শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

বাজেটের পরিধি কমিয়ে দুনীতি দমনের পরিধি বাড়াতে হবে

জিবলু রহমান : স্বাধীন বাংলাদেশে ৪৭তম বাজেট পেশ হয়ে গেল ১ জুন ২০১৭। ১৯৭২-’৭৩ অর্থবছরে সাত কোটি বাংলাদেশীর জন্য ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট পেশ হয়। ৪৬ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৫০ শতাংশ, আর বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় ৩৫০০ শতাংশ। হোক না ঘাটতি কিংবা ঋণনির্ভর, তদুপরি দেশের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ অংকের বাজেট পেশ করে অনিবার্যভাবেই রেকর্ড গড়ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। প্রশ্নবিদ্ধ দশম সংসদেরও প্রথম বছরে ২০১৪ সালে আড়াই লাখ কোটির বেশি অংকের ‘ঢাউস’ মার্কা বাজেট প্রস্তাব করে নিজের দু’হালি পূর্ণ করেন। আর এখন পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে বেশি বাজেট পেশের ক্ষেত্রে বিএনপিদলীয় সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ১২টি নিয়ে শীর্ষে রয়েছেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিভিন্নভাবে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। এসব সরকারের আমলে ১৪ জন অর্থমন্ত্রী (অর্থ উপদেষ্টা) ৪২টি বাজেট জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮২-’৮৩ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদে বাজেট দেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী মুহিত। সেই প্রথম বাজেটের আকার ছিল ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার আর ১৯৮৩-’৮৪ অর্থ বছরে দ্বিতীয় বাজেট ছিল ৫ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকার।
প্রতি বছরই গড়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ বাড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। এক বছরের ব্যবধানে সর্বোচ্চ ৩৩ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর রেকর্ডটিও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের। এর আগে বিএনপির শাসনামলে এম সাইফুর রহমানের হাতে এক বছরের ব্যবধানে সর্বোচ্চ ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর রেকর্ড রয়েছে।
বাজেট পেশের দিক থেকে বিএনপির হয়ে এম সাইফুর রহমানের রেকর্ডটি সবচেয়ে বড়। তিনি বাজেট দিয়েছেন ১২টি। এর ১০টি খালেদা জিয়ার শাসনামলে এবং বাকি দু’টির একটি জিয়াউর রহমানের ও অপরটি বিচারপতি এম এ সাত্তারের শাসনামলে। এম সাইফুর রহমানের পেশকৃত বাজেট বছরগুলো হলো ২০০৬-’০৭, ২০০৫-’০৬, ২০০৪-’০৫, ২০০৩-’০৪, ২০০২-’০৩, ১৯৯৫-’৯৬, ১৯৯৪-’৯৫, ১৯৯৩-’৯৪, ১৯৯২-’৯৩, ১৯৯১-’৯২, ১৯৮১-’৮২ এবং ১৯৮০-’৮১। তৃতীয় সর্বোচ্চ বাজেট দেন আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী এএমএস কিবরিয়া। তিনি ছয়টি বাজেট পেশ করেন ২০০১-’০২, ২০০০-’০১, ১৯৯৯-২০০০, ১৯৯৮-’৯৯, ১৯৯৭-’৯৮ এবং ১৯৯৬-’৯৭ অর্থবছরে। এছাড়া চতুর্থ সর্বোচ্চ হিসেবে চারবার বাজেট দিয়েছেন জাতীয় পার্টির এরশাদ সরকারের হয়ে অর্থমন্ত্রী এম সায়েদুজ্জামান। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও পরে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাজেট পেশ করেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম তিন বছর অর্থাৎ ১৯৭২-’৭৩ , ১৯৭৩-’৭৪ এবং ১৯৭৪-’৭৫। এছাড়াও তিন বছর জাতীয় বাজেট পেশ করেন জিয়াউর রহমান। দুইবার সামরিক শাসক প্রধান হিসেবে, একবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে এই বাজেট দেন তিনি। এছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে দুইবার বাজেট দেন ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অপর অর্থ উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দীন মাহমুদ একটি বাজেট দেন। এছাড়াও  যারা একটি করে বাজেট দেন তারা হচ্ছেন মেজর জেনারেল (অব.) মুনিম, ড. এমএন হুদা ও ড. আজিজুর রহমান।
স্বাধীনতার পর তাজউদ্দীন আহমেদের হাতেই বাজেট ১০ ডিজিট ছাড়িয়ে ১১ ডিজিটে অর্থাৎ হাজার কোটির কোটায় আসে। স্বাধীনতার প্রথম অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা, যা  ক্রমান্বয়ে বেড়ে ১৯৭৩-’৭৪ সালে ৯৯৫ কোটি টাকা এবং তাজউদ্দীনের তৃতীয় তথা শেষ বাজেট ১৯৭৪-’৭৫ সালে ১০৮৪.৩৭ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। আর তা লাখো কোটির কোটায় নিয়ে যান আওয়ামী লীগের বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সমালোচকরা বরাবরই এই বিশাল ঘাটতির বাজেটকে উচ্চাভিলাষী বলছেন।
 ভালো বাজেটে জনগণের আশা-ভরসার প্রতিফলন থাকে। কিন্তু যে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য বিতর্কিত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্ধতায় গঠিত, তার বাজেট জনগণের ধরাছোঁয়ার বাইরে তৈরি হয়। এবারের বাজেট এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে আয়-ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও আগামী অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেটের ব্যয় ৪ লক্ষ ২৬৬ কোটি, আয় ২ লক্ষ ৯৩ হাজার ৪০০ কোটি এবং ঘাটতি ১ লক্ষ ১২ হাজার ২৭৫ কোটি। উন্নয়ন ব্যয় ১ লক্ষ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি এবং অনুন্নয়ন ব্যয় ২,৪৬,৯৩৫ কোটি।
এই বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পাচ্ছে চার খাত বেতন-ভাতা, সুদ পরিশোধ, প্রতিরক্ষা এবং ভর্তুকি ও প্রণোদনা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই চার খাতে মোট বরাদ্দ ১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। এটা মোট বাজেটের প্রায় ৩৪.৪১%। দেশে বর্তমানে সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। বাজেটের ২২% ব্যয় হবে তাঁদের জন্য। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের চেয়ে এই অঙ্ক ২৬% বেশি! মাত্র ১৪ লাখ সরকারি কর্মচারীকে খুশী রাখতে যে বরাদ্দ দেয়া হলো তা সঠিক হয়নি। কারণ আমজনতা, কর্মহীন ষাট শতাংশ যুবক, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর তাদের প্রকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত হলো। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো ৪ জুন ২০১৭)
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত হলো দুই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন। এবার শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি খাতকে জুড়ে দেয়া হয়েছে। সব মন্ত্রণালয়ই প্রযুক্তি খাতে ব্যয় করবে, কিন্তু অর্থের সংকুলান দেবে শিক্ষা ও প্রযুক্তি নামের যৌথ খাত। বাজেট অগণমুখী হলে বুঝতে হবে যে সরকার আগামী নির্বাচনকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে না। দিবে কিভাবে তারাতো আবার জোর করে ক্ষমতায় যাওয়ার মতলবে আছে। আর তার সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায় ৫ জুন ২০১৭ বিভিন্ন অপরাধের জন্য দ্রুত বিচার আইনে সাজার মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে আইন সংশোধনের প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দেয়ার ঘটনা। সংশোধিত আইনে রাস্তা অবরোধ করলে ৭ বছর কারাদ-ের বিধান করা হয়েছে।
জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ‘আইন-শৃঙ্খলা বিঘœকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) (সংশোধন) আইন- ২০১৭’ এর খসড়ায় অনুমোদন দেয়া হয়। পরে সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, দ্রুত বিচার আইনের ৪(১) ধারা সংশোধন করে শাস্তির মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে।
ওই ধারায় ‘আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ’ এর জন্য এতদিন সর্বনিম্ন দুই বছর এবং সর্বোচ্চ পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি অর্থদণ্ডের বিধান ছিল। সংশোধিত আইনের খসড়ায় ওই সাজার মেয়াদ বাড়িয়ে সর্বনিম্ন দুই বছর ও সর্বোচ্চ সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। সাজার পরিমাণ বাড়ানোর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “অনেকগুলো ফোরাম থেকে প্রস্তাব আসে যে সাজা পাঁচ বছর পর্যাপ্ত নয়। স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ করা হয়েছে। সবাই সাজা সাত বছর করার বিষয়ে একমত পোষণ করেন।”
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এ আইনের সাজা বাড়ানো হল কি না-এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে এটা (শাস্তি) বাড়ানো হয়নি, এটা নিয়মিত কাজ।” শফিউল আলম বলেন, কোনো ব্যক্তি ‘আইন-শৃঙ্খলা বিঘœকারী অপরাধ’ করলে দ্রুত বিচার আইনে তার বিচার হবে। যেমন ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বা বেআইনি বল প্রয়োগ করে কোনো ব্যক্তি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদা, সাহায্য বা অন্য কোনো নামে অর্থ বা মালামাল দাবি বা আদায় বা আদায়ের চেষ্টা করলে তা এ আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়া স্থল, রেল, জল বা আকাশপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা, ইচ্ছের বিরুদ্ধে যানের গতি ভিন্নপথে পরিবর্তন করা, ইচ্ছাকৃত কোনো যানবাহনের ক্ষতি করা; ইচ্ছাকৃতভাবে সরকার, ব্যক্তি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি ভাংচুর করাসহ নয় ধরনের অপরাধের জন্য এই আইনের অধীনে সাজা দেওয়া যাবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
২০০২ সালে দ্রুত বিচার আইন জারি করে দুই বছরের জন্য তা কার্যকর করা হয়। এরপর বেশ কয়েক দফা ওই আইনের মেয়াদ বাড়ায় সরকার। চাঁদাবাজি, যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি, যানবাহনের ক্ষতি সাধন, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিনষ্ট, ছিনতাই, দস্যুতা, ত্রাস ও সন্ত্রাস সৃষ্টি, অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি, দরপত্র কেনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ বিভিন্ন অপরাধ দ্রুততার সঙ্গে বিচারের জন্য এ আইন। এ আইনে ১২০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ নিষ্পত্তির বিধান আছে। এই সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা না গেলে আরও ৬০ দিন সময় পাওয়া যাবে। (সূত্র : দৈনিক সংগ্রাম ৬ জুন ২০১৭)। [চলবে]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ