শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

দেড় সহস্রাধিক শ্রমিক-কর্মচারি পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন

 

খুলনা অফিস : খুলনার শিরোমনি বিসিক শিল্প নগরীর ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান জুট স্পিনার্স এক বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এতে করে এ প্রতিষ্ঠানের দেড় হাজার শ্রমিক পরিবারে চরম হতাশা বিরাজ করছে। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় সন্ধ্যার পর এখানে ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বেতন না পেয়ে নিরাপত্তা কর্মীদেরও অনেকেই চলে গেছে। কয়েকজন শ্রমিককে দিয়েও নিরাপত্তাকর্মীর দায়িত্ব পালন করানো হচ্ছে। অথচ প্রধান গেটে এখনও লেখা রয়েছে মিলটি আন্তর্জাতিক মানদন্ড প্রতিষ্ঠান (আই এস ও) সনদপ্রাপ্ত। শতভাগ রফতানীযোগ্য পণ্য উৎপাদনকারী এ মিলটি মালিক পক্ষের পারিবারিক কলহের ফলেই বন্ধ রয়েছে এমনটিও জানিয়েছেন শ্রমিকরা। তবে মিল ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম জানান, মালিকের পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে মিলটি চালানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যথাসম্ভব দ্রুততম সময়ের মধ্যে মিলটির উৎপাদন স্বাভাবিক হবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

বিসিক শিল্প নগরীর ওই মিল গেটে গিয়ে দেখা যায়, গেট বন্ধ রয়েছে। সাইনবোর্ডে আই এস ও সনদপ্রাপ্ত কথাটি লেখা থাকলেও গেট থেকে যে দীর্ঘদিন মানুষ বা কোন প্রকার যানবাহন চলাচল করে না সেটি সহজেই আঁচ করা যায়। সামনের এবড়ো-থেবড়ো রাস্তার মাঝেমধ্যে বৃষ্টির পানি জমে আছে। পার্শ্ববর্তী অপর একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কাজ খুঁজে নিয়েছেন মিলটির একজন শ্রমিক বললেন, মিলের অনেক শ্রমিক পরিবারেই নিরব কান্না চলছে। একজন শ্রমিকের পরিবারের করুণ অবস্থার কথা তুলে ধরে তিনি জানান, ‘তার দু’টি মেয়ের লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ঠিকমত খেতে দিতে পারছেন না তাদের মুখে, কারও কাছে হাতও পাততে পারছেন না, আমরাতো অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারছি, অথচ তার বিকল্প কোন আয়ের পথও নেই।’

মিলের সাথে সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানায়, বিগত প্রায় এক বছর ধরে মিলটির উৎপাদন বন্ধ থাকলেও দেড় মাস আগে এর বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়। বর্তমানে প্রায় ৩৪ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল, সাত কোটি টাকার পাটের বিল এবং বিসিক শিল্প নগরীরও প্রায় কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এছাড়া শ্রমিকদের মজুরি কমিশনের বকেয়া ও ইনক্রিমেন্টসহ অনেক খাতে মিলটির ঋণ রয়েছে। কিন্তু সর্বমোট কত টাকা দেনা রয়েছে তা’ জানাতে পারেননি মিল ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম। এমনকি মিলটি চালু হতে পারে কবে নাগাদ তাও তিনি স্পষ্ট কিছু জানাতে পারেননি। শুধু বলেছেন, মালিক পক্ষের পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা চলছে। বিক্রি হলেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে মিলটি উৎপাদনে যাবে।

মিলের সিবিএ সভাপতি আবুল কালাম বলেন, মিলটির অবস্থা খুবই খারাপ। বিগত ১২ মাস ধরে কাগজে-কলমে মিল বলে কিন্তু কোন উৎপাদন নেই। বেতন-মজুরীও নেই নয় মাস যাবত। শ্রমিকদের মধ্যে যারা হাজিরা দিচ্ছে তাদের হাজিরা হচ্ছে। অন্যরা কেউ দিন মজুরী আবার কেউ রিক্সা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে। মালিক পক্ষের সাথে তাদের কথা হয়েছে এবং জুলাই মাসে মিলটি চালানো হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর আগে রমজান শুরুর সময় এক সপ্তাহের মজুরী ও এক মাসের বেতন এবং ঈদুল ফিতরের আগে এক সপ্তাহের মজুরী ও এক মাসের বেতন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে মালিক পক্ষের পক্ষ থেকে। মালিকের অন্য জমি বিক্রি করে এ মিলটি চালানোর প্রস্ততি চলছে বলেও তিনি জানান।

মিলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম বলেন, মালিক পক্ষের পারিবারিক কলহ, অদক্ষ ম্যানেজমেন্ট এবং সিবিএ’র অদূরদর্শিতার কারণে জুট স্পিনার্সের আজ এমন করুণ দশা। এ থেকে শ্রমিক-কর্মচারীরা আদৌ মুক্ত হতে পারবে কি না সেটিও অনিশ্চিত।

এদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সাধারণ শ্রমিক জানান, মহান মে দিবসের দিন মিল গেটে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সিবিএ নেতারা তিন মাসের সময় চেয়েছেন। তাদের কাছে নাকি মালিক পক্ষ তিন মাসের মধ্যে মিলটি চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে সিবিএ নেতারা চারমাস ধরে ঢাকায় পড়েছিলেন। তারা সেখানে কি করেছেন এটিও জানতে চান অনেকে। মে দিবসের সভা থেকে এসব বিষয় প্রশ্ন আসতে পারে এমনটি আঁচ করতে পেরে খানজাহান আলী থানা পর্যায়ের ক্ষমতাসীন দলের একজন শীর্ষ নেতার হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি বেশিদূর গড়ায়নি। তবে পরদিন এ নিয়ে ত্রি-পক্ষীয় বৈঠক থেকেই সিবিএ নেতাদের সাথে অপর পক্ষের সমঝোতা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯৮২ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ জুট এন্ড টুয়াইন মিল মালিক সমিতির সভাপতি মো. শামসুল হক সম্পূর্ণ ব্যক্তি মালিকানাধীন এ মিলটি প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি পরে বিশ্বের এক নম্বর টুয়াইন মিল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। শতভাগ রপ্তানীমুখী এ মিলটির প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর পর তার ছেলেরা মিলটি চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু দু’ভাইয়ের পারিবারিক বিরোধের জের ধরেই এক বছর ধরে মিলটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ১২ একর জমির ওপর স্থাপিত মিলটির তিন একর বিসিকের এবং বাকী নয় একর কেডিএ’র। সাড়ে ৮শ’ স্থায়ী শ্রমিকসহ মিলটিতে বর্তমানে দেড় হাজার শ্রমিক-কর্মচারী রয়েছে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ