বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মানবশিশুর জীবন বিকাশে সিয়াম সাধনা

ড. হাসান মোঃ মাঈনুদ্দীন : কলেমা-সালাতের মতো সিয়াম ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি। রমযান মাসের রোজা যেমন মুসলমান নর-নারীর উপর ফরয, নাবালেগ শিশুদের উপর রোযা ফরয নয় বটে কিন্তু তাদেরকে রোজা পালনে অভ্যস্ত করা মা-বাবার একান্ত কর্তব্য। শিশু বয়সে রোজা পালনে অভ্যস্ত হলে বালেগ হওয়ার পর ফরয দায়িত্বটি পালনে তাদর কষ্ট হয় না। আরবীতে একটি প্রবাদ বাক্য যে- আল ইলমু ফিস সিগারী কান-নাকসী ফিল হাজারী, অর্থাৎ শিশু বয়সের শিক্ষা মনের গভীরে গেঁথে যায় যেমন পাথরে ক্ষুদাই করা লিখনটি গেঁথে থাকে। ছোট বয়সে তাদেরকে যা কিছু শিখিয়ে দেয়া হয় বড় হয়ে সেটা তারা কখনো ভুলতে পারে না। একটি শিশু তার বাপ-মায়ের চাল-চলন, আচার-আচরণ সবটাই সে লক্ষ্য করে এবং অনুসরণ করতে চেষ্টা করে। অতীতের মনীষীগণ মুখের কথা ফুটিয়ে তোলার লক্ষ্যে সর্বপ্রথম কালেমা উচ্চারণ করেন এবং শাহাদাতের আঙ্গুল উঁচু করে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতে চেষ্টা করেন যাতে করে ছোট বয়সে তাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি ঈমান ভালবাসা গেঁথে যায়।
শিশুরা যেন নামাযে অভ্যস্ত হয় সেজন্য তাদেরকে নামাযে অভ্যস্ত বানাতে হয়। আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেন, তোমরা শিশুদেরকে ৭ বছর বয়সে নামাযের তালিম দাও, দশ বছর বয়সে তাকে শাস্তি দিয়েও নামায শেখাও, তবে বড় হবার পর তারা নামায পড়তে অভ্যস্ত হবে। সে বয়সে তাদের কুরআন শেখাও তাহলে সে কুরআন পড়তে অভ্যস্ত হবে, কুরআনের প্রতি তার ভালবাসা সৃষ্টি হবে।
আল্লাহ পাক আত্মার পরিশুদ্ধি ও আল্লাহভীতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রমযানের সৌম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। সৌম বা রোযা আদর্শ মানব গঠনের সহায়ক। উন্নত আখলাক, সুন্দর চরিত্র ও আচরণ শিশুদের মধ্যে যা সৃষ্টি করে সেভাবেই তাদের গড়ে তোলার মহা সুযোগ। এ সুযোগটি কাজে লাগানোর জন্য প্রতিটি শিশুর মা-বাবার কর্তব্য। শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয় হলো শিশুর মা ও বাবা। তারাই হচ্ছেন প্রথম শিক্ষক। এ বিদ্যালয়টি হলো সার্বক্ষনিক। কোন শিশু যদি বিদ্যালয় থেকে ও মায়ের কাছ থেকে শিক্ষা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তাকে সঠিক পথে নিয়ে আসা খুবই কঠিন।
মা-বাবা মিথ্যা বললে সন্তানরা মিথ্যা বলে। মা-বাবা গালাগাল করলে সন্তানরাও গালাগাল করে, মা-বাবা অশুভ আচরণ করলে শিশুরাও মানুষের সাথে অশুভ আচরণ করে। পরিবারটি কি ধরনের সেটা শিশুর আচার-আচরণে বুঝতে পারা যায়। যেমন হাদীসে এসেছে, আল্লাহর নবী বলেছেনÑ তোমার জনগণ তোমার মা-বাবা মিথ্যা বললে সন্তানরা মিথ্যা বলে, মা-বাবা গালাগাল করলে সন্তানরাও গালাগাল করে, মা-বাবা অশুভ আচরণ করলে শিশুরাও মানুষের সাথে অশুভ আচরণ করে। পরিবারটি কি ধরনের সেটা শিশুর আচার-আচরণে বুঝতে পারা যায়। যেমন হাদীসে এসেছে, আল্লাহর নবী বলেছেন, তোমার জনগণ তোমার ব্যাপারে ভালো বললে তুমি ভাল আর খারাপ বললে তুমি খারাপ। এর জন্য বাহির থেকে ক্যারেক্টার পত্র নেয়ার প্রয়োজন হয় না। পাড়া-প্রতিবেশীর সাক্ষীই যথেষ্ট।
মা-বাবার শিশু গঠনের দায়িত্বটি নিয়ে অবহেলা করা উচিত নয়। সামান্য অবহেলার জন্য জীবনভর আক্ষেপ করতে হয়। আর ভোগান্তি রয়েছে সীমাহীন। নবী সা. বলেছেন, তোমাদের অধিনস্তদের বিষয়ে তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে। আবার এটাও হাদীসে বলা হয়েছে, যে মাতা-পিতা নিজ সন্তানদের সুশিক্ষা দিতে ব্যর্থ কিয়ামতের দিন ঐ সন্তানরাই নিজ বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগকারী হবে। তারা বলবে আমাকে শাস্তি দেয়ার আগে আমার বাবা-মাকে আগে শাস্তি দিন।  জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবার জন্য তারাই দায়ী, আমরা দায়ী নই।
আজ রমযান মাসে রোযা পালনের বিষয়ে শিশুদের নিরুৎসাহিত করা হয়। দিনের বেলায় রোযা রাখতে চাইলেও তাদের রোযা রাখতে দেয়া হয় না। রোযা ভাঙ্গার জন্য বল প্রয়োগ করা হয়। তারা সাহরী খেতে চাইলেও ঘুম থেকে জেগে উঠতে দেয়া হয় না। স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ দেখিয়ে রোযা পালন থেকে তাদের বিরত রাখা হয়। তাদের এ আচরণটি নিষ্ঠুরতা ছাড়া কিছুই না। নবী (সা.) বলেছেন, “রোযা রাখো সুস্থ থাকো”।
আদর্শ শিশু হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব মা-বাবার। রোযা মানুষকে নেক আমলের শিক্ষা দেয়। সত্য বলায় অভ্যস্ত বানায়। অন্যায় থেকে বাঁচাবার জন্য ঢাল ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। অন্যান্য সৎ কাজের উৎস হলো রমযান মাসের রোযা। মক্কার মসজিদুল হারাম ও মদীনার মসজিদে নববীতে রমযান মাসে তিন/চার বছরের শিশুদের রোযা রাখতে দেখা যায়। বিভিন্ন মসজিদে শিশুদের রোযা পালনে আনন্দ করতে দেখা যায়। তারা রমযান মাসে কুরআন তিলাওয়াত করে, মসজিদে জামাতের সাথে নামায পড়ে, নফল এবাদত করে, দান-খয়রাত করে, ইফতার করে এবং অন্যকে সঙ্গে নিয়ে ইফতার করে। বাস্তবিকই শিশুদের রোযা পালনের এ উৎসব দেখার মতো। এর সাথে শিখবার বহু কিছু রয়েছে।
এক আল্লাহ ওয়ালা লোকের সন্তান প্রতিবেশীর গাছ থেকে আম চুরি করে খেয়ে ফেলল। লোকটি ঘরে গিয়ে নিজ স্ত্রীর কাছে চুরির ঘটনাটি বলল। তার স্ত্রী বলল, বাল্যকালে আমি আম চুরি করে খাবার কথা মনে পড়লো। অতঃপর স্বামীকে বললেন, ছোটবেলায় কোন এক সময় চুরির অপরাধ করেছিলাম বলে আমার সন্তান আজ চুরি করে আম খেয়েছে। তার কু-অভ্যাসটি সন্তানের উপর প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। যার মাসুল দিতে হলো সেই মা-বাবাকে।
দ্বিতীয় আরেকটি ঘটনা : মা-বাবার উদাসীনতার কারণে তাদের একটি মাত্র সন্তান মাসকাসক্তের শিকার হয়ে পরে সংসারের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। মাদকাসক্তের অভিশাপ থেকে যুক্ত করার লক্ষ্যে বহু চেষ্টা তদবির করেও তারা ব্যর্থ হন। অনেক সম্পদ ব্যয় করেছেন কিন্তু কোন লাভ হয়নি। ছেলেকে মানুষ করানোর চেষ্টা স্বরূপ তাকে মক্কায় বায়তুল্লাহ নিয়ে যান। ওমরা করেন তাকে নিয়ে কিন্তু ছেলেটি আবার দেশে ফিরে এলে নেশার অভ্যাসটি সে ছাড়তে পারলো না। সর্বশেষ ছেলেটি মারা গেল। তার মা-বাবা আর তাকে বাঁচাতে পারলেন না। স্বর্ণের তাসঘরটি ক্ষণিকের মধ্যে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল।
এখানে কুরআনের একটি আয়াত উল্লেখ করা প্রয়োজন-
আল্লাহ বলেন, “বলুন আমি কি তোমাদেরকে সেইসব লোকের সংবাদ দেব যারা কর্মের দিকে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত। তারাই সে লোক যাদের প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনে বিভ্রান্ত হয়। অথচ তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করছে।” (সূরা আল কাহফ, আয়াত ১০৩)
ছোটমণি শিশুদের রমযানের রোযা পালনে অভ্যস্ত করার জন্য কতিপয় নির্দেশনা পালনের আহ্বান রেখে প্রবন্ধটি শেষ করছি।
# রমযানের রোযা পালনে ঘরের সন্তানদের সুযোগ দিতে হবে, সেই সাথে সৃষ্টি করতে হবে উপযোগী পরিবেশ।
# তাদেরসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে ইফতার ও সাহরীর আয়োজন করতে হবে।
# তাদের কাছে বসিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে, সেই সাথে কুরআনের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
# রমযানের ফযিলত সম্পর্কিত আয়াত ও হাদিস পাঠ করতে হবে।
# তারাবীহ নামাযসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে পড়ার অভ্যাস করতে হবে।
# ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে ইসলামী শিক্ষার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে মতবিনিময় করতে হবে।
# দান-খয়রাতের সময় সন্তানদের সাথে রাখতে হবে।
# মাসনুন দোয়াগুলো মুখস্ত করার চেষ্টা করতে হবে।
# কবিরা গুনাহ কি কি সেটা তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। কবিরা গোনাহর পরিনাম জানিয়ে দিতে হবে।
# সন্তানদের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সুন্দরভাবে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। তাদের দোষগুলো বড় করে দেখার প্রয়োজন নেই।
# তাদেরকে সর্বদা ক্ষমার চোখে দেখতে হবে।
আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, এশিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, সদস্য, শরীয়াহ্ সুপারভাইজারি কাউন্সিল, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।
ঊ-সধরষ : ফযসররঁপ@মসধরষ.পড়স

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ