শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

আফগানিস্তানে যুদ্ধ অবসানের উদ্যোগ রাশিয়া চীন পাকিস্তান ও ইরানের যৌথ প্রয়াস

চৌধুরী জাফর সাদেক : পত্রিকান্তরে প্রকাশ রাশিয়া, চীন পাকিস্তান জোট গঠনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিশেষ করে আফগানিস্তানের যুদ্ধের রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে ত্রিদেশীয় এ জোট গঠিত হচ্ছে। আফগান যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘায়িত করতে চাইছে বলে মনে করছে রাশিয়া, চীন ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের কর্মকর্তারা বলেছেন, এই পরিস্থিতিতে চীন, রাশিয়া ও ইরানকে সম্পৃক্ত করে আফগান সমস্যার আঞ্চলিক সমাধানে সচেষ্ট হওয়া ছাড়া পাকিস্তানের জন্য আর কোন বিকল্প নেই।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানে কথিত আইএস বিরোধী যুদ্ধের মাধ্যমে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থ আরো জোরদার করতে চাইছে বলে এই তিনটি দেশ ধারণা করছে। পাকিস্তানের জন্য এটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে পাকিস্তান আশা করছে। এই আশা থেকেই আঞ্চলিক দেশগুলোর দিকে হাত বাড়াতে চাইছে পাকিস্তান। একথাই বলেছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক লে. জেনারেল (অব.) আমজাদ শোয়েব। আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী নয় যুক্তরাষ্ট্র, এই মত পোষণ করে জেনারেল আমজাদ দাবি করেন আফগান যুদ্ধ বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগ্রহণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ হলে সেক্ষেত্রে রাশিয়াও চীন বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। আফগানিস্তানের সকল পক্ষকে নিয়ে সংহতি প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানের ভূমিকা জোরালো সমর্থন দিয়েছে রাশিয়া চীন ও ইরান।
এশিয়ার রাজনীতিতে আফগানিস্তানের অবস্থান কৌশলগত ও গুরুত্বপূর্ণ, উদীয়মান শক্তি চীন পুনরাবিভূত রাশিয়া জ্বালানি ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তান আফগানিস্তানকে ঘিরে আছে। প্রকৃত অর্থে আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা পার্শ্ববর্তী সকল দেশের মধ্যে আঞ্চলিক সমঝোতাও আঞ্চলিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করবে। পক্ষান্তরে আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতা এই অঞ্চলের উন্নয়নের গতিকে শ্লথ করবে।
আফগানিস্তানের অবনতিশীল পরিস্থিতিতে বিশেষ করে আইএস-এর (যার আরবী নাম দারেশ) উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাশিয়া, পাকিস্তান, চীন ইতিমধ্যে তিন দফা বৈঠক করেছে। আফগান সংকট প্রশ্নে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ দানে সম্মত হয়ে তাদের পরামর্শে বর্তমান আফগান সরকারকে এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য বর্তমান মার্কিন ও ভারতপন্থী আফগান সরকারকে সাগ্রহ আমন্ত্রণ জানয়। আফগানিস্তানের বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকারসহ পার্শবর্তী অন্যান্য দেশকেও এর সাথে শামিল করতে প্রস্তাব করলে কাবুল এই ধরনের আঞ্চলিক শলাপরামর্শ থেকে বিরত থাকে। আফগানিস্তানে ইসলামিক স্টেটের প্রভাব বৃদ্ধি ও দ্রুত অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান উদ্বেগের সাথে আফগানিস্তানকে সতর্ক করে দিয়েছে।
আফগান সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে সিরিয়া ও ইরাকের পশ্চাদপশরমান যোদ্ধারা আফগানিস্তানের সরকার নিয়ন্ত্রণহীন অঞ্চলে আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসছে। ভয়েস অফ আমেরিকার মতে জাতি সংঘস্থ রুশ রাষ্ট্রদূত ভিটালী চুরকিন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, আফগানিস্তানের অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে আইএস যোদ্ধারা সিরিয়া ইরাক থেকে পালিয়ে আফগানিস্তানে আশ্রয়ের সন্ধানে ধেঁয়ে আসছে। তারা আফগানিস্তান থেকে পার্শ্ববর্তী মধ্য এশিয়ায় অবস্থান নিয়ে নিকটবর্তী রাশিয়ার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাফিস জাকারিয়া সম্প্রতি এক সংবাদ ব্রিকিংয়ে আফগান পরিস্থিতিতে পাক অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, আফগান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সন্ত্রাসের ঊর্বর ভূমিতে পরিণত হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সুযোগ সৃষ্টি করেছে যা সর্বজনবিদিত। গত ফেব্রুয়ারি মাসে (২০১৭) রাশিয়া মস্কোতে এক আলোচনায় ভারত, ইরান, পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানকে আমন্ত্রণ জানায়। গত বছর ডিসেম্বরে মস্কোতে পাকিস্তান ও চীনসহ ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর এটা ছিল আফগানিস্তান প্রশ্নে রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ আয়োজন। গত ডিসেম্বরের বৈঠকে মস্কো কর্তৃক আফগানিস্তানকে আমন্ত্রণ না জানানোর কারণে সমালোচনার প্রেক্ষিতে এবার বৃহৎ পরিসরে বৈঠকের আয়োজন করে মস্কো। এতে কাবুল অভিযোগ ও প্রতিবাদ করে যে তালেবানদের সাথে রাশিয়ার গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
রাশিয়া বৃহৎ পরিসরে বৈঠক ডাকলেও ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রকে বোধগম্য কারণেই আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান প্রশ্নে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগছে, কারণ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের আড়াই মাস পার হলেও আফগান প্রশ্নে এখনও কোনো কোনো কৌশল নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আফগানের ৯৮% সামরিক ও ৭০% বেসামরিক খরচ যুক্তরাষ্ট্র যোগান দিচ্ছে। আফগানিস্তানকে মার্কিন বলয়ে রাখতে এই বিপুল খরচ শেষ পর্যন্ত বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসন যোগান দিবে কিনা এই আশংকা সর্বত্র বিদ্যমান। আফগানিস্তানে অচলাবস্থা নিরসনে জেনারেল নিকলসন তথায় আরও সৈন্য প্রেরণের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আফগানিস্তানে অচলাবস্থার অবসানকল্পে আরও কয়েক হাজার সৈন্য প্রেরণ অতি জরুরি। কৌতুহলের বিষয় হলো প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন, ফলে জেনারেল নিকলসনের আহ্বানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাড়া দিবেন কিনা তা এখনও পরিষ্কার নয়। ফলে আগামী দিনে ঘটনাপ্রবাহ কোনদিকে গড়ায় তা দেখার জন্য বিশ্লেষকগণ উদ্বেগের সাথে পর্যবেক্ষণ করছেন।
আফগানিস্তানে অবস্থানরত ১০ হাজার মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট ও উৎসাহব্যঞ্জক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তালেবানরা খুব দ্রুতগতিতে অঞ্চলের পর অঞ্চল দখল করে চলছে। মার্কিন প্রভাবিত কাবুল সরকারের কর্তৃত্ব কাবুলসহ কয়েকটি শহরেই সীমাবদ্ধ। রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান ও ইরান বিশ্বাস করে যে, তালেবানদের সাথে সংলাপের মধ্যেই শান্তিপূর্ণ উপায়ে আফগান সংকট সাধানের একমাত্র উপায়। সাম্প্রতিক ‘হার্ট অফ এশিয়া’ সম্মেলনে আফগান সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপরই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
আফগানিস্তানে রাশিয়ার বিশেষ দূত জমির কাবুলও গত ডিসেম্বরে ভারতের অমৃতসরে অনুষ্ঠিত হার্ট অফ এশিয়া সম্মেলনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত ও আফগানিস্তানের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করে আফগান সংকটের সমাধান হবে না। তালেবানরা আফগানিস্তানের বৈধ রাজনৈতিক শক্তি বলে তিনি ঘোষণা করেন। আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর কমান্ডার ও আফগান নেতৃবর্গ রাশিয়া কর্তৃক তালেবানদের কথিত সমর্থনে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। মার্কিন কমান্ডার ও আফগান নেতাদের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে রাশিয়া মনে করে আফগান সংকট থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাবার উদ্দেশ্যেই এই ধরনের অভিযোগ করা হয়।
আফগানিস্তানে রুশ রাষ্ট্রদূত আলোকজান্ডার মানটিস্কি ঘোষণা করেন, তারা তাদের ব্যর্থতা অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চায়। তিনি স্বীকার করেন তার দেশ তালেবানদের সাথে সংলাপরত, আফগানিস্তানে সশস্ত্র গ্রুপ থেকে রুশ নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং শান্তি আলোচনাকে এগিয়ে নেয়ার জন্যই এই সংলাপ।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম এসোসিয়েটেড প্রেসের রিপোর্টে প্রকাশ, তালেবানদের সব নেতারা বর্তমানে আফগানিস্তানে অবস্থান করছে। তালেবান নেতারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আফগান নীতি পুনর্বিন্যাস ও অবশিষ্ট মার্কিন সৈন্য সরিয়ে নেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপ-রাষ্ট্রদূত জর্জ কিংহাম বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন চায় তালেবানরা সশস্ত্র সংগ্রাম পরিহার করে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কাজ করুক। রাশিয়ার সাথে তালেবানদের যোগাযোগের কথা তালেবানরাও স্বীকার করেছে। তালেবান নেতারা বলেন, আমাদের সাধারণ শত্রু হলো আফগানিস্তানে অবস্থানরত আমাদের স্বাধীনতা হরণকারী মার্কিন সৈন্যরা ও তাদের মিত্র কাবুল সরকার।
মার্কিন দখলদার বাহিনী ও তাদের মিত্র তথা কাবুলে সীমাবদ্ধ আফগান সরকারকে ত্বরিৎ গতিতে হটাবার জন্য সকল মহলের সাহায্য চায় রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান ও ইরান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি এই মহলের আন্তরিক পরামর্শ হলো আফগান সংকট সমাধানে রাশিয়া চীন, পাকিস্তান ও ইরানসহ সকল মহলকে আস্থায় নিয়ে আফগানিস্তানে স্থায়ী ও কার্যকর শান্তি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ