কুরআনকে ভালবাসার এক অনুপম উপমা
-সুমাইয়্যা সিদ্দীকা
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। মহান আল্লাহর এক জীবন্ত মুজিযা। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্ববাসীর জন্য অনন্য এক উপহার। আসমানের নিচে ও যমীনের উপরে যার সমতূল্য আর কিছু নেই। যার মূল আলোচ্য বিষয় মানুষ। হ্যাঁ, প্রিয় পাঠক! আমি, আপনি , আমরা। কি অবাক হচ্ছেন, তাই না। সত্যিই আমাদের জন্যই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এই অমূল্য উপহার। দুনিয়ার দৈনন্দিন জীবনে চলার গাইডবুক হিসেবেই মহান আল্লাহ তার প্রিয় রাসূল (সা) কে আমাদের জন্য এই কুরআন দিয়েছেন। যুগে যুগে কুরআনের দাওয়াত গ্রহণ করে পথহারা মানুষ খুঁজে পেয়েছে অনাবিল প্রশান্তি আর মর্যাদার জীবন। তবে এরপরও কুরআনের বিরোধীদের সংখ্যাও কম নয়। যুগে যুগে বিরোধীরা কুরআন ও তার অনুসারীদের বিনাশে আদাজল খেয়ে লেগেছে। আল্লাহ বলেন, “এরা (কাফেররা) তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, অথচ আল্লাহর ফয়সালা হলো তিনি তার নূরকে প্রজ্বলিত করবেনই।” (সূরা সফ : ৮)
তাইতো যখন যেখানে কুরআনের বিরোধীতা করা হয়েছে সেখানেই কুরআনপ্রেমীরাও তার প্রতিরোধে স্বর্বস্থ উজাড় করে দিয়েছে। ১১ মে “কুরআন দিবস” তেমনি কুরআনকে ভালবাসার এক অনুপম নিদর্শন।
১১ মে । ঐতিহাসিক “কুরআন দিবস”।
এক পৈশাচিক, নারকীয়, বর্বর হত্যাযজ্ঞের স্বাক্ষী যে দিনটি।
“আমি আমার এ দু‘টি আঁখি
কি করে ধরে রাখি
অঝোরে কান্না বেরিয়ে আসে
যখন মাসের পর মাস পেরিয়ে
১১ মে আসে...!”
ঘটনার শুরু যেভাবে : ঘটনার সূত্রাপাত ১৯৮৫ সালের ১০ এপ্রিল ভারতে।
ভারতের দু‘জন উগ্র সাম্প্রদায়িক নাগরিক পদ্মমল চোপরা ও শীতল সিং কুরআনের সকল আরবী কপি ও অনুবাদ বাজেয়াপ্ত করার দাবী করে কলকাতার হাইকোর্টে রিট করে। তারা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সূরা আল-বাকারার ১৯১ নম্বর আয়াত ও সূরা আত-তাওবার ৩১ নম্বর আয়াতের রেফারেন্স দিয়ে মামলা দায়ের করেছিল। তাদের দাবী ছিল-“কুরআনে যেহেতু কাফির -মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করা ও তাদের হত্যা করার কথা বলা হয়েছে, সেহেতু এটি একটি সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতা গ্রন্থ।” তাই একে বাজেয়াপ্ত করার দাবী জানায় এই দুই নরাধম।
বিচারপতি পদ্ম খস্তগিড় কোন প্রকার বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই এ মামলা গ্রহণ করেন। তিনি ১২ এপ্রিল তিন সপ্তাহের মধ্যে এফিডেভিট প্রদানের জন্য রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেন।
কুরআন বাজেয়াপ্ত করার মামলার সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই কলকাতাসহ সমগ্র বিশ্বের মুসলিমেরা প্রতিবাদের ঝড় তোলেন। যার ছোঁয়া থেকে বাদ যায়নি আমাদের ছোট্ট দেশটিও।
বাংলাদেশে যা ঘটেছিল : ভারতের প্রতিবেশী মুসলিম দেশ হওয়ায় মুহূতেই আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্রই এই ধৃষ্টতাপূর্ণ মামলার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠে সর্বশ্রেণীর মানুষ। ১০ মে জুম্মার নামাযের পর বায়তুল মুকাররম থেকে লাখো মুসল্লি এই অন্যায় মামলার বিরুদ্ধে মিছিল ও সমাবেশ করে। পুলিশ উপস্থিত জনতার উপর ব্যাপক লাঠিচার্জ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে। হায়রে মুসলিম দেশের সরকার ও তার লেঠেল পুলিশ বাহিনীর সরকার প্রীতি (!)
স্মৃতিতে অম্লান ১১ মে : সারাদেশের ধারাবাহিকতায় ১১ মে বিকাল ৩টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে ঈদগাহ ময়দানে এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। আর এখানেই ঘটনার মূল প্রেক্ষাপট। সকাল ১১ টায় সমাবেশের আহবায়ক চাঁপাইনবাবগঞ্জ আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা হোসাইন আহমদকে এসপি অফিসে ডেকে নিয়ে সমাবেশ বন্ধের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। এমনকি প্রশাসন নিজ উদ্যোগে সমাবেশের কিছু পূর্বে সমাবেশ স্থগিত হয়েছে বলে মাইকিং শুরু করে। ১৪৪ ধারা জারী করে। কিন্তু প্রশাসনের সকল বাঁধা উপেক্ষা করে সাধারণ জনতা ও ছাত্ররা শ্লোগান ও মিছিল করতে করতে ঈদগাহ ময়দানে সমবেত হতে থাকে।
‘শুধুমাত্র দোয়া করে জনতাকে শান্ত করে চলে যাবো’- নেতাদের এই আবেদনও শুনেনি ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লা। বরং উপস্থিত জনতাকে অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ শুরু করে সে। এতে উপস্থিত জনতা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। এ সময় কুলাঙ্গার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লার নির্দেশে পেটুয়া পুলিশ বাহিনী নিরস্ত্র জনতার উপরে এলোপাতাড়ি গুলি চালানো শুরু করে। ঘটনাস্থলে ও পরবর্তীতে হাসপাতালে মোট ৮ জন শাহাদত বরণ করেন। আহত হন অর্ধশতের বেশি মানুষ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাসপাতালগুলি ভরে উঠে আহত মানুষে। পুলিশ এমনই নৃশংস আচরণ করে যে গুরুতর আহতদের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে রাজশাহী হাসপাতালে নেওয়ার পথে হামলা চালায়। অহেতুক হয়রানির উদ্দ্যেশে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালায় ও নিরীহ জনতার নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করে। অথচ সুদীর্ঘ ৩৫টি বছর পার হলেও এ অন্যায় হত্যাকান্ডের কোন বিচার পায়নি দেশবাসী।
পরদিন ১৩ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঘটনায় প্রতিবাদে ফেটে সমগ্র দেশ। সারাবিশ্বের মুসলিমদের এমন দৃঢ় প্রতিবাদে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ভারত সরকার এই কালো মামলা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়। ফলে ১৩ মে কলতাতা হাইকোর্ট বিসি বাসকের আদালতে মামলাটি স্থানান্তরিত করে এটি খারিজ করে দেয়া হয়।
কুরআনকে ভালোবেসে শাহাদতের পেয়ালা পান করেন যারা : ১৯৮৫ সালের ১১ মে কুরআনকে ভালোবাসার অপরাধে বাংলার সবুজ যমীন রক্তে রাঙা হয়েছিল যাদের পবিত্র রক্তে। তারা হলেন- ১. শহীদ আব্দুল মতিন-১০ম শ্রেণী (ছাত্র), ২. শহীদ রাশিদুল হক-১০ম শ্রেণী (ছাত্র), ৩. শহীদ শীষ মোহাম্মদ- ৯ম শ্রেণী (ছাত্র), ৪. শহীদ সেলিম-৮ম শ্রেণী (ছাত্র), ৫. শহীদ শাহাবুদ্দিন-৬ষ্ঠ শ্রেণী (ছাত্র), ৬. শহীদ আলতাফুর রহমান- কৃষক, ৭. শহীদ মোক্তার হোসেন- রিক্সাচালক, ৮. শহীদ নজরুল ইসলাম- রেল শ্রমিক।
কুরআনের সংরক্ষক স্বয়ং আল্লাহ : মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে প্রতিটি যুগেই কুরআনের বিরোধীরা অবলম্বন করেছে বহু ঘৃণ্য পন্থা। কুরআনের অনুসারীদের উপর চালিয়েছে নির্যাতনের স্ট্রীমরোলার। এমনকি প্রিয় রাসূল যখন কুরআনের আলোকধারা নিয়ে দুনিয়াবাসীর সামনে আবির্ভূত হয়েছেন তাকেও বিরোধীরা চরম নাজেহাল করেছে। অশ্রাব্য -অকথ্য ভাষায় কুটূক্তি, মানসিক নির্যাতন, বয়কট, দৈহিক নির্যাতনের হাত থেকেও নিষ্কৃৃতি পাননি তিনি। এমনকি দেশত্যাগেও বাধ্য হয়েছেন তিনি। তবুও ইতিহাস স্বাক্ষী কুরআনের বিরোধীরা কোনকালেই জয়ী হতে পারেনি। পারেনি কুরআনের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে। বরং ইতিহাস স্বাক্ষী যারাই কুরআনের বিরোধীতা করেছে তাদেরই স্থান হয়েছে আস্থাকুড়ে। আর কুরআন আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। ইনশাল্লাহ থাকবেও কিয়ামত পর্যন্ত। মহামহিম রাব্বুল আলামীন তার অনন্য কুদরতে কুরআনকে হিফাযত করেছেন।
মহান আল্লাহ বলেন- “আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক”। [সূরা হিজর ১৫:৯ ]
কুরআনের বিরোধীদের জন্য আফসোস : আফসোস তাদের জন্য যারা কুরআনের সাথে সম্পর্ক না গড়ে কুরআনও তার অনুসারীদেরকে বিনাশ করতেই ব্যস্ত। অতীতে ও যেমন কেউ কুরআনের বিরোধিতায় টিকতে পারেনি বর্তমানেও পারবেনা। দেশে দেশে কুরআনের বিরোধীতা আজও চলছে। আমাদের দেশও তার বাহিরে নয়। ১৯৮৫ সালের চাঁপাইনবাবগঞ্জের মত আজও আমাদের সবুজ যমীনের প্রতিটি প্রান্তর কুরআনের অনুসারীদের রক্তে রঞ্জিত। সর্বত্রই আজ কুরআনের অনুসারীরা হয়রানি, অপমান লাঞ্ছনার স্বীকার। কুরআনের পথে চলার অপরাধে কুরআনের এক অন্যতম সাথী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে গত ২০১৬ সালের ১১ মে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগে বিচারের নামে প্রহসন করে শহীদ করে দেয়া হয়েছে। কুরআনের এক পাখি মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবকে ২০১০ সাল থেকে লৌহ পিঞ্জিরায় আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। পর্দার আড়ালে তাকে নিয়েও চলছে মিথ্যা নাটক মঞ্চস্থ করার প্রস্তুতি।
কুরআনের ছায়াতলে ফিরে আসুন! : দুনিয়ার ক্ষণিকের মিথ্যাজালে আবদ্ধ না থেকে আসুন সচেতন হই। কুরআনের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করি। দুনিয়া শান্তিপূর্ণ জীবন ও আখিরাতে মুক্তি পেতে চাইলে কুরআনের কাছেই আমাদের ফিরতে হবে। আসুন ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রে কুরআনের বিধান পালনে সোচ্চার হই। সেই সাথে দাবী জানায় ১১ মে “কুরআন দিবস” হিসেবে চালু করা হোক। আমাদের দেশে নানান দিবসের ছড়াছড়ি। যার বেশীর ভাগই তরুণ প্রজন্মের চরিত্র ধ্বংসের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। সুতরাং তরুণ প্রজন্মের নৈতিক অবক্ষয় রোধের জন্য কুরআনের কাছে প্রত্যাবর্তন এখন সময়ের অনিবার্য দাবী।