শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ভেতরে জঙ্গি বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সিলেটের শিববাড়ি ‘আতিয়া মহলে’ অভিযান

 

স্টাফ রিপোর্টার ও সিলেট ব্যুরো : সিলেটের শিববাড়ি এলাকায় ঘেরাও করে রাখা আস্তানার জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের জন্য পুলিশ বারবার আহ্বান জানালেও কোন সাড়া মিলছে না। উল্টো পুলিশকে উদ্দেশ্য করে জঙ্গিরা চিৎকার করে বলছে ‘আমরা প্রস্তুত, বাহিনী পাঠাও’। পাশাপাশি বহুতল ভবনের ভেতর থেকে তারা 'নারায়ে তাকবীর' স্লোগান দিচ্ছে। এ অবস্থায় ঢাকা থেকে সোয়াত বাহিনী বিকাল ৩টা ৫২ মিনিটে পৌঁছে আস্তানাটিতে ঘিরে ফেলে। শুক্রবার ভোররাত থেকে সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার পাঁচতলা বিশিষ্ট আতিয়া মহল ঘেরাও করে রেখেছে পুলিশ। ভবনটির ভেতরে নব্য জেএমপির শীর্ষ নেতা মুসা ও নারী জঙ্গি মর্জিনাসহ অন্তত চারজন জঙ্গি অবস্থান করছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। 

জানা গেছে, শুক্রবার গভীর রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভবনটিতে অভিযান পরিচালনা করবে।  এরই মধ্যে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে ঘিরে রাখা বাড়িতে চূড়ান্ত অভিযানের জন্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছে সোয়াট ও পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল। আত্মসমর্পণের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জঙ্গিরা বেরিয়ে না এলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ভেতরে অভিযান চালাতে ‘বাধ্য হবে’ বলে জানিয়েছেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা। রাত সোয়া ৯টায় এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত ভেতরে জঙ্গি এবং বাইরে আইনশৃঙাখলা বাহিনী অনড় অবস্থানে ছিল। 

সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্তি কমিশনার রোকনউদ্দিন জানান, ঢাকা থেকে আসা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি দল বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে পাঁচতলা ওই ভবনে ঢোকার চেষ্টা করলে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে ভেতর থেকে গ্রেনেড ছোড়া হয়। পরে পুলিশও পাল্টা গুলী চালায় এবং পুরো এলাকা ঘিরে ফেলা হয়। সকালে ওই বাড়ি থেকে থেমে থেমে গুলী ও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায় বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান।

পাঁচতলা ওই ভবনের দুটি ইউনিটে ৩০টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর মধ্যে নিচতলার একটি বাসায় জঙ্গিরা আস্তানা গেড়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য। ওই ভবন ঘিরে পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা অবস্থান নেওয়ার পর সকালে ওই বাড়িতে যাওয়ার দুটি সড়কে চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে আশপাশের কয়েকটি বাড়ি থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নিতে দেখা যায় সশস্ত্র পুলিশ সদস্যদের। পাঁচ তলা ওই ভবনের অন্যান্য ফ্ল্যাটে যে পরিবারগুলো আটকা পড়েছে, তাদের দরজা-জানালা বন্ধ করে ভেতর থাকার পরামর্শ দেওয়া হয় পুলিশের হ্যান্ড মাইক থেকে।

ওই বাড়ির মালিক উস্তার আলী জানান, তিন মাস আগে কাউছার আলী ও মর্জিনা বেগম নামে দুইজন স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে দ্বিতীয় ইউনিটের নিচতলার চার নম্বর বাসাটি ভাড়া নেন। সে সময় কাউছার নিজেকে প্রাণ কোম্পানির অডিট অফিসার হিসেবে পরিচয় দেন। আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় জড়িত উস্তার বলেন, সব নিয়ম মেনেই তাদের বাসা ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। দুজনের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপিও রাখা হয়েছে। তারা নিয়মিত ভাড়াও দিয়ে আসছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ‘আতিয়া মহল’ ঘেরাও করে রেখেছে আইন-শৃংখলাবাহিনী। ওই এলাকায় থেমে থেমে গুলীর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পুলিশের দাবি, জঙ্গিরা তিন দফা গ্রেনেড হামলার পর থেমে থেমে গুলীও করছে। জবাবে গুলী ছুঁড়ছে পুলিশও। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঘটনাস্থলে দফায় দফায় বৈঠক করছেন আইনশৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।

সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) কমিশনার গোলাম কিবরিয়া জানান, জঙ্গিদের বারবার আত্মসমর্পনের আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু কোন সাড়া মিলছে না। এসএমপির অতিরিক্ত কমিশনার রোকনউদ্দিন জানান, আতিয়া মহলে জঙ্গিদের অবস্থান সম্পর্কে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। কমপক্ষে তিন পুরুষ ও এক নারী জঙ্গির অবস্থান প্রত্যক্ষ করা গেছে।

পুরো এলাকা ঘিরে ফেলার কথা জানিয়ে দুপুরের দিকে ‘জঙ্গিদের’ আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। সন্দেহভাজন ওই নারী জঙ্গির নাম উল্লেখ করে পুলিশের হ্যান্ড মাইকে বলা হয়, “মর্জিনা বেগম, আপনাদের চারদিক দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করুন। এক পর্যায়ে বেলা দেড়টার দিকে পুলিশের একজন এসআই সন্দেহভাজন জঙ্গিদের উদ্দেশে মাইকে বলেন, আপনারা মুসলমান, আমরাও মুসলমান। আপনাদের কোনো বক্তব্য থাকলে মিডিয়ার ভাইয়েরা আছেন, আপনারা কথা বলুন। এ সময় ওই বাড়ি থেকে জানালা ফাঁক করে নারী কণ্ঠ জবাব দেন, আপনারা শয়তানের পথে, আমরা আল্লাহর পথে। এর পরপরই আরেক পুরুষকণ্ঠে পুলিশের উদ্দেশে বলা হয়, দেরি করছ কেন? আমাদের সময় কম। তাড়াতাড়ি সোয়াট পাঠাও। পরে বিকাল পৌনে ৪টার দিকে অতিরিক্ত উপ কমিশনার আশিকুর রহমানের নেতৃত্বে সোয়াট ও পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছালে শুরু হয় চূড়ান্ত অভিযানের প্রস্তুতি।    

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ কমিশনার আবদুল মান্নান জানান, সিলেটে জঙ্গি আস্তানা থাকার তথ্য পাওয়ার পর তাদের সদস্যরা সিলেট পুলিশকে নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অনুসন্ধান চালাচ্ছিল। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার রাতে শিববাড়ির ওই ভবনের সন্ধান পান তারা। ওই বাড়িতে প্রবেশ করতে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়া হয়। পরে পুলিশ দূরে সরে গিয়ে ভবনটি ঘিরে ফেলে এবং পরে আশপাশের বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে কাজ শুরু হয়। পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও তার স্ত্রী-সন্তানকে ২০০৬ সালের ২ মার্চ এই সিলেটেরই পূর্ব শাপলাবাগের সূর্যদীঘল বাড়ি নামের এক ভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তবে এরপর দীর্ঘ সময়ে সিলেটে কোনো জঙ্গি হামলা বা হত্যাকা- অথবা কোনো জঙ্গি আস্তানার কথা শোনা যায়নি।  

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ