শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সাংবাদিকদের নিরাপত্তার প্রশ্ন

বাঙ্গাল আবদুল কুদ্দুস : ‘সাংবাদিকরা দেশ ও জাতির বিবেক’ এ মহামূল্যবান কথাটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তি-মানুষের মুখে শুনতে পাই। সমাজের তৃণমূল থেকে রাষ্ট্রের দায়িত্বরত সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, স্বজনপ্রীতি, পরিবারপ্রীতি, গোষ্ঠীপ্রীতি, দলবাজি, সন্ত্রাস, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কমিশনবাজি, জালিয়াতি, প্রতারণা, ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, আত্মসাৎ, শোষণ-বঞ্চনা হামলা-মামলা, নির্যাতন, গণগ্রেফতার, গণনির্যাতন, হত্যা, অপহরণ, খুন-গুম, অন্যায়, অবিচার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, অপশাসন, সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক মৌলিক অধিকার, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের অধিকার, সর্বোপরি মানবাধিকার এবং রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ন্যায়বিচার, গণতান্ত্রিক সুশাসন, উন্নয়ন, নাগরিক কল্যাণ, সফলতা, প্রচার ও প্রসার ইত্যাদি সবকিছুরই প্রকাশ্যে উপস্থাপন প্রকাশ পায় সাংবাদিকের কলমের মাধ্যমে। এই মহৎ কাজের জন্যই ‘সাংবাদিকরা দেশ ও জাতির বিবেক’ হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃত। যে জাতি তার বিবেককে খুন করে বা হত্যা করে সে জাতি উন্নত বিশ্বের সভ্য সমাজ মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে বড় গলায় কীভাবে কথা বলতে পারে? এটা কি দায়িত্বশীলরা একবারও ভেবে দেখেছেন? সাংবাদিক, গবেষক, লেখক, আইনবিদ, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী, পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই বলেন, রাষ্ট্রে যখন গণতন্ত্রহীনতার সুযোগে আমলাতন্ত্র আর স্বৈতন্ত্র এক হয়ে একচক্ষু দানবের মতো জাতির ঘাড়ে চেপে বসে, যখন রাষ্ট্রে টেরোরিজমের তা-বলীলা চলে, তখন সমাজের এলিট ও অ্যারিস্টোক্রেট পারসনরা কোণঠাসা হয়ে জিম্মি হয়ে পড়েন।’
গত আট বছরে বর্তমান আওয়ামী সরকারের আমলে দেশে ২১ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে খুন হওয়া ১৮টি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনার আজ পর্যন্ত কোনো সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। আর সুষ্ঠু বিচার কবে হবে, তা কেবল ভবিষ্যৎই বলতে পারে। সর্বশেষে চলতি ২০১৭ সালের গত ২ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে প্রকাশ্য দিনদুপুরে পৌর মেয়র হালিমুল হক মিরুর গুলীতে দৈনিক সমকালের সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুল খুন হন। বড়ই পরিতাপের বিষয়, সাংবাদিক সাগর-রুনিসহ চাঞ্চল্যকর জোড়া খুনের প্রকৃত কোনো খুনি আসামীকে আজো পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বর্তমান আওয়ামী সরকারের দ্বিতীয় দফায় বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার পর থেকে গত তিন বছরে প্রায় সাতশ’রও বেশিসংখ্যক সাংবাদিক বর্বর নির্যাতন ও নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন। একটানা দুই বছরে ৫৭০টি সন্ত্রাসী ঘটনায় ১৮৫ জন সাংবাদিক গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন এবং ৪২ জন সাংবাদিক চরমভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র ও অধিকার এবং অন্যান্য প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। উদ্ধৃত তথ্যানুযায়ী ২০০৮ সালে আওয়ামী মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দেশে ২১ জন প্রখ্যাত সাংবাাদিক খুন হয়েছেন। প্রকাশিত অনুসন্ধানি প্রতিবেদনে জানা গেছে যে, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকা মহানগরীর ফার্মগেট এলাকার রাজাবাজারে ভাড়া করা বাসার তৃতীয় তলায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনির নির্মমভাবে খুন হওয়া ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সাগর সরোয়ার মাছরাঙ্গা টিভি ও মেহেরুন রুনি এটিএন বাংলার সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বিগত চার বছরে এ মামলার তদন্ত থানা পুলিশ থেকে গোয়েন্দা সংস্থা হয়ে র‌্যাব পর্যন্ত পৌঁছে। যদিও আওয়ামী সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দেন, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যেই প্রকৃত আসামীদের গ্রেফতার করা হবে।’ পুলিশ এর চার্জ জমা দেয়ার জন্য আদালতের কাছে ৪৬ বার সময় নিয়েছে। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার জন্য প্রথম থেকেই আদালতের নির্দেশে র‌্যাব পাঁচ বছর ধরে এ মামলার তদন্ত করছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কোনো কিনারা করতে পারেনি। ১৯৮০ সালের ২৩ মে রাজধানী ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ চত্বরে ডিএলএ’র রাজনৈতিক জনসভায় সংঘবদ্ধ হায়েনার দল সাপ ছেড়ে দিয়ে বোমা হামলার বর্বর ঘটনা ঘটায়। ঐ বোমা হামলায় নিহত হন দৈনিক বাংলার মুখ পত্রিকার সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান পাশা। আর গুরুতরভাবে আহত হন দৈনিক আখবার পত্রিকার সিনিয়র সহকারী সম্পাদক বাঙ্গাল আবদুল কুদ্দুস, সরকারি দৈনিক বাংলা পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক মাসির হোসেন ও জহিরুল হক এবং দেশ পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক আবু ছালেহ। ২০০৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর নিখোঁজ হওয়ার তিনদিন পর ধলেশ্বরী নদী থেকে সাংবাদিক আওরঙ্গজেবের লাশ উদ্ধার করা হয়। আওরঙ্গজেব সজীব ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি ও বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ অনেকগুলো মিডিয়ার মেডিকেল প্রতিনিধি ছিলেন।
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানী ঢাকায় খুন হন এনটিভির ভিডিও এডিটর আতিকুল ইসলাম আতিক, জুলাই মাসে খুন হন ঢাকার পাক্ষিক মুক্তমনের স্টাফ রিপোর্টার নুরুল ইসলাম রানা, আগস্ট মাসে গাজীপুরে নিহত হন ঢাকার সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক সময় পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক এম এ হাসান হাবিব, ডিসেম্বরে দৈনিক ইনকিলাবের রূপগঞ্জ সংবাদদাতা ও রূপগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসান আসিফ খুন হন। ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত সাংবাদিক ফাতেহ ওসমানী ২৮ এপ্রিল চিকিৎসা অবস্থায় মারা যান। তিনি সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিলেট প্রতিনিধি ছিলেন। একই বছরের ৯ মে গুপ্তহত্যার শিকার হন এটিএন বাংলার ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম। ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে নিহত হন বরিশালের মুলাদী প্রেস ক্লাবের সভাপতি মনির হোসেন। ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের দৈনিক আজকের প্রত্যাশা, সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র ও আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার সাংবাদিক মাহবুব টুকুল এবং ঢাকার  উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের সাপ্তাহিক বজ্রকণ্ঠের সাংবাদিক আলতাফ হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়। একই বছর ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কুরাইল এলাকায় গলা কেটে হত্যা করা হয় দৈনিক ভোরের ডাকের প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম রঞ্জুকে। ২০১২ সালের ২৮ জানুয়ারি নিজ বাসায় পুরানা পল্টনে খুন হন প্রবীণ সাংবাদিক ও দৈনিক জনতার সম্পাদক ফরহাদ খাঁন (৬০) ও তার স্ত্রী রহিমা খাঁন (৫৫)। একই বছরের ১৬ জুন যশোরের শার্শায় খুন হন দৈনিক গ্রামের কাগজের শার্শা প্রতিনিধি জামাল উদ্দীন। ঐ বছরেরই ১০ জুলাই খুন হন দৈনিক বিবিয়ানার হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ প্রতিনিধি স্টাফ রিপোর্টার জুয়েদ আহমেদ জুনেদ। ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে সন্ত্রাসীদের গুলীতে নিহত হন সাপ্তাহিক অপরাধ দমন পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক দুর্জয় চৌধুরী দীপু তার নিজ অফিসে। ঐ একই বছরের ১৯ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদকে দুর্বৃত্তরা গুলী করে হত্যা করে আর এ হত্যার জন্য নিহতের পরিবার সরকারদলীয় নেতাকর্মী সন্ত্রাসী ক্যাডারদের দায়ী করে। রাষ্ট্রের আইন-শৃংখলা প্রশাসন সাংবাদিক হত্যাকা-ের এসব চাঞ্চল্যকর ঘটনার স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত আসামীদের গ্রেফতার করে আজো আদালতে পাঠাতে পারেনি কেন? তাদের এই ব্যর্থতা কী জাতি মেনে নিতে পারে?
ইউনেস্কো (জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংস্থা) থেকে প্রকাশিত ‘প্রতিরোধ ও শান্তি’ বিশ্বের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী রক্তক্ষয়ী অপতৎপরতার মোকাবিলা ও সমাধানের সন্ধান শীর্ষক প্রতিবেদনে সাংবাদিক খুনের সংখ্যার বিবেচনায় বিশ্বের ২০টি প্রধান দেশের মধ্যে আমাদের বাংলাদেশকে ১২তম স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। ঐ প্রতিবেদনে ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংবাদপত্র ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ও খুনের শিকার হওয়া বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২০টি দেশের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। সাংবাদিকতার পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অপহরণ, খুন, গুম ও হত্যার তালিকার শীর্ষে মধ্যপ্রাচ্যের ইরাকের নাম যুক্ত করা হয়। পশ্চিমা সন্ত্রাসবাদী অপশক্তি সামরিক আগ্রাসনে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকে গত দুই যুগে ১৬৭ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। আরো ১০৪ জনকে খুন করা হয়েছে। এর পরেই রয়েছে সিরিয়া, রাশিয়া, সোমালিয়া, আলজেরিয়া, কলম্বিয়া, ফিলিপাইন, ভারত ও পাকিস্তানের নাম। একই সময়ে ভারতে ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছে। আর খুন করা হয়েছে ২২ জন সাংবাদিককে। আজ পর্যন্ত এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। উল্লেখিত প্রতিবেদনে গত দুই যুগে বাংলাদেশে ১৮ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হত্যা হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন ১৭ জন সাংবাদিক। ১৪টি খুনের ঘটনার এখন পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি।
বিভিন্ন সময়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিসহ দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বিদেশে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের সাথে করে নিয়ে যান রাষ্ট্রীয় এবং নিজেদের গণতান্ত্রিক উন্নয়ন কার্যক্রম সারা বিশ্বে এবং নিজ দেশের জনগণের নজরে আনার জন্য। সাংবাদিকরাও দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এ কাজটি অতি উৎসাহে করে যান। দেশপ্রেমিক ও জনদরদী দায়িত্বশীলরা এ কথাটি মাথায় রেখে সাংবাদিকদের সার্বিক নিরাপত্তা ও সাংবাদিক হত্যাকারী মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সুবিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে দেশ ও জাতির বিবেক সমুন্নত রাখা বড় বেশি প্রয়োজন নয় কী?

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ