শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে চোরাপথে অবাধে আসছে ভারতীয় পোশাক

খুলনা অফিস : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে চোরাপথে অবাধে আসছে ভারতীয় পোশাক। তবে সরকারিভাবে পোশাক আমদানি কমেছে। প্রশ্ন উঠেছে, এতো ভারতীয় পোশাক কোথা থেকে এলো? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঈদ উপলক্ষে চোরাপথে পোশাক আমদানি বেড়েছে। আর রয়েছে লাগেজ পার্টির তৎপরতা। কাস্টম কর্তৃপক্ষের উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ আর রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়ে বিজিবির দ্বিতীয় দফা তল্লাশির কারণে ব্যবসায়ীরা বিকল্প পথ বেছে নিচ্ছেন।
বাংলাদেশে ভারতীয় কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের বাজারে থাকা ভারতীয় শাড়ি, থ্রিপিস ও কাপড়ের সিংহভাগই আসে বেনাপোল হয়ে। কিন্তু ঈদমুখে ভারত থেকে পোশাক আমদানি আকস্মিকভাবে কমেছে। শুল্ক কর্তৃপক্ষও এ তথ্য স্বীকার করছেন। অথচ চাইলে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে যেকোনো ধরনের ভারতীয় পোশাক।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সম্প্রতি বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কড়াকড়ি আরোপ করায় এবং শুল্ক দিয়ে পণ্য খালাসের পর পথে বিজিবি সদস্যরা তা আটক করার কারণে অনেক আমদানিকারক এ বন্দর ছেড়েছেন। কমে গেছে এসব পণ্য আমদানি। বাণিজ্যকিভাবে যে পরিমাণ পণ্য বৈধ পথে আসছে, তার চেয়ে বেশি পণ্য আসছে চোরাই পথে। কলকাতায় মাল কিনে প্যাকিং করে চলে আসেন ব্যবসায়ীরা। চুক্তির মাধ্যমে এসব পণ্য নির্বিঘ্নে পৌঁছে যায় ব্যবসায়ীদের দোকানে।
কাস্টমস, আমদানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্টের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদকে সামনে রেখে খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোরসহ দেশের সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে শাড়ি, থ্রিপিস, থানকাপড়ের চোরাচালান বেড়েছে। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার এসব পণ্য আসছে চোরাপথ দিয়ে। সড়ক, নৌ ও বিমানপথে অভিনব কৌশলে ভারতীয় কাপড় সামগ্রী আসছে। পাচার হওয়া এসব পণ্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে। তবে বিশেষ করে খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, নড়াইল, কুষ্টিয়াসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মার্কেট ও অভিজাত বিপনী বিতান এবং শপিং মলে ভারতীয় শাড়ি ও থ্রিপিচের সয়লাব। সড়ক পথের চেয়ে নৌপথকে চোরাচালানিরা বেশি নিরাপদ মনে করছে। এছাড়া ভারতীয় পোশাক সীমান্তের প্রায় সব হাট-বাজারে এখন খোলামেলা বিক্রি হচ্ছে। কলকাতার বড়বাজার ও দক্ষিণের ডায়মন্ড হারবারে চোরাচালানিদের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে। ওই ঘাঁটি থেকে কয়েকটি সিন্ডিকেট এসব পণ্য পাচার নিয়ন্ত্রণ করে। এখান থেকে ট্রলারে শাড়ি, থ্রিপিস সুন্দরবন অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগর দিয়ে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরিশালে সিন্ডিকেটের সদস্যরা পৌঁছে দিচ্ছে। স্থানীয় মার্কেট ছাড়াও ওইসব স্থান থেকে চোরাই পণ্য মাইক্রোবাস, কার, ট্রাকে পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকার বিভিন্ন বিপণিবিতানে।
সূত্র জানায়, এক ট্রাকে ৯০ বেল শাড়ি বা থ্রিপিস থাকে। ৯০ বেল কাপড়ের দাম পড়ে অন্তত এক কোটি টাকা। আর এ পণ্যের আমদানি শুল্ক ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা। কলকাতা থেকে বৈধভাবে ওই পণ্য আমদানি করতে প্রায় এক মাস লেগে যায়। তাছাড়া বৈধ পথে আমদানি করলেও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এসব পণ্যের ওপর উচ্চ হারে শুল্কায়ন করায় দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। কিন্তু চোরাচালানিরা মাত্র দশ লাখ টাকার বিনিময়ে ওই পণ্য কলকাতা থেকে বাংলাদেশের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেয়। আর এ ক্ষেত্রে সময় লাগে মাত্র তিন থেকে চারদিন। চোরাচালান সিন্ডিকেট বাকিতেও পণ্য সরবরাহ করে। গুদামঘরে পণ্য পৌঁছে দেয়ার পর টাকা পরিশোধ করা হয়। এছাড়া ভারতীয় মহাজনরাও বাকিতে কোটি কোটি টাকার শাড়ি, থ্রিপিস সরবরাহ করেন। চোরাচালানিরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় শহরের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে তাদের পণ্য সরবরাহ করে থাকে। অবৈধভাবে এসব পণ্য আসার কারণে সরকারের রাজস্ব আদায়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়াও প্রতিদিন ল্যাগেজ ব্যবসায়ীরাও বৈধ পথে এসব পণ্য নিয়ে আসছে নির্বিঘ্নে।
কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের মে মাস পর্যন্ত ১১ মাসে বেনাপোল কাস্টম হাউস থেকে শাড়ি খালাস হয়েছে ৬২ দশমিক ২৮ মেট্রিক টন। এর থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে তিন কোটি ৭৬ লাখ টাকা। থ্রিপিস খালাস হয়েছে ২৭৫ দশমিক ৫৫ মেট্রিক টন। এর থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। শাটিং ফেবিক্স খালাস হয়েছে ২৭৫ দশমিক ৪৩ মেট্রিক টন। এর থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে নয় কোটি সাড়ে ১৯ লাখ টাকা। প্যান্টিং ফেবিক্স এসেছে ৬৯৯ দশমিক ৭৯ মেট্রিক টন। এর থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ২১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। কটন ফেব্রিক্স এক হাজার এসেছে ১২০ দশমিক ২৮ টন। এর থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ২১ কোটি সাড়ে ১৭ লাখ টাকা। সিনথেটিক ফেব্রিক্স খালাস হয়েছে সাত হাজার ৪৯৬ দশমিক ২১ টন। এর থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১৪১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। তবে ঈদকে সামনে রেখে মে মাসে এ জাতীয় পণ্যে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বেশি। মে মাসে কাস্টমস হাউজ থেকে শাড়ি খালাস হয়েছে ৩৪ দশমিক ৯৫ টন। এর থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে দুই কোটি ২৪ লাখ টাকা। থ্রিপিস খালাস হয়েছে ৮৭ দশমিক ৭১ টন। এর থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে পাঁচ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। শাটিং ফেব্রিক্স খালাস হয়েছে ৪৫ দশমিক ৫৩ টন। এর থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে এক কোটি সাড়ে ৬৭ লাখ টাকা। প্যান্টিং ফেব্রিক্স খালাস হয়েছে ৯০ দশমিক ৮ টন। এর থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে দুই কোটি ৮৮ লাখ টাকা। কটন ফেব্রিক্স ২৩৪ দশমিক ১৬ টন। এর থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে চার কোটি সাড়ে ৪৪ লাখ টাকা এবং সিনথেটিক ফেব্রিক্স খালাস হয়েছে ৯৯১ দশমিক ৯১ টন। এর থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
বেনাপোল কাস্টমে আমদানিকৃত বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে শাড়ি, থ্রি-পিস এবং কাপড় (ফেব্রিক্স) জাতীয় পণ্যের কদর অনেক বেশি। এছাড়াও রয়েছে ইমিটেশন জুয়েলারি সামগ্রী। অন্যান্য আমদানিকৃত পণ্যের পরীক্ষণ ও শুল্কায়ন বিলম্ব হলেও বিশেষ ব্যবস্থায় এ জাতীয় পণ্যের পরীক্ষণ ও শুল্কায়ন প্রক্রিয়া শেষ করা হচ্ছে বলে জানান সিএন্ডএফ এজেন্টরা।
বেনাপোলের আমড়াখালি বিজিবি চেকপোস্টে প্রায়ই লাখ লাখ টাকার মালামাল আটক হচ্ছে। পরে কাস্টমসে শুল্ক দিয়ে এসব মালামাল আবার ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট পার্টি। এখাত থেকেও সরকার বেশ রাজস্ব পাচ্ছে। গত ১২ জুন রাতে আমড়াখালি থেকে ৩৩ লাখ টাকার শাড়ি থ্রিপিসসহ তিন চোরাকারবারিকে আটক করে বিজিবি।
বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি কামাল উদ্দিন শিমুল সাংবাদিকদের জানান, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে যে সব পণ্য ইতোপূর্বে বৈধভাবে আমদানি হয়ে আসতো, বর্তমানে সে সব পণ্য চোরাপথে আসছে। আমদানি করা পণ্য চালানের ওপর বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত লোড চাপানোর ফলে ব্যবসায়ীরা এখন বৈধ পথে না গিয়ে অবৈধ পথে মালামাল আমদানি করছে। চোরাচালানিরা এসব পণ্য নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বাড়তি সুবিধা হিসেবে ঘরে বসে মালামাল পাওয়ায় আমদানিতে ঝুঁকছে না। এর ফলে সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. শওকাত হোসেন বলেন, ‘আমি এখানে যোগদান করার পর থেকে এ জাতীয় পণ্য আসা অনেক কমে গেছে। কী কারণে কমেছে, তা বলতে পারবো না। তবে বর্তমানে এ জাতীয় যে সামান্য পণ্য আসছে সেগুলো স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট গ্রুপ (স্যাগ) দিয়ে একজন সহকারী কমিশনারের নেতৃত্বে পরীক্ষণ করে পণ্য চালান শুল্কায়ন করা হয়। যাতে ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য বা অন্য পণ্য আসতে না পারে তার জন্য আমদানি পয়েন্ট থেকে একজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা দিয়ে বন্দরে আনা হয়। এবং বন্দর থেকে একইভাবে এস্কট করে বাঁশকল পার করে দেয়া হয়। অন্যান্য কাস্টম হাউজ ও শুল্ক স্টেশন থেকে আমরা উচ্চ মূল্যে শুল্কায়ন করে থাকি। পণ্য চালানে কোনো অনিয়ম হলে আমরা জরিমানা আদায় করে পণ্য চালান খালাস দিয়ে থাকি।’ তিনি আরো বলেন, ‘শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ধরতে পারলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। যার মধ্যে রয়েছে লাইসেন্স বাতিল, মামলা, অর্থদন্ডসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। সরকারি ট্যারিফ সিডিউল মোতাবেক স্বচ্ছতার সাথে সব কাজই করা হয়ে থাকে বেনাপোল কাস্টম হাউসে।’

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ