শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

মোবাইল ফোনে যতো জালিয়াতি

আবু হেনা শাহরীয়া : সভ্যতার ক্রমবর্ধমান বিকাশে ফোনের ব্যবহার অনস্বীকার্য। কিন্তু এই ফোনের মাধ্যমে জালিয়াতি করে অভিনব উপায়ে সাধারণের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকচক্র। শুধু অর্থ হাতিয়েই ক্ষান্ত করছেনা, ফেলছে নানা বিপদে। বিশেষ করে ঈদের সময় এ ধরনের প্রতারণা সাধারণত বহুগুণ বাড়ে। প্রতারণার ধরন ও প্রতিকারের উপায় জানা থাকলে সহজেই এসব প্রতারক চক্র থেকে নিজেদের রক্ষা করা সম্ভব হবে। 
স্পুফিংয়ে সাবধান : সরকারি এক অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত নম্বর থেকে একই দপ্তরের অন্যান্য কর্মকর্তার কাছে ফোন গেল। হঠাৎ বিপদে পড়ে টাকা ধার চেয়েছেন দপ্তরপ্রধান। কর্মকর্তারা সম্মানিত মনে করে টাকা পৌঁছিয়েও দিয়েছেন। এত ঘটনার কিছুই জানেন না মহাপরিচালক! আর তার মোবাইল থেকেও করা হয়নি কোনো ফোন। তাহলে? পুরোটাই প্রতারকচক্রের কাজ। মহাপরিচালকের ফোন নম্বর ক্লোন করে এই প্রতারণার নাম স্পুফিং জালিয়াতি। এভাবেই প্রতারকরা পরিচিত ও সম্মানিত ব্যক্তির নম্বর কপি করে ফাঁদ পাতে। এরা বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং সরকারি অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের নম্বর স্পুফিং করে ইতিমধ্যে প্রতারণার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এদের একটি দলকেও গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।
ফ্লেক্সি ফেরতে ধরা : হঠাৎ করেই খুব অসহায় কণ্ঠের ফোন। নিজেকে গরিব, ফ্লেক্সিলোড কর্মচারী পরিচয়ে ফোন ‘ভুলে এত টাকা ফ্লেক্সি চলে গেছে আপনার ফোনে। দয়া করে যদি ফেরত দেন। অর্ধেক টাকা ফেরত দিলেও উপকার হয়।’ বিকাশ বা রকেট এমন কোনো মাধ্যমে টাকা ফেরত দিতে বলে তারা। এবার টার্গেট ব্যক্তি নিজের ফোনে দেখেন একটি মেসেজও এসেছে ফ্লেক্সির। তা দেখে টাকা ফেরত দিতে গেলেই খেতে হবে ধরা। আসলে ফ্লেক্সির ওই এসএমএস ভুয়া। সেখানে টাকার কথা বলা থাকলেও তা অ্যাকাউন্টে যায় না।
চক্রটি এভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
লটারিতে সর্বনাশ : মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর কাস্টমার কেয়ার থেকে ফোন দিয়েছে, এমন ভানে আলাপ শুরু। কিছু সময় পর টার্গেট ব্যক্তির মনোভাব বুঝে বিভিন্ন নামের লটারিতে লোভনীয় অঙ্কের টাকায় তার নাম-নম্বর নির্বাচিত হয়েছে বলে জানানো হয়। টাকার অঙ্ক সাধারণ ১০ লাখ থেকে এক কোটি পর্যন্ত বলা হয়। সাধারণ মানুষ বিষয়টি সহজে ধরতে পারে না। অফার ও লটারি জেতার লোভের ফাঁদে পা দিয়ে বসে। এতেই সর্বনাশ। লটারির টাকা পেতে ট্যাক্সসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়াগত কাজ করতে কিছু খরচের জন্য টার্গেট ব্যক্তির কাছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা চায় প্রতারকরা। পাঠালেই সটকে পড়ে তারা। এমন অনেক প্রতারককে বিভিন্ন সময় ধরেছে র‌্যাব ও পুলিশ। ভুক্তভোগীর সংখ্যা কম নয়।
ফোন বন্ধের অনুরোধে বিপদ : অপারেটরের নেটওয়ার্ক উন্নয়নে কিছু সময়ের জন্য ফোন বন্ধ রাখতে অনুরোধ করবে কাস্টমার কেয়ার পরিচয় দেওয়া প্রতারকরা।
টেকনিক্যাল বিষয় মনে করে ফোন বন্ধ রাখলেই বিপদ। টার্গেট ব্যক্তি সম্পর্কে আগেভাগেই খোঁজখবর নিয়ে রাখে প্রতারকরা। মোবাইল বন্ধের পর টার্গেট ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনকে ফোন দিয়ে দুর্ঘটনার কথা বলে জরুরি চিকিৎসায় টাকা চায় তারা। খোঁজ না নিয়ে দ্রুত বিকাশে টাকা পাঠালেই প্রতারণার শিকার।
মিসড কলে মিস নয়: এক ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করে প্রতারকরা টার্গেট ব্যক্তির ফোনে মিসড কল দেয়। কখনো একবার, কখনো কয়েকবার। ভদ্রতা, কৌতূহল বা বিরক্তি যে কারণেই হোক, ফিরতি কল করলেই নিজের ফোনের ব্যালান্স শূন্য হয়ে যাবে। প্রতারকরা বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে টার্গেট ব্যক্তির ব্যালান্স হাতিয়ে নেয়।
জিনের বাদশার ফাঁদ : গভীর রাতে হঠাৎ ফোন করে সালাম দিয়ে সুরেলা তিলাওয়াত ও ওয়াজ-নসিহত দিয়ে শুরু। ধর্মীয় কথাবার্তা শুনে মন নরম হয়েছে বুঝতে পারলেই বলা শুরু করে ‘তুই গুপ্তধন পাবি, তোর জন্য স্বর্ণের কলস অপেক্ষা করছে। আমি জিনের বাদশা বলছি। তুই ভাগ্যবান বলেই তোকে ফোনে জানাচ্ছি এই সুসংবাদ।
এরপর বিষয়গুলো গোপন রাখার শর্তে আর গুপ্তধনের সন্ধান দিতে টাকা বা হাদিয়া চেয়ে বসে জিনের বাদশা। কথা না শুনলে শুরু হয় বিপদের ভয় দেখানো। তবে কথা শুনলেই বিপদ! এদের ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছে অনেক সরল মানুষ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই প্রতারকচক্রের অনেককে আটক করেছে। তবে নির্মূল হয়নি। নিরাপদ থাকতে হলে জিনের বাদশায় বিশ্বাস করা যাবে না।
মোবাইল প্রেমে ছলনা : এই প্রতারকচক্রে নারী সদস্যরাই প্রধান। টার্গেট সচ্ছল, ব্যবসায়ী বা উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী। এরা টার্গেট ব্যক্তি ঠিক করে বেশ পরিকল্পনা করেই ফাঁদ পাতে। দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে টার্গেট ব্যক্তিকে ফোন করে সখ্য গড়ে তোলে। সময় নিয়ে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে। ফাঁদে পড়া ব্যক্তি টেরই পায় না যে কাটানো একান্ত সময়গুলো মোবাইলে অডিও-ভিডিওসহ বিভিন্নভাবে রেকর্ড করে রাখা হচ্ছে। পর্যাপ্ত প্রমাণ রেকর্ডের পর শুরু হয় আসল কাজ। ইন্টারনেটে, আত্মীয়-স্বজনের কাছে এসব প্রকাশ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চাওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। ঘটনার শিকার ব্যক্তি সম্মান হারানোর ভয়ে ধীরে ধীরে খুইয়ে বসেন সর্বস্ব। একাধিক নারী সদস্যসহ এমন প্রতারকদের একাধিক দলকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অপারেটরগুলোর বক্তব্য : মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর সংগঠন অ্যামটবের মহাসচিব ও প্রধান নির্বাহী টিআইএম নূরুল কবীর জানান, সম্প্রতি স্পুফিংয়ের মতো অপরাধ ঠেকাতে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোকে নিজস্ব সফটওয়্যার ডেভেলপ করতে বলেছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। তিনি জানান, বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধনের কারণে এসব অপরাধ অনেকটা কমে এসেছে। এতে কোনো সিম ব্যবহার করে অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ কম। আর গ্রাহকদের নিরাপদ রাখতে বা প্রতারকদের ধরতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সব সময় সহায়তা করে থাকে অপারেটরগুলো।
বিটিআরসির পরামর্শ : এসব প্রতারণা থেকে নাগরিকদের সতর্ক ও সচেতন করতে বিভিন্ন প্রচারণামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি। স্পুফিংয়ের ক্ষেত্রে নিরাপদ থাকতে যে নম্বরে কল আসবে, তাতে সন্দেহজনক মনে হলে ফিরতি কল দিয়ে চেক করার কথা বলা হয়েছে। প্রতারকরা বিটিআরসির নাম ব্যবহার করেও মানুষকে ধোঁকা দিয়েছে। এমন ঘটনায় সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়েছে। সেখানে প্রতারক ও অপরাধীচক্রকে বিটিআরসির নামে ব্যক্তিগত তথ্য, গোপন পিন, পাসওয়ার্ড, অর্থ প্রদান, পুরস্কারপ্রাপ্তি সংক্রান্ত কল বা এসএমএসের উত্তরে তথ্য, অর্থ প্রদান থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
এসব প্রতারকের খপ্পরে পড়লে বিটিআরসির কলসেন্টার ২৮৭২-এ কল করে বা [email protected][email protected] ঠিকানায় ই-মেইলে অভিযোগ জানানো যাবে।
বিটিআরসির সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া উইং) জাকির হোসেন খান জানান, এসব প্রতারণা থেকে নাগরিকদের সচেতন করতে বিটিআরসি প্রচারণামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।
প্রতারণার শিকার কেউ অভিযোগ করলে সে ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাহায্য নিতে বলা হয়। অপরাধীদের খুঁজতে টেকনিক্যাল সহায়তাগুলো সব সময়ই দিয়ে আসছে বিটিআরসি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ