শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বাংলাদেশের ঘড়িয়াল

নূরজাহান সরকার : বাংলাদেশে তিন প্রজাতির কুমির আছে। মিঠা পানির কুমির, নোনা পানির কুমির ও মেছো কুমির বা ঘড়িয়াল। এর মধ্যে মিঠা পানির কুমির বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
ঘড়িয়াল বা গারিয়াল কিংবা মেছো কুমির লম্বায় প্রায় ৩-৪ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের মুখের সম্মুখ ভাগ চঞ্চুর মতো, লেজ তুলনামূলকভাবে লম্বা। চঞ্চুর শেষের দিকে ঘটির মতো কিছুটা উঁচু বলে এদের খর্ব কুমিরও বলা হয়ে থাকে। ঘড়িয়াল এক সময় বাংলাদেশের সবগুলো ছোট-বড় নদী, খাল, এমনকি অনেক সময় দীঘি ও বড় পুকুরে পর্যন্ত পাওয়া যেত। ১৯৫০ সাল পর্যন্তও ঘড়িয়ালের প্রাচুর্য বাংলাদেশে ছিল। কিন্তু এখন এদের অস্তিত্ব আছে মাত্র কয়েকটি বড় নদীতে তথা পদ্মা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রে।
এদের সংখ্যা এত কমে গেছে যে, অচিরেই এরা বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এদের সর্বমোট সংখ্যা এখন ৩০টির বেশি নয়।
ঘড়িয়াল সাধারণত মাছ খেয়ে থাকে, এ জন্যই একে মেছো কুমিরও বলা হয়ে থাকে। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময়ে এরা ডিম দেয়। নদীর তীরে বালুর উপরে অগভীর গর্ত করে সেখানে ডিম পাড়ে এবং তা আবার বালু দিয়ে ঢেকে রাখে। নদীর তীর থেকে ১০ মিটার দূর পর্যন্ত এরা ডিম পাড়ার জন্য গিয়ে থাকে। ঘড়িয়ালের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পেছনে নানা কারণ রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলো: (১) নির্বিচারে হত্যা (২) পরিবেশ ধ্বংস (৩) জনসাধারণের অজ্ঞতা (৪) মশা ও ইদুর ধ্বংসকারী ওষুধের অপব্যবহার ও জমিতে সার প্রয়োগ এবং (৫) দারিদ্র্য।
আমাদের দেশে বন্যপ্রাণী ও পাখি রক্ষার জন্য নামেমাত্র আইন রয়েছে। নির্বিচারে প্রাণী হত্যা সম্পূর্ণ আইনবিরুদ্ধ কাজ। আইনকে প্রায় কেউই পরোয়া করে না। শিকারীগণ সরকারের অনুমতি ছাড়াই নিদ্বির্ধায় ঘড়িয়াল হত্যা করছে। তাছাড়া দেশের প্রায় ৮০ জন লোকই অশিক্ষিত হওয়াতে বন্যপ্রাণী তথা ঘড়িয়ালের অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে মোটেই ওয়াকেফহাল নয়। তাই যখনই যে কেউ কোন ঘড়িয়াল দেখে তখনই তাকে হত্যা না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হয় না, তাছাড়া  জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যাপক ও বেহিসাবী ব্যভহারে এদের পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে এবং মাছের সংখ্যা কমে গিয়ে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। তদুপরি দারিদ্র্যের কারণে কিছু লোকজন ঘড়িয়ালের ডিম চুরি করে নিজেদের খাদ্যের চাহিদা মিটাচ্ছে। এভাবে এদের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে।
ঘড়িয়ালকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হলে অনতিবিলম্বে আমাদের সরকারের ১৯৭৩ সালের প্রবর্তিত আইনকে বাস্তবায়ন করতে হবে। কেউ আইন অমান্য করলে কঠোর শাস্তি পেতে হবে বা জরিমানা দিতে হবে।
জনগণকে ঘড়িয়াল সম্পর্কে এবং এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে ছোটবেলা থেকেই স্কুল, কলেজের পাঠ্য পুস্তকের মাধ্যমে বন্যপ্রাণীর গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষাদান করা যেতে পারে। শীতের অতিথি পাখি, আমাদের দেশে বক, ডাহুক ইত্যাদি পাখি খাদ্য হিসাবে নির্বিকারে শিকার না করার জন্য শিক্ষক, অভিভাবক সকলকে সচেতন হতে হবে।
ঘড়িয়ালের চামড়া দিয়ে ব্যাগ, স্যুটকেস, জুতা প্রভৃতি তৈরি হয় যা অত্যন্ত মজবুত ও রুচিসম্মত। সুতরাং আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে এদের হত্যা বন্ধ করে সংখ্যা বাড়তে দিতে হবে। এদের চামড়া বিক্রি করে আমরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি যদি এদের চাষ করে বংশ বৃদ্ধি করতে পারি।
ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে সুন্দরভাবে ঘড়িয়ালের চাষ হচ্ছে যেখানে বিভিন্ন নদীতীর হতে ঘড়িয়ালের ডিম সংগ্রহ করে গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে ফুটিয়ে বাচ্চা বেশ বড় করে যখন এরা শত্রুমুক্ত অবস্থায় চলাফেরা করতে পারে তখন প্রকৃতিতে ছেড়ে দিয়ে এদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ানো হচ্ছে। একই উপায়ে আমাদের দেশেও ঘড়িয়ালের চাষ করা যেতে পারে।
ঘড়িয়ালের মতো প্রাণীকে রক্ষা করা এখন প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব হয়ে পড়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ