মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

বনানীর হোটেলে যুগল ছাত্রী ধর্ষণ

ঢাকা মহানগরীর বনানীর রেইনট্রি হোটেল ও রেস্তোরাঁয় জন্ম দিনের পার্টিতে দাওয়াত দিয়ে বেসরকারি বিশ্ব বিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় গত কয়েক দিন দেশের সামাজিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ঘটনাটিকে ধিক্কার জানিয়ে দেশের বিশিষ্টজন ও মানবাধিকার কর্মীরা মুখ খুলেছেন এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক তার সংস্থার তরফ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে তার প্রাথমিক রিপোর্টে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়ার তথ্য জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে পুলিশ অভিযুক্ত পাঁচজন আসামীর মধ্যে দু’জন তথা সাফাত আহমদ ও সাদমান সাকিফকে সিলেট থেকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে। রিমান্ডের প্রথম দিনেই গ্রেফতারকৃতরা ধর্ষণের দায় স্বীকার করে বক্তব্য দিয়েছে বলে মামলার তদারক কর্মকর্তা ও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের এডিসি আসমা সিদ্দিকা মিলিল বরাত দিয়ে একটি দৈনিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। বাকী তিন আসামীর গতিবিধি এবং তাদের গ্রেফতার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি অথবা থানায় মামলা নেয়ায় বিলম্ব কিংবা মামলার বাদী ও ধর্ষণের শিকার ছাত্রীদের বিভিন্নভাবে হয়রানির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। বলাবাহুল্য, ধর্ষিতাদের একজন অভিযোগ করেছেন যে মামলা করতে গিয়ে তিনি থানায় যেভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন তা ধর্ষণের চেয়েও ছিল ভয়াবহ।
জানা গেছে যে দুই ছাত্রী ধর্ষণের মামলার তদন্তের সাথে আরো কিছু ঘটনার তদন্তও যুক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে হোটেলটি চালুর বৈধতা এবং আপন জুয়েলার্সের স্বর্ণ আমদানির বিষয়টিও। তদন্তে একাধিক বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি মূল মামলাকে গৌণ করে তুলবে কিনা এ বিষয়টি অনেককেই ভাবিয়ে তুলছে। তবে বাপ-বেটার দু’টি মন্তব্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা গোটা প্রশাসন এবং আমাদের সমাজবিদদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমদ সেলিমের পুত্র সাফাত আহমদ ধর্ষণ মামলার অন্যতম প্রধান আসামী। সাংবাদিকরা তার পুত্রের অপরাধ সম্পর্কে তার মন্তব্য জানতে চেয়েছিলেন। উত্তরে তার মন্তব্য ছিল “এটা তো সামান্য আমোদ ফুর্তির ব্যাপার। জোয়ান পোলাপান, এরা তো কিছু করবেই, আমিও করি। বয়স হলেও আমার কি যৌবন ফুরিয়ে গেছে।” অন্যদিকে পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী গ্রেফতার হবার সময় আসামী সাফাত আহমদ চিৎকার দিয়ে বলেছিল ‘তোমরা আমার কিছুই করতে পারবে না। আমার বাবার সোনার দোকান আছে। এয়ার পোর্টের চোরা চালানের সব সোনা কোথায় যায়। আমরা জানি এবং সব সোনা আমার বাবার। তাদের বাপ-বেটার বেপরোয়া কথাবার্তার মধ্যে একটি বিষয় ফুটে উঠেছে, তা হচ্ছে প্রচলিত মূল্যবোধ, তা ধর্মীয় হোক কিংবা ধর্ম বহির্ভূত, তার সাথে তাদের সম্পর্ক নেই। পিতা যেমন ব্যভিচারী পুত্রকেও তেমনিভাবে গড়ে তুলেছেন। আবার স্বর্ণের চোরাচালানি হিসেবে আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এবং আইনের লোকদের কিনে নিয়ে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে দেশকে তারা অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছেন। পুত্রের ধর্ষণের প্রতিক্রিয়ায় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমদ সেলিম যা বলেছেন তা ধর্ষণের অপরাধকে ম্লান করে দেয়, পিতা কর্তৃক পুত্রকে ধর্ষণে উৎসাহিত করে।
আমাদের সমাজে তার মতো আরো অনেক ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ আছেন যারা ধর্ষণ-ব্যভিচারকে তাদের অধিকার বলে মনে করেন। হারাম রোজগার মানুষকে হারাম পথেই ধাবিত করে, এটা তার একটা লক্ষণ, এর সাথে ক্ষমতারও একটা সম্পর্কে রয়েছে। যুগে যুগে ক্ষমতাসীনরা মসনদে টিকে থাকার জন্য যুব সমাজকে কলুষিত করে তাদের সমর্থনে বাধ্য করে। তারা তাদের ক্ষমতার অংশীদার বানায়, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের কাছে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করে এবং এক পর্যায়ে ‘মিলেমিশে’ ক্ষমতার অপব্যবহার, বলপূর্বক অন্যের সম্পত্তি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ঘুষ-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে সহায়তা করে। অবৈধ অর্থের সাথে পেশীশক্তি মিলিত হলে মদ ও ব্যভিচারে তারা আসক্ত হয় এবং তারা সকল মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে। ছাত্রলীগের নামে দেশব্যাপী যারা নৈরাজ্যের সৃষ্টি করছে এবং ব্যভিচারে লিপ্ত হচ্ছে তারা এদেরই বংশধর।
২০১০ সালে ইডেন গার্লস কলেজ, বদরুন্নেছা কলেজ ও আনন্দ মোহন কলেজের মেয়েদের উপর ছাত্রলীগের অত্যাচার এবং এক পর্যায়ে নির্যাতিতা মেয়েদের সংবাদ সম্মেলন করে লীগ নেতৃবৃন্দ কর্তৃক তাদের অনৈতিক কাজে অংশগ্রহণে বাধ্য করার অভিযোগটি দেশবাসীর জন্য একটি সতর্ক সংকেত ছিল। কলেজ ছাত্রীদের অভিযোগ অনুযায়ী ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে রাত কাটানোর জন্য তাদেরকে বাধ্য করা হতো। হোস্টেলের যেসব মেয়ে এতে রাজি হতো না তাদের উপর চরম নির্যাতন চালানো হতো। আমরা সমাজপতিরা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা রাষ্ট্রের কর্ণধাররা এই অভিযোগকে আমলে নেইনি। অনেকে অবিশ্বাস্য বলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সাত বছর পর আজ আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আপন ব্যভিচারের যে স্বীকৃতি দিলেন তা ৭ বছর আগে করা ইডেন কলেজ ছাত্রীদের অভিযোগকেই সত্য বলে attest করার নামান্তর। ধর্ষণ-ব্যভিচারকে স্বাভাবিক মনে করার ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ। এই স্বাভাবিকতার অনুভূতিতে যারা ‘আক্রান্ত’ হয় তাদের মধ্য থেকে আপন-পরের অনুভূতি লোপ পায়। পাশ্চাত্য জগতে এই অনুভূতি থেকেই পরিবারে ভাঙ্গন এসেছে, নীতি-নৈতিকতা লোপ পেয়েছে, বৈধ সন্তানের স্থান জারজ সন্তান দখল করেছে, পরিবারে ঢুকেছে  incest নামক ব্যাধি যার ফলে মার সম্ভ্রম পুত্রের কাছে, বোনের সম্ভ্রম ভাইয়ের কাছে এমনকি কন্যার সম্ভ্রম পিতার কাছেও নিরাপদ নয়। আমরা কি ধর্মহীন পাশ্চাত্যের ব্যভিচারী সমাজে প্রবেশ করতে যাচ্ছি?
এখন মূল আলোচনায় ফিরে আসি। অনেকে প্রশ্ন করেছেন এবং আমারও একই প্রশ্ন, বনানীর হোটেলে আত্মীয় বহির্ভূত অচেনা ব্যক্তির বা চেনা যুবকের নিমন্ত্রণে দুটি সোমত্ত মেয়ে জন্মদিবসের পার্টিতে গিয়ে ধর্ষিত হলো এবং থানায় মামলা করলো। থানায় মামলা নিল না। পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমগুলো এর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং অকুস্থল রেইন ট্রি হোটেলের মালিকানার সাথে এক এগারোর অন্যতম নায়ক জেনারেল (অব.) মাসুদুদ্দিন চৌধুরীকে টেনে আনল। ব্যাপক হৈ চৈ শুরু হলো। আবার জানা গেল হোটেলটি অবৈধ এবং তার মালিক একজন আওয়ামী এমপি। ধর্ষকদের বাপ-দাদার তথ্য উঠে আসলো, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ইতিহাসও আসলো। কিন্তু বনানীর বাইরের ধর্ষণগুলো- এমনকি যেগুলো আরো ভয়াবহ সেগুলোর ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে কেন নিস্ক্রিয় দেখা গেল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের যে ছেলেটি ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালন করতে গিয়ে বন্ধু-বান্ধবদের ক্যান্টিনে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য ছাত্রীর সর্বনাশ করলো তার শাস্তি তারা নিশ্চিত করলো না কেন? কারা ঐ বদমাশ ছেলেটিকে সুইডেন পাঠিয়ে দিয়েছিল? হতভাগিনী ধর্ষিতা মেয়েগুলোর পেছনে শক্ত কোন খুঁটি ছিল না বলে? এই তো সেদিন এপ্রিল মাসের ২৯ তারিখে হযরত আলী নামক এক হতভাগা পিতা তার মেয়ে আয়েশাকে ধর্ষকদের হাত থেকে বাঁচাতে না পেরে এবং বিচার পাবার কোনও নিশ্চয়তা না পেয়ে বাপ-বেটি দুজনই ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলেন। কই ঐ ঘটনাটি নিয়ে তো আমরা একটা কার্যকর প্রতিবাদ পর্যন্ত করিনি। দেশের একটি নামীদামী স্কুলের নাম ভিকারুন্নেসা বালিকা স্কুল ও কলেজ। এই স্কুলের শিক্ষক কুলাঙ্গার পরিমল কোচিং সেন্টার খুলে কত মেয়ের সর্বনাশ করেছে তার পরিপূর্ণ পরিসংখ্যান কি আমরা নিয়েছি অথবা এই অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিকে দৃষ্টান্তমূলক কোনও শাস্তি কি দেয়া হয়েছে? পরিমলের অকর্মটি ফাঁস হয়ে যাবার পর দেখা গেছে, সারা দেশে অসংখ্য পরিমল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান/কোচিং সেন্টার খুলে ধর্ষণ ব্যভিচারের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। নির্যাতিতা ছাত্রী ও তার অভিভাবকরা চোরের কিল গোপনে হজম করছে, কিছু বলতে পারছে না। দেশব্যাপী ধর্ষণ-ব্যভিচারের এই মহড়া সরকার বন্ধ করতে পারেন নি। ভারত, মিয়ানমার থেকে আসা যৌন উত্তেজক ইয়াবা ও অন্যান্য মাদক সামগ্রী বরং এই তৎপরতাকে আরও উৎসাহিত করছে। ধর্ষণ হচ্ছে প্রচণ্ড রকমের সহিংসতা ও মেয়েদের সতিত্ব লংঘনের ঘটনা। এটা এতবড় অপরাধ যে, এর ফলে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে। এই অপরাধের শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। ধর্ষণ-ব্যভিচারকে প্ররোচিত করে এমন কারণগুলোও চিহ্নিত করে সমাজ থেকে সেগুলো দূর করা প্রয়োজন। সহশিক্ষা ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা এবং মেয়েদের আঁটসাঁট পোশাক পরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রদর্শনী, অশ্লীল চলাফেরা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রসমূহে, ঝোপ-জঙ্গলের আড়ালে একজন আরেকজনের গায়ে হেলান দিয়ে বা কোলে মাথা রেখে আপত্তিকর তৎপরতায় লিপ্ত থাকা প্রভৃতি বন্ধ করা অপরিহার্য।
ইসলামে ধর্ষণ-ব্যভিচারের শাস্তি অত্যন্ত গুরুতর। আমি দুঃখিত, আমাদের আলেম সমাজ এ ব্যাপারে খুব একটা উচ্চবাচ্য করছেন বলে মনে হয় না। প্রতি শুক্রবার জুময়ার খুতবায় ধর্ষণব্যভিচারের বেলায় ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ও তার শাস্তি সম্পর্কে ইমাম সাহেবরা কিছুটা হলেও আলোচনা রাখলে আমাদের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পেতো।
ইসলামী পরিভাষায় ধর্ষণকে বলা হয় ইগতিসার। এখানে ধর্ষণকারীর কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। অবিবাহিত পুরুষ নিরস্ত্র অবস্থায় ধর্ষণ করলে ১০০ দোররা ও এক বছরের জন্য দেশান্তরের শাস্তি রয়েছে। বিবাহিত পুরুষ হলে মাটিতে পুঁতে তাকে হত্যা করাই হচ্ছে এর শাস্তি। ধর্ষক বিবাহিত হোক বা অবিবাহিত, অস্ত্র বা ছুরি ঠেকিয়ে ধর্ষণ করলে তা আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সামিল বলে গণ্য করা হয়। এ জন্য তাকে বা তাদের হয় হত্যা করা হবে, না হয় পেছন দিক থেকে হাত পা কেটে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে, ইসলামী আইন চালু করে দেখুন ধর্ষকরা কোথায় যায়! জাতিকে কলঙ্ক মুক্ত রাখতে হলে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া অপরিহার্য।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ