বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

খুলনায় গণপূর্তের মেরামত কাজের নামে ৯ মাসে তিন কোটি টাকা লোপাট

খুলনা অফিস : খুলনা মহানগরীর ৫৭ নম্বর শের এ-বাংলা রোডস্থ গণপূর্ত বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলীর বাসভবনের অভ্যন্তরীণ সিভিল ও মেরামত কাজ এবং একই ভবনের গাড়ির গ্যারেজ, বাউন্ডারী ওয়াল ও অভ্যন্তরীণ মেরামত কাজের জন্য পাঁচ লাখ করে সর্বমোট ১০ লাখ টাকার কাজ নিজস্ব একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সম্পন্ন করা হয়েছে। একইভাবে বিনা টেন্ডারে করা হয়েছে সাড়ে নয় লাখ টাকা ব্যয়ে বয়রার গণপূর্ত ভবনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয়ের সভাকক্ষ সম্প্রসারণ ও মেরামত কাজও। এমনিভাবে গণপূর্ত বিভাগ-২ এর আওতাধীন প্রায় তিন কোটি টাকার মেরামত কাজ বিনা টেন্ডারে ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। কিভাবে এটি সম্ভব হলো এর জবাব নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। যাদের ওপর এর দেখভালের দায়িত্ব সেই অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীও বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন। তিনি বললেন, সবকিছু নির্বাহী প্রকৌশলী জানেন। অথচ নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে তথ্য অধিকার আইনের আলোকে তথ্য চেয়েও পাওয়া যায়নি। বরং তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, এসব তথ্য দিয়ে কি করবেন? সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের অন্যতম মাধ্যম গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে এভাবেই প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার কাজ নিজস্ব ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট বিভাগের গুটি কয়েক কর্মকর্তা মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ সব কাজের সাথে কখনও ক্ষমতাসীন দলের কোন কোন ব্যক্তিকে আবার কখনও নিজ অফিসেরই নি¤œ পর্যায়ের নির্দিষ্ট কিছু কর্মচারীকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে বলেও জানা গেছে। বহিরাগত রাজনৈতিক নেতা অথবা অফিসের কর্মচারীদের মাধ্যমে ভাগ-বাটোয়ারার ফলে ওইসব অফিসাররাও থাকেন ধরা-ছোয়ার বাইরে। অথচ কাজ ভাগ-বাটোয়ারার সিংহভাগই চলে যায় ওই সব কর্মকর্তাদের পকেটে। বিষয়টি গণপূর্ত বিভাগে অনেকটা ওপেন সিক্রেট হলেও কারও যেন কোন তাপ-উত্তাপ নেই। পক্ষান্তরে এসব শীর্ষ কর্মকার্তাদের বিদায়কালে রীতিমত ঠিকাদারদের মধ্যে থেকে চাঁদা তুলে জাকজমকপুর্ণ ভাবে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সাম্প্রতিককালে এমন এক কর্মকর্তার বিদায়কালে অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের পাশাপাশি ঠিকাদারদের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করা হয় বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। 

তথ্যানুন্ধ্যানে জানা রায়, ঠিকাদারী লাইসেন্স দেয়া থেকে শুরু করে কাজ দেয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তুষ্ট করতে গুনতে হয় মোটা অংকের অর্থ। এসব অর্থের ভাগও চলে যায় অফিসের শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিতের পকেটে। এমন অভিযোগের স্বীকার করে গণপূর্ত বিভাগ-২ এর একজন অফিস সহকারি বলেন, চলতি অর্থ বছরে যে ২৮টি তৃতীয় শ্রেণির ঠিকাদারী লাইসেন্স দেয়া হয়েছে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকেই পাঁচ হাজার টাকা করে প্রায় দেড় লাখ টাকা নেয়া হয়। এছাড়া অফিসিয়াল কোন একটি কাগজ ঠিকাদারদের কাছে যাবার সাথে সাথেই সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের খুশি করতে হয়। সস্প্রতি একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স হাতে পাওয়ার পর খুশি নামক বস্তু দিয়ে তুষ্ট করা ছাড়া দোতলা থেকে নিচে নেমে আসার সাথে সাথেই এক নারী কর্মচারী দ্রুত নিচে গিয়ে ওই ঠিকাদারের কাছে বকশিস দাবি করেন। ভবনের নিরাপত্তা সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এমন শ্লোগান দেয়ালে থাকলেও এভাবে প্রতিনিয়তই যে ঠিকাদারদের হয়রাণী হতে হয় সেগুলো কখনও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ব্যবস্থা নেয়ারও নজির নেই এই অফিসে। এমনকি যেসব স্থানে ঘুষ লেনদেন হয় সে সব জায়গা সিসি ক্যামেরার আওতায় না আনার বিষয়টিও কোন দূরভিসন্ধি বলেও অনেকের অভিযোগ।

তথ্যনুন্ধ্যানে জানা যায়, চলতি অর্থ বছরের জন্য জরুরী মেরামতের যে তালিকা করা হয়েছে তার সর্বমোট আর্থিক পরিমাণ সোয়া তিন কোটি টাকা। এর মধ্যে ইতোমধ্যেই বিনা টেন্ডারে প্রায় তিন কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে গণপূর্ত ভবনের দ্বিতীয় তলার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কার্যালয়ে ওয়াল প্যানেলিংসহ সিভিল ও স্যানিটারি মেরামত কাজের মাধ্যমে চার লাখ নিচ তলার নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের সিভিল, স্যানিটারি ও অন্যান্য মেরামত কাজের মাধ্যমে আড়াই লাখ গণপূর্ত ভবন, ভবন সংলগ্ন মসজিদ ও গ্যারেজের মেরামত ও সংস্কার কাজের মাধ্যমে ১১ লাখ, সামনের সীমানা প্রাচীর নির্মাণ ও আই.বি’র নিচতলার গ্যারেজ মেরামত কাজের মাধ্যমে ছয় লাখ টাকার মধ্যে অধিকাংশই লোপাট হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে রয়েছে। জরুরী মেরামত কাজ নাম দিয়ে সোয়া আট লাখ টাকার বিনিময়ে গণপূর্ত ভবনের পশ্চিম পাশের গার্ডেনের অর্নামেন্টাল ফেল্ডিং নির্মাণ ও আনুষাঙ্গিক সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করা হয়। ভবন সংলগ্ন বাগানোর সৌন্দর্য বৃদ্ধিকল্পে পানির ফোয়ারা ও বিভিন্ন অর্মামেন্টাল কাজও করা হয় জরুরী কাজের অংশ হিসেবে। এ জন্য ব্যয় দেখানোর হয় পাঁচ লাখ টাকা। ভবনের পূর্ব পাশের গ্যারেজ সেড নির্মাণের মাধ্যমেও খরচ দেখানো হয় পাঁচ লাখ টাকা। অফিসের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর বাসভবনের সিভিল ও স্যানিারী মেরামত কাজের মাধ্যমেও ব্যয় করা হয় চার লাখ টাকা। এভাবে বয়রাস্থ লো-কষ্ট কলোনীর কয়েকটি ভবনের মেরামতকাজ, জোড়াগেট সরকারি আবাসিক (সিএন্ডবি) কলোনীর কিছু ভবনের মেরামত কাজ নগরীর বিভিন্ন স্থানের পরিত্যক্ত ঘোষিত অথচ ভাড়ায় পরিচালিত কিছু ভবনের মেরামত কাজ এমনকি বিভিন্ন সরকারি অফিসের মেরামত কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়। যা সকল প্রকার নিয়ম-নীতিকে উপেক্ষা করে গোপনে নির্বাহী প্রকৌশলীর নিজস্ব কিছু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করা হয়। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ঠিকাদার জানান, যেভাবে গোপনে সীমিত দরপত্র বা এলটি এম পদ্ধতিতে কাজগুলো করা হয়েছে এর মাধ্যমে শুধুমাত্র নির্বাহী প্রকৌশলীসহ গুটি কয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারী লাভবান হয়েছেন। পক্ষান্তরে প্রকাশ্য নিলামের মাধ্যমে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কাজগুলো করা হলে সরকারের লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হতো। অথচ গোপনে শুধুমাত্র নির্বাহী প্রকৌশলীকে শতকরা ১০ ভাগ অর্থ দিয়ে এসব কাজ করার মধ্যদিয়ে কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিতে পারে বলে আশংকা রয়েছে।

এ ব্যাপারে গণপূর্ত বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল্লাহ আল মাসুম বলেন, সরকারি প্রয়োজনে কিছু জরুরি মেরামত কাজ থাকেই। এটি নিউজ করার মত কিছু নয়। তিনি তার বিরুদ্ধে ১০% অর্থ নিয়ে কাজ দেয়ার বিষয়টিও তিনি অস্বীকার করেন।

বিনা টেন্ডারে মেরামত কাজ করার নামে প্রায় তিন কোটি টাকা লোপাটের ব্যাপারে জানতে চাইলে গণপূর্ত বিভাগ খুলনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী ওরাসিফ আহমেদ বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। এ সব বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী সব জানেন। একই ধরনের মন্তব্য করে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করেন, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কামাল পাশাও। তিনিও বলেন, এ সব বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ