বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক জুবাইদা গুলশান আরা

অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পী ও নারী নেত্রী হিসেবে জুবাইদা গুলশান আরার খ্যাতি সর্বজনবিদিত। এসব ক্ষেত্রে তার অসাধারণ অবদানের জন্য সমাজে তিনি বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। গুলশান আরার জন্ম ১৩ এপ্রিল ১৯৪২ সালে তার বাবার কর্মস্থল খুলনাতে। তার পৈতিৃকনিবাস পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর নিকটবর্তী নূরপুর গ্রামে। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রী লাভের পর তিনি সরকারি কলেজে আজীবন অধ্যাপনা করেন। অবসর গ্রহণের পর বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে জাতীয় গ্রন্থনীতি এবং জাতীয় শিশুনীতির সাথে যুক্ত থেকে শিশু কল্যাণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ রোববার রাজধানীর একটি হাসপাতালে তিনি ইন্তিকাল করেন। 
সাহিত্যের বিচিত্র রূপ-রীতিতে জুবাইদা গুলশান আরার বিপুল অবদান সত্ত্বেও তিনি কথাসাহিত্যিক হিসেবে সমধিক খ্যাতি অর্জন করেন। মাটি, মানুষ, দেশ, কাল, জাতি, ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ তার সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য। তার প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ- 
উপন্যাস: ধল পহরের আলো (১৯৮২), বিষাদ নগরে যাত্রা (১৯৮২), অশ্রু নদীর ওপারে (১৯৮৯), ছোঁ বুড়ির দৌড় (১৯৮৭), কি লিখেছো তরবারি তুমি, পদ্মা আমার পদ্মা, ঘাসের উপর মুখ রেখে (১৯৯১), দেও দানবের মালিকানা (১৯৮৫), হৃদয়ে লিখো নাম, বিবর্ণ নগরী, প্রমিথিউসের আগুন, চৈতী তোমার ভালবাসা, আমি যোদ্ধা অযুত বৎসর, শ্বাপদ সময়, একাত্তরের যুবক, ফেরেনা সব পাখী, সোনার ঝাঁপি রূপার কড়ি, অগ্নি দাহে অগ্নিপুষ্প, নিশিদিন প্রাণের শিখা, তুমি কি সেই তুমি, উত্তরায়ণ দক্ষিণায়ন, সুখ তুমি কি, জেগে আছে আমৃত্যু জীবন, বিধাতার চার দিন, নদী ফিরে এলে, নামহীন পরিচয়হীন তবু, উপন্যাস সমগ্র ১ম খণ্ড, উপন্যাস সমগ্র ২য় খণ্ড, উপন্যাস সমগ্র ৩য় খণ্ড।  
গল্প: কায়াহীন কারাগার (১৯৭৭), বাতাসে বারুদ রক্তে নিরুদ্ধ উল্লাস (১৯৮৬), হৃদয়ের বসতি (১৯৮৯)
প্রবন্ধ: বিভিন্ন বিষয়ে লেখা তার গবেষণামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধসমূহ পরবর্তীতে প্রবন্ধসংগ্রহ ১ম খ-, প্রবন্ধসংগ্রহ ২য় খ-, প্রবন্ধসংগ্রহ ৩য় খণ্ড হিসাবে প্রকাশিত হয়। 
শিশুতোষ: মজার ছড়া (১৯৭০), ছানাপোনাদের ছড়া (১৯৭৮), নিঝুম দ্বীপের গল্প কথা (১৯৭৯), কলকাকলির গান (১৯৮৪), ঘুম ভাঙানো নদী (১৯৮৮), অচিন পথের বন্ধু;
ভ্রমণ কাহিনী: স্মৃতির সোনালী দিগন্তে (১৯৭৯);
শিশুদের আদর্শ জীবন গড়ার অনুপ্রেরণা হিসাবে লেখা তার ‘অচিন পথের বন্ধু’ বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে সফলভাবে চলচ্চিত্রায়িত হয়। তার নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র ‘উইমেন ওয়েক আপ, ইটস টাইম’ দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা লাভ করে।
জুবাইদা গুলশান আরা মূলত শিক্ষাবিদ ও সৃজনশীল লেখিকা। কিন্তু শিক্ষকতা ও লেখালেখির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সমাজ উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক কর্মকা-ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক এবং শিশু ও নারী উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কর্মকা-ের সাথে বিভিন্নভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। এ সকল ক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। যেসব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন, তারমধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো- 
১. বাংলা একাডেমির জীবন সদস্য।
২. বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য।
৩. মহিলা সমিতির পরিচালনা পরিষদের সদস্য ১৯৮০-৮৯।
৪. বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের অন্যতম ভাইস প্রেসিডেন্ট।
৫. জাতীয় মহিলা সংস্থার পরিচালনা পরিষদ সদস্য (১৯৯১-১৯৯৬)।
৬. চবহ বাংলাদেশ শাখার সাহিত্য সম্পাদক (২০০২-২০০৪)।
৭. ইস্কাটন লেডিস ক্লাবের সম্মানসূচক সদস্য।
জুবাইদা গুলশান আরা দেশ-বিদেশ সফর করে বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি স্বামীর সঙ্গে ইংল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, সুইডেন প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন। ২০০০ সালে উইমেন প্লেরাইট ইন্টারন্যাশনালের সেকেন্ড কনফারেন্স অন উইমেন এ্যাড থিয়েটার সম্মেলন ম্যানিলায় (ফিলিপিন্স) যোগদান করা ছাড়াও তিনি ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
স্বীকৃতি ও পুরস্কার: জুবাইদা গুলশানআরা একুশে পদকসহ (২০০৫) আরো যেসব পুরস্কার পান, তার মধ্যে- কুমিল্লা রূপসী বাংলা স্মৃতি পদক (১৯৭৯), আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৯), কমর মুশতরী স্মৃতিপদক (১৯৮৫), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ স্বর্ণপদক (১৯৮৮), ত্রিভূজ সাহিত্য পরিষদ পদক (১৯৯৩), জসীমউদ্দীন সাহিত্য পদক (১৯৯৮), বাংলাদেশ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন পদক (২০০০), কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (২০০২), শেরে বাংলা স্মৃতি পুরস্কার (ইয়ুথফ্রন্ট), বাংলা সংস্কৃতি পরিষদ পুরস্কার (২০০৭) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, নারী ও শিশু উন্নয়নমূলক নানা কর্মকা-ে দীর্ঘ প্রায় ষাট দশককাল গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে জুবাইদা গুলশানআরা হঠাৎ করেই কোলাহল মুখর এ মায়াবী ভুবন ছেড়ে চলে গেলেন। বিভিন্ন বিচিত্র ক্ষেত্রে তিনি তার  প্রতিভার আলো বিকিরণ করে দেশ ও জাতিকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে গেছেন। তার বর্ণাঢ্য জীবন অনেকের কাছেই ছিল অনুপ্রেরণার উৎস। তার কথা, কাজ ও সৃষ্টির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে অনেকেই। তার বিশাল সৃষ্টিশীল অবদানের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ