্ক্রিন এজেন্টের সঙ্গে বিক্রিয়া করে এটি ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে সাহায্য করে।

কতোটা কার্যকর এই ভিটামিন বি৩? সত্যি কী এর মেলানিনকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা আছে? থাইল্যান্ডের ইনস্টিটিউট অব ডার্মাটোলজি বলছে, “নায়াসিনামাইড যে ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়ায়, এমন কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই।”

দিল্লীর অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সের ডার্মাটোলজি বিভাগের প্রধান ড. আর কে পন্ডি এ ব্যাপারে বলেন, “আমি আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এমন কোনো রঙ ফর্সাকারী উপাদান দেখিনি, যা ক্ষতি না করে রঙ পরিবর্তন করে। এমনকি বাহ্যিকভাবে প্রয়োগ করা হয়, এমন কোনো ক্রীমই ত্বকের আসল রঙ পরিবর্তন করতে পারে না।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী ও এ ধাঁচের ক্রীমগুলো কাজ যা করে, তাৎক্ষণিক। অর্থাৎ এসব ক্রীম মুখে মাখানোর কারণে একটি সাদাটে আস্তরণ পড়ে মুখের ওপর, যাকে ফর্সা হওয়ার ‘প্রথম ধাপ’ ভেবে ভুল করেন অনেকে। ব্যবহার করতে করতে যে একসময় এটি ত্বকের দাগ, কালো স্তর দূর করে ত্বককে ফর্সা করে তুলবে, এমন ভাবাও অর্থহীন। কেননা নায়াসিনামাইডের তেমন কোনো ক্ষমতাই নেই, চামড়ার প্রথম স্তর এপিডার্মিসও ভেদ করতে পারে না। এটি নেহাৎই একটি নিরীহ উপাদান,যার একমাত্র গুণ এটি ত্বককে আপাতদৃষ্টিতে সাদাটে (কিংবা ফ্যাকাশে) করে তুলতে পারে; হাইড্রোকুইনিন, স্টেরয়েড বা মার্কারির মতো প্রত্যক্ষ কোনো ক্ষতি করা ছাড়াই। আর লোশন ধাঁচের হওয়ায় ব্যবহারের পর ত্বকে কিছুটা মসৃণ ভাব অনুভূত হয়।

উগ্র বর্ণবাদ ছড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর কিছু বিজ্ঞাপনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ভারতে। ২০০৩ সালে পরপর দুটি বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হওয়াকে কেন্দ্র করে বেশ প্রশ্নের সম্মুখীন হয় তারা। এমনকি মুখোমুখি হয় ভারতের মানবাধিকার সংস্থাগুলোরও। অবশ্য ইউনিলিভার বরাবরই এসব বিজ্ঞাপনকে ‘নারীর ব্যক্তিত্ব প্রকাশের মাধ্যম’ বলে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ