শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

শিশু রাকিব হত্যায় দুইজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন

স্টাফ রিপোর্টার : পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে ১২ বছরের শিশু খুলনার রাকিব হাওলাদার হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া দুই আসামী ওমর শরিফ ও মিন্টু খানের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবনের রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি তাদের দুইজনকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার এই অর্থ রাকিবের পরিবারকে দিতে হবে। না হলে দুই আসামীকে আরও দুই বছরের সাজা ভোগ করতে হবে।

গতকাল মঙ্গলবার এ হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল ও জেল আপিল নিষ্পত্তি করে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন। 

গত ২৯ মার্চ ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য ৪ এপ্রিল দিন নির্ধারণ করেছিলেন আদালত। 

এদিকে রায়ের পর শিশু রাকিবের বাবা নুরুল আলম ও মা লাকী বেগম অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আমাদের খুলনা অফিস জানায়, খুলনা মহানগরীর দক্ষিণ টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডের প্রবেশ মুখের অদূরেই ভাড়া বাড়িতে রাকিবের বাবা-মা ও একমাত্র বোন থাকেন। রায় ঘোষণার পর সাজা কমানোর খবর শুনে অচেতন হয়ে পড়েন রাকিবের মা লাকি বেগম। ঘরে স্ত্রী জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছেন, সেদিকেও খেয়াল নেই রাকিবের পিতা নূরুল আলমের। অস্থিরতায় ছটফট করছেন যেন। রায় ঘোষণার পরপরই তিনি ঘরের বাইরে রাস্তায় চলে আসেন। এই সময় তিনি জানান, তার ছেলেকে পায়ূপথে হাওয়া দিয়ে হত্যার মত জঘন্য ঘটনা ঘটায় আসামীরা। যে কারণে খুলনার আদালত তাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন। একইভাবে তিনিসহ সারা দেশবাসী আশা করেছিল উচ্চ আদালতেও তাদের ফাঁসির রায় বহাল থাকবে। কিন্তু তা না থাকায় তারা হতাশ হয়েছেন। তিনি এ ব্যাপারে আপিল করবেন।

আদালতে আসামীপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এ এস এম আবদুল মুবিন ও গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী আলাল।

সরকারপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির, সহকারী এটর্নি জেনারেল আতিকুল হক সেলিম ও বিলকিস ফাতেমা। 

আদালত বলেছেন, আসামীদের মধ্যে রাকিবকে বাঁচানোর প্রবণতা দেখা গেছে। তারা রাকিবকে নিয়ে হাসপাতালে গেছেন। আসামীদের বিরুদ্ধে অতীতে কোনো ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড পাওয়া যায়নি। এসব দিক বিবেচনা ও নথি পর্যালোচনা করে দুই আসামীর মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন হাইকোর্ট।

রায়ের পর রাকিবের পক্ষের আইনজীবী সালমা সুলতানা বলেন, আদালত একদিকে বলেছেন, ১০০ বছরের ইতিহাসে এটি নিষ্ঠুর ও জঘন্যতম হত্যাকান্ড, অপরদিকে আসামীদের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দিয়েছেন। রায়টি সাংঘর্ষিক। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। 

ডেপুটি এটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির সাংবাদিকদের বলেন, দুই আসামী রাকিবকে হত্যা করার পর আবার বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। এ বিষয়টি আমলে নিয়ে আদালত দণ্ড কমিয়েছেন। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। 

আসামীপক্ষের আইনজীবী গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী আলাল সাংবাদিকদের বলেন, শিশু রাকিবকে বাতাস ঢুকিয়ে মারার বিষয়টি শরীফ ও মিন্টু জানতেন না। শরীফ তাকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। এমনকি নিজের রক্ত পর্যন্ত দিয়েছেন। এসব বিবেচনায় উচ্চ আদালত তাদের সাজা কমিয়েছে। আইনজীবী বলেন, এভাবে বাতাস ঢোকালে মারা যাওয়ার ঘটনাও বিরল। এ বিষয়টিও আদালত বিবেচনায় নিয়েছেন।

এ মামলার শুনানির শেষ দিনে আসামীপক্ষের আইনজীবী গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী আলাল আসামীদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে আদালতে বলেন, শিশু রাকিবকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়নি; বরং এটি ছিল দুষ্টুমির ছলে একটি দুর্ঘটনা। আর এ বিষয়ে চাক্ষুস কোনো সাক্ষীও নেই। এ সময় আদালত বলেন, আসামীরা দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। নিহত রাকিবের মৃত্যুকালীন জবানবন্দি রয়েছে।

এ সময় আইনজীবী বলেন, আসামী শরীফ পায়ুপথে বাতাস ঢোকানোর পর নিহত রাকিবকে খুলনার চারটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। এমনকি শরীফ নিজের শরীরের রক্ত প্রদান করে শিশু রাকিবকে। এ ঘটনা ছিল আসামীদের চিন্তার বাইরের একটি কাজ। তারা হত্যা করতে চাইলে ঘটনার পর পর নিজেরা হাসপাতালে নিত না। এমনকি নিজের শরীরের রক্ত প্রদান করত না।

আইনজীবী আরো বলেন, আসামীরা নিজেরা অ্যাম্বুলেন্সে করে রাকিবকে ঢাকার পথে রওনা দেয়। পথের মধ্যে তার মৃত্যু হয়। তাই আসামীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা ঠিক হবে না।

জবাবে আদালত বলেন, যেভাবে হোক আসামীরা শিশু রাকিবকে হত্যা করেছে। এটি হচ্ছে বড় কথা। একজন মানুষের জীবন নিয়ে কীভাবে দুষ্টুমি করা হয়।

আদালত আরো বলেন, একটি মানুষ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়বে আর সেটিকে দুষ্টুমি বলে চালিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। বক্তব্য শেষে আদালত ৪ এপ্রিল রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করেন।

২০১৫ সালের ৮ নবেম্বর বিচারিক আদালতের রায়ে এই মামলায় ওমর শরীফ ও তাঁর সহযোগী মিন্টু খানকে মৃত্যুদণ্ড দেন। বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলার নথিপত্র ওই বছরের ১০ নকেম্বর হাইকোর্টে এসে পৌঁছে এবং ডেথ রেফারেন্স হিসেবে নথিভুক্ত হয়। প্রধান বিচারপতির নির্দেশে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক প্রস্তুত হয় ও হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে শুনানির জন্য আসে। এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামীরা আপিল ও জেল আপিল করেন। পাশাপাশি আসামীদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) শুনানির জন্য হাইকোর্টে আসে। বিচারিক আদালতের রায় ঘোষণার ১৪ মাসের মাথায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স ও আসামীদের আপিলের ওপর গত ১০ জানুয়ারি শুনানি শুরু হয়।

২০১৫ সালের ৩ আগস্ট বিকেলে খুলনার টুটপাড়ায় শরীফ মোটরস নামে এক মোটরসাইকেলের গ্যারেজে মলদ্বারে কম্প্রেশার মেশিনের মাধ্যমে বাতাস ঢুকিয়ে রাকিবকে হত্যা করা হয়। পরের দিন রাকিবের বাবা মো. নুরুল আলম বাদী হয়ে গ্যারেজ মালিক শরীফ, শরীফের সহযোগী মিন্টু ও মা বিউটি বেগমের বিরুদ্ধে সদর থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার ৯৬ দিনে বিচারপ্রক্রিয়া শেষে একই বছরের ৮ নবেম্বর রায় দেন খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ