শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ইতিহাস এবং বিশেষ দুটি তথ্য

আশিকুল হামিদ : অদূর ভবিষ্যতে কি ঘটবে সেটা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সন্দেহ নেই, কিন্তু সাংবিধানিকভাবে ভারত এখনো একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। প্রচারণাও সেভাবেই চালানো হয়। অন্যদিকে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর দীর্ঘ ৭০টি বছর অতিক্রান্ত হলেও ভারত কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি সত্য বলে প্রমাণ করতে পারেনি। বিশেষ করে দাঙ্গার নামে মুসলিম হত্যাসহ ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালানোর ব্যাপারে ভারত এখনো বিশ্বে ‘অতুলনীয়’ অবস্থানে রয়েছে। এই সময়ের কথাই ধরা যাক। ভারতের মুসলমানরা যাতে তাদের প্রিয় খাদ্য গরুর গোশত খেতে না পারেন সেজন্য গরু জবাই করার ওপরই সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ভারতের অনেক রাজ্যেই মাইকে আযান দেয়া আদালতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। এমনকি কমিউনিস্ট নামধারী প্রগতিশীলরাও পিছিয়ে নেই। পশ্চিম বঙ্গে তাদের অর্থাৎ বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই আযান নিষিদ্ধ হয়েছে। অতি সম্প্রতি একজন কথিত জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী আযানের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেÑ আযানে তার নাকি ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে এবং বিরক্তি লাগে! এই শিল্পীকে অবশ্য দিন তিনেকের মধ্যেই নিজের মাথা মুড়িয়ে মাফ চাইতে হয়েছে। এরকম শত শত উদাহরণ দেয়া সম্ভব, যেগুলো প্রমাণ করবে, ভারত আদৌ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়। বিশেষ করে ইসলাম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে দেশটিতে এখনো চরমপন্থী কার্যকলাপ চলছে ভয়ংকভাবে। 
কথায় কথা বেড়ে যাওয়ার আগে এবার মূল বিষয়ের দিকে যাওয়া দরকার। বাংলাদেশে বহুদিন ধরে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর রাজত্ব চলছে বলে আমারও মাঝেমধ্যে না দেখে উপায় থাকে না। মাস তিনেক আগে, সম্ভবত ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে একটি ভারতীয় টিভি চ্যানেলে ‘গান্ধী’ সিনেমাটি দেখানো হয়েছে। বহুদিন পর অবারও দেখলাম। তবে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এক নাগাড়ে নয়। তেমন সময় ও অবস্থা ছিল না। ‘গান্ধী’ দেখলে যে কারো ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের কথা মনে পড়ে যাবে। আমারও পড়েছে। ইতিহাসের ছাত্র বলে কিছু হলেও বেশি তথ্য জানা আছে। সত্যি বলতে কি, ‘মহাত্মা’ নামে বিখ্যাত মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী জীবনের কোনো পর্যায়ে আমাকে আকৃষ্ট করতে পারেননি। এবার সিনেমাটি দেখার সময়ও নেতিবাচক অনেক সত্যই বরং আমাকে তাড়িয়ে ফিরেছে। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার সময় মিস্টার গান্ধীর প্রশ্নসাপেক্ষ ভূমিকা এরকম একটি সত্য। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে, ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তানের ‘জাতির পিতা’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ পালনের ডাক দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। তার নেতৃত্বে কোলকাতার গড়ের মাঠে মুসলিম লীগের উদ্যোগে লাখ মানুষের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সবই পণ্ড করে দিয়েছিল মিস্টার গান্ধীর দল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস। একযোগে শুরু হয়েছিল মুসলিম নিধনের ভয়ংকর কর্মকান্ডও।
কংগ্রেস এবং ব্রিটিশ সরকার একে ‘দাঙ্গা’ নামে অভিহিত করেছিল। ‘দাঙ্গা’ সাধারণত তাকেই বলা হয় যেখানে দুটি প্রায় সমান শক্তিশালী পক্ষ জড়িত থাকে। অন্যদিকে প্রমাণিত সত্য হলো, ১৯৪৬ সালের কথিত এই ‘দাঙ্গা’য় প্রাণ হারিয়েছিল প্রধানত মুসলমানরা। তাদের সংখ্যাও কয়েক হাজার মাত্র ছিল না। বলা হয়, লাখে লাখে মারা গিয়েছিল মুসলমানরা। এ প্রসঙ্গে মিস্টার গান্ধীর ভূমিকা উল্লেখ না করলেই নয়। ‘গান্ধী’ নামের সিনেমায় যা-ই দেখানো হোক না কেন, তিনি কিন্তু কোলকাতা ও বিহারের মতো শহর ও রাজ্যগুলোতে তৎপরতা চালাননি- যেসব এলাকায় মুসলমানদের ‘কচু কাটা’ করা হয়েছিল। তিনি বরং ঝড়ের বেগে এসে হাজির হয়েছিলেন তখনও পর্যন্ত অখ্যাত নোয়াখালী জেলার ছাগলনাইয়া এলাকায়- যেখানে জনা কয়েক হিন্দুকে মেরে ফেলা হয়েছিল বলে শোনা গিয়েছিল। মিস্টার গান্ধীর মতো জনপ্রিয় এবং প্রধান নেতা চলে আসায় এমন প্রচারণা চালানো সহজে সম্ভব হয়েছিল যে, মুসলমানরা নিষ্ঠুর জাতি এবং তাদের দাবি অনুযায়ী পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলে সেখানে হিন্দুরা বেঁচে থাকতে পারবে না। লক্ষণীয় যে, মিস্টার গান্ধী কিন্তু ভারতের অন্য কোনো স্থানে যাননি। অথচ সারা ভারত জুড়েই তখন চলছিল মুসলমানদের ‘কচু কাটা’ করার নৃশংস কর্মকান্ড। এতটাই ‘মহাত্মা’ ছিলেন মিস্টার গান্ধী!
এ প্রসঙ্গে চমৎকার কিছু তথ্য রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অতি বিশ্বস্ত এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী হিসেবে শেখ মুজিব কথিত দাঙ্গাসহ সমগ্র ঘটনাপ্রবাহে অংশ নিয়েছিলেন। মুসলমানদের জীবন বাঁচানোর জন্য তিনি এমনকি বিহারে পর্যন্ত গেছেন। সে সব ঘটনার উল্লেখ করতে গিয়ে শেখ মুজিব লিখেছেন, দাঙ্গার সময় তিনি যখন বিহারে গিয়েছিলেন তখন তার সঙ্গে ছিলেন ইয়াকুব নামের এক ফটোগ্রাফার বন্ধু। এই ইয়াকুব সাহেব দাঙ্গার তথা মুসলিম নিধনের অনেক ছবি তুলেছিলেন। সে ছবিগুলো থেকেই বেছে বেছে কিছু ছবি মিস্টার গান্ধীকে ‘উপহার’ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শেখ মুজিব। তিনি লিখেছেন, ‘যেমন কথা তেমন কাজ। দুইজনে বসে পড়লাম। তারপর প্যাকেটটা এমনভাবে বাঁধা হল যে, কমপক্ষে দশ মিনিট লাগবে খুলতে। আমরা তাঁকে (মিস্টার গান্ধীকে) উপহার দিয়েই ভাগব।’ শেখ মুজিব এরপর লিখেছেন, ‘এই ফটোর মধ্যে ছিল মুসলমান মেয়েদের স্তন কাটা, ছোট শিশুদের মাথা নাই, শুধু শরীরটা আছে, বস্তি, মসজিদে আগুন জ্বলছে, রাস্তায় লাশ পড়ে আছে, এমনই আরও অনেক কিছু। মহাত্মাজী দেখুক, কিভাবে তার লোকেরা দাঙ্গাহাঙ্গামা করেছে এবং নিরীহ লোককে হত্যা করেছে।’
এ সময় উদযাপিত ঈদের দিন কলকাতার নারকেলডাঙ্গায় অবস্থানরত মিস্টার গান্ধীকে সত্যি সত্যিই ছবিগুলোর প্যাকেটটি ‘উপহার’ দিয়ে এসেছিলেন শেখ মুজিব। মিস্টার গান্ধী তাদের কয়েকটি আপেল খেতে দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘আমরা উপহার দিয়ে চলে এলাম তাড়াতাড়ি হেঁটে। ... বন্ধু ইয়াকুবের এই ফটোগুলি যে মহাত্মা গান্ধীর মনে বিরাট দাগ কেটেছিল তাতে সন্দেহ নাই।...’ (দেখুন, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃষ্ঠাÑ৮১-৮২)
এ পর্যন্ত এসে পাঠকদের মনে হতে পারে, গান্ধীর সমালোচনাই সম্ভবত নিবন্ধের উদ্দেশ্য। আসলে তা নয়। এখানে বরং একটি সত্যই তুলে ধরতে চাই। সে সত্যটুকু হলো, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগকালে সবদিক থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানকেÑ আজকের বাংলাদেশকে। এর পেছনেও ছিল ‘মহাত্মা’ গান্ধীর অতি কৌশলী ভ’মিকা। দীর্ঘ সে ইতিহাসের আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। পাঠকরা মরহুম আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ গ্রন্থটি পড়ে দেখতে পারেন। ইংরেজি দৈনিক দ্য স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনামের পিতা এবং প্রখ্যাত রাজনীতিক-সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ ব্রিটিশ ভারতে প্রথমে শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক-প্রজা পার্টির এবং পরে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী করে সরকার গঠন করার পর তিনি কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী হয়েছিলেন। একাধিকবার ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। তার গ্রন্থ ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ এখনো এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস জানার একটি প্রধান অবলম্বন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সম্পর্কে তো বটেই, বিশেষ করে ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগকালীন ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কেও বিস্তারিতভাবে লিখেছেন আবুল মনসুর আহমদ।
‘কলিকাতার দাবি’ শিরোনামে এক উপ-অধ্যায়ে তিনি জানিয়েছেন, ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে কোন কোন এলাকা আসবে সে বিষয়ে ইংরেজ গভর্নর স্যার আর জে ক্যাসির সঙ্গে কথা বলেছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। গভর্নর ক্যাসি প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে জানিয়েছিলেন, কোলকাতা এবং দার্জিলিং হবে উভয় বাংলার অর্থাৎ ভারতের বর্তমান রাজ্য পশ্চিম বঙ্গ এবং পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের ‘কমন’ শহর। এছাড়া কোলকাতা সংলগ্ন চব্বিশ পরগণার বারাকপুর, বারাসত, ভাঙ্গর ও বশিরহাটসহ বেশ কিছু এলাকা পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়ার কথা ছিল। অন্য সব সূত্রেও জানা গেছে, পলাশী যুদ্ধের জন্য বিখ্যাত মুর্শিদাবাদ এবং করিমগঞ্জসহ আসামের বিরাট অঞ্চলও পূর্ব পাকিস্তানকে দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে মিস্টার গান্ধীর নেতৃত্বে এবং ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু ও প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভভাই প্যাটেলদের মারপ্যাঁচ এবং ইংরেজ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পূর্ব পাকিস্তান সর্বাত্মকভাবে বঞ্চিত হয়েছিল। এই বঞ্চনা শুধু অঞ্চল না দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, ক্ষতিপূরণ বাবদ নগদ অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। উদাহরণ দেয়ার জন্য আবারও আবুল মনসুর আহমদের ওই গ্রন্থের সাহায্য নেয়া যায়। তিনি জানিয়েছেন, কথা ছিল, কোলকাতার বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে নগদে ৩৩ কোটি টাকা দেয়া হবে। ঢাকাকে আন্তর্জাতিক মানে রাজধানী হিসেবে সাজিয়ে তোলার খরচ হিসেবে তখনকার দিনে ৩৩ কোটি টাকা যথেষ্ট ছিল। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে নেহরু-প্যাটেলরা চাণক্য হিসাবের কূটচাল চেলেছিলেন। তারা বলেছিলেন, কোলকাতার বিভিন্ন স্থাপনার দাম নির্ধারণ করা হবে ‘বুক ভ্যালু’র ভিত্তিতে। অর্থাৎ যখন যেটা নির্মিত হয়েছিল তখন যত টাকা খরচ হয়েছিল সেটাই হবে বিনিময় মূল্য। অন্যদিকে পাকিস্তানপন্থীরা ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলেন ওই সময়ের অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের বাজার দরে। এর ভিত্তিতে টাকা দিতে গেলে ভারতকে শত কোটি টাকার ওপর গুণতে হতো। এজন্যই নেহরু-প্যাটেলরা ‘বুক ভ্যালু’র তত্ত্ব এনেছিলেন। বাস্তবে পূর্ব পাকিস্তান কিন্তু ‘বুক ভ্যালু’র ভিত্তিতেও টাকা পায়নি। কারণ, এরই মধ্যে আবার ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ পূর্ব পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শহরের বিনিময়ে অর্থ দাবি করেছিলেন নেহরু-প্যাটেলরা। রীতিমতো অংক কষে তারা দেখিয়েছিলেন, ভারতের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের পাওনার পরিমাণ মাত্র তিন কোট টাকা; অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের কাছে ভারতের পাওনার পরিমাণ নয় কোটি টাকা। অর্থাৎ শত কোটি বা ৩৩ কোটি টাকা পাওয়া দূরে থাকুক, পূর্ব পাকিস্তানকেই উল্টো ছয় কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে! এমন এক বিচিত্র পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, “সত্য যুগে ছিল : ‘শুভঙ্করের ফাঁকি, তেত্রিশ থনে তিনশ গেলে তিরিশ থাকে বাকি’; আর কলিযুগে : ‘শুভঙ্করের ফাঁকি, তেত্রিশ থনে শূন্য গেলে দেনা থাকে বাকি’! (‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’, পৃষ্ঠাÑ ২৫৭-২৬৭)
বলা দরকার, নেহরু-প্যাটেলদের কূটকৌশলই পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অন্য একটি বিশেষ কারণও। পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙ্গালী নেতৃত্বের পূর্ব বাংলা বিরোধী নীতি-কৌশলের সুযোগে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন ভারতের শেষ ইংরেজ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন। তার স্ত্রীর সঙ্গে আগে থেকেই নেহরুর প্রশ্নসাপেক্ষ ও রহস্যময় সম্পর্ক ছিল। তার ওপর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজেই পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হয়ে বসায় মাউন্টব্যাটেন খুবই ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তার  ইচ্ছা ছিল, তিনি ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রেরই গভর্নর জেনারেল হবেন। ভারত এতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু অস্বীকার করেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। এ অসন্তোষেরই ঝাল ঝেড়েছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক অনেক তথ্যেরই উল্লেখ করা এবং বিভিন্ন গ্রন্থের উদ্ধৃতি দেয়া সম্ভব। এখানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেয়া যাক। দেশ বিভাগকালীন ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দিতে গিয়ে শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘বড়লাট মাউন্টব্যাটেন তলে তলে কংগ্রেসকে সাহায্য করছিলেন। (জিন্নাহ নিজেই গভর্নর জেনারেল হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর) মাউন্টব্যাটেন ক্ষেপে গিয়ে পাকিস্তানের সর্বনাশ করার চেষ্টা করলেন।...’ (পৃষ্ঠাÑ ৭৪) শেখ মুজিব আরো লিখেছেন, ‘... মাউন্টব্যাটেন সুযোগ পেয়ে যশোর জেলায় সংখ্যাগুরু মুসলমান অধ্যুষিত বনগাঁ জংশন অঞ্চল কেটে দিলেন। নদীয়ায় মুসলমান বেশি, তবু কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট জংশন ওদের দিয়ে দিলেন। মুর্শিদাবাদে মুসলমান বেশি কিন্তু সমস্ত জেলাই দিয়ে দিলেন। মালদহ জেলায় মুসলমান ও হিন্দু সমান সমান তার আধা অংশ কেটে দিলেন, দিনাজপুরে মুসলমান বেশি বালুরঘাট মহকুমা কেটে দিলেন যাতে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং হিন্দুস্থানে যায় এবং আসামের সাথে হিন্দুস্থানের সরাসরি যোগাযোগ হয়। উপরোক্ত জেলাগুলি কিছুতেই পাকিস্তানে না এসে পারতো না। এদিকে সিলেটে গণভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও (লর্ড মাউন্টব্যাটেন) মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ করিমগঞ্জ মহকুমা ভারতবর্ষকে দিয়েছিলেন। আমরা আশা করেছিলাম, আসামের কাছাড় জেলা ও সিলেট জেলা পাকিস্তানের ভাগে না দিয়ে পারবে না। আমার বেশি দুঃখ হয়েছিল করিমগঞ্জ নিয়ে।... যে কলকাতা পূর্ব বাংলার টাকায় গড়ে উঠেছিল সেই কলকাতা আমরা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম।...কলকাতা পাকিস্তানে থাকলে পাকিস্তানের রাজধানী কলকাতায় করতে বাধ্য হত। কারণ, পূর্ব বাংলার লোকেরা দাবি করত, পাকিস্তানের জনসংখ্যায়ও তারা বেশি আর শহর হিসাবে তদানীন্তন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ শহর কলকাতা।...’ (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃষ্ঠা- ৭৮-৭৯)
দেখা গেলো, বয়সে প্রবীণ আবুল মনসুর আহমদ থেকে কিছুটা নবীন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত প্রত্যেকেই যে বর্ণনা দিয়েছেন সে অনুযায়ী বিভাগকালে পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে ব্যাপকভাবেই বঞ্চিত হয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে এখানে ঐতিহাসিক অন্য কিছু তথ্যেরও উল্লেখ করা দরকার। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ভারতের বঙ্গ নামক কোলকাতাকেন্দ্রিক প্রদেশের অংশ ছিল। পরিচিতি ছিল ‘পূর্ব বঙ্গ’ নামে। কিন্তু ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে মুসলিম প্রধান এ অঞ্চলের সঙ্গে মূল ভারতের দ্বন্দ্ব ক্রমাগত বাড়তে থাকে। দু’-চারজন ছাড়া জমিদারদের প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু। মুসলমান কৃষকদের ওপর হিন্দু জমিদাররা যথেচ্ছ শোষণ-নির্যাতন চালাতেন। মুসলমানরা এমনকি জমিদার বাড়ির আশপাশ দিয়ে জুতো পরে বা ছাতা মাথায় দিয়ে যাতায়াত করতে পারতেন না। ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি ছিল হিন্দুদের দখলে। শিক্ষাতেও হিন্দুরাই একচেটিয়াভাবে এগিয়ে ছিল। সব মিলিয়েই মুসলমানরা ছিলেন নির্যাতিত, উপেক্ষিত ও পশ্চাদপদ অবস্থায়। হিন্দুদের প্রাধান্য বহাল রেখে মুসলমানদের পক্ষে যেহেতু উন্নতি-অগ্রগতি অর্জন করা একেবারেই সম্ভব ছিল না, সেহেতু মুসলিম প্রধান পূর্ব বঙ্গ ও প্রতিবেশী রাজ্য আসামকে নিয়ে পৃথক একটি প্রদেশ গঠনের দাবিতে মুসলমানরা আন্দোলন গড়ে তোলেন। আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার ১৯০৫ সালে পূর্ব বঙ্গ ও আসামকে নিয়ে নতুন একটি প্রদেশ গঠন করে। ঢাকাকে এর রাজধানী করা হয়। এটাই ইতিহাসে ‘বঙ্গভঙ্গ’ নামে পরিচিত। এর ফলে ঢাকাসহ বর্তমান বাংলাদেশের দ্রুত উন্নতি হতে থাকে। কিন্তু মুসলমানদের এই উন্নতি ও সম্ভাবনার বিরুদ্ধে হিন্দুরা পাল্টা তৎপরতা শুরু করে। কারণ, হিন্দুদের দৃষ্টিতে এটা ছিল তাদের ‘বঙ্গমাতা’কে দ্বিখন্ডিত করার পদক্ষেপ। কোলকাতায় বসবাস করে পূর্ব বঙ্গের ওপর যারা শোষণ-নির্যাতন চালাতেন এবং এখানকার অর্থবিত্ত লুন্ঠন করে নিয়ে গিয়ে সেখানে বসে যারা নাচ-গান ও আনন্দ-স্ফ’র্তি করতেন, সেই হিন্দু জমিদারদের প্রত্যক্ষ সাহায্যে ও উস্কানিতে সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ড দুর্বার হয়ে ওঠে। হিন্দুরা একে সন্ত্রাসবাদী ‘আন্দোলন’ নাম দেয়। এ সময়ই বঙ্গভঙ্গের তথা বাংলাদেশের বিরোধিতা করে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি লিখেছিলেন। উল্লেখ্য, হিন্দুদের সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডে ভীত হওয়ার অভিনয় করে মুসলিম-বিরোধী ব্রিটিশ সরকারও হিন্দুদের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করে। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়, ঢাকাসহ পূর্ব বঙ্গ আবারও কোলকাতার এবং হিন্দুদের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। হিন্দুদের মধ্যে যে ‘বঙ্গমাতা’র জন্য প্রীতির লেশমাত্র ছিল না এবং মুসলিম বিদ্বেষই যে ‘বঙ্গভঙ্গ’ বিরোধিতার প্রধান কারণ ছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেছে একটি বিশেষ ঘটনায়। সন্ত্রাসের অভিযোগে শত বছরের রাজধানী কোলকাতাকে পরিত্যাগ করে ব্রিটিশ সরকার এ সময় ভারতের রাজধানী নিয়ে গিয়েছিল দিল্লিতে। কিন্তু হিন্দুরা কোনো প্রতিবাদই করেনি। এ ব্যাপারেও রবীন্দ্রনাথের উদাহরণ না দিয়ে উপায় নেই। ‘বাঙালী’ হিসেবে দায়িত্ব যেখানে ছিল রাজধানী সরিয়ে নেয়ার বিরোধিতা করা, রবি ঠাকুর সেখানে উল্টো ইংরেজ রাজার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বিনয় ও ভক্তির ন্যক্কারজনক প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। রাজাকে ভারতের ‘ভাগ্য বিধাতা’ হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছিলেন ‘জয় হে, জয় হে!’ উল্লেখ্য, ‘ভাগ্য বিধাতা’ ও ‘জয় হে’যুক্ত রবীন্দ্রনাথের সে গানটিই এখন ভারতের জাতীয় সংগীত! বলা দরকার, ‘বাঙালী’ রবীন্দ্রনাথরা মুসলিম বিরোধী ইংরেজের কাছে মাথ নত করে ধন্য হলেও ভারতীয় মুসলমানদের হিন্দু ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ক্রমাগত আরো শক্তিশালী ও সর্বাত্মক হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে সেটাই মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমির আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ছিল সে আন্দোলনেরই সফল পরিণতি। পরবর্তীকালে ‘পশ্চিম পাকিস্তান’কেন্দ্রিক শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করলেও বাংলাদেশের জনমনে ভারত সম্পর্কে মনোভাবে পরিবর্তন ঘটেনি। ভারত নিজেই তা ঘটতে দেয়নি। ভারত বরং শত্রুতাপূর্ণ আচরণ করেছে। ভারতীয়দের নীতি-অবস্থান ও কর্মকান্ড যে এখনো একই রকম রয়েছে তার প্রমাণ ও উদাহরণ উল্লেখ করতে হলে পৃথক কয়েকটি নিবন্ধ লিখতে হবে। সুতরাং আজ এ পর্যন্তই।
শেষ করার আগে শুধু দুটি তথ্য জানিয়ে রাখা দরকার- ১. স্বাধীন হলেও রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এখনো ভৌগোলিক দিক থেকে অসম্পূর্ণ রয়েছে; এবং ২. সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতে মুসলমানদের বিপদ বাড়ছে ক্রমাগত।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ