শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

চুয়াডাঙ্গায় উজাড় হচ্ছে বাঁশঝাড় চাহিদা বাড়লেও বাড়ছে না উৎপাদন

বাঁশের তৈরী পণ্য বিক্রি করতে আলমডাঙ্গা থেকে এই কারিগর দর্শনা এসেছে -সংগ্রাম

এফ.এ আলমগীর, চুয়াডাঙ্গা : চুয়াডাঙ্গা থেকে বাঁশঝাড় উজাড় হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বাঁশের চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন বাড়ানোর কোনো পদক্ষেপ নেই। কৃষি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব বলে অভিমত অনেকের।
জানা যায়, মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি স্তরে যে জিনিসটির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেটি হলো বাঁশ। আগেকার দিনে গ্রামাঞ্চলের মানুষ শিশুদের জন্মের পর নবজাতকের নাড়ি কাটতে বাঁশের চটা ব্যবহার করা হত। শিশুকে বাঁশের তৈরি দোলনায় শুইয়ে দোল দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়। এই বাঁশ মানুষের জীবনের প্রতিটি স্তরে নানাভাবে কাজে লেগে থাকে। জন্মের পরই যেমন মানুষকে বাঁশের দোলনায় শুইয়ে দেয়া হয় তেমনি মরার পরও মৃতদেহ কবরস্থ করতে আদিকাল থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে বাঁশের। এখনো পর্যন্ত মৃতদেহ কবরস্থ করতে বাঁশের কোনো বিকল্প নেই। আগেকার দিনে গ্রামাঞ্চলে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেরই নিজস্ব বাঁশঝাড় ছিল। ঘর-বাড়ি, আসবাবপত্র তৈরি, ঘরের ও বাড়ির বেড়া দেয়া, নানারকম গৃহস্থালির কাজে এখনো ব্যাপকহারে বাঁশের ব্যবহার হয়ে থাকে। আগে এই বাঁশ দিয়ে গৃহস্থালির নানারকম জিনিসপত্র তৈরি ও বাজারে বিক্রি করে সমাজের মানুষের একটি বৃহৎ অংশ তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করত। বাঁশের অভাব ও প্লাস্টিক পণ্যের সহজলভ্যতার কারণে এ কাজে টিকে থাকেতে না পেরে  জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা পেশা বদল করে চলে গেছে অন্য পেশায়। তারপরও কিছু মানুষ তাদের পূর্ব-পুরুষদের পেশা আঁকড়ে ধরে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। উপজেলার গ্রামাঞ্চলে আগে বিস্তর পতিত জমি ছিল। এ সমস্ত পতিত জমি, বসতবাড়ির আশপাশ, পুকুর ধারে, বাগানের কোণায় ও রাস্তার ধারে বিপুলসংখ্যক বাঁশ উৎপন্ন হতো। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও বাসস্থানের চাহিদা মেটাতে সে সমস্ত বাঁশঝাড় উজাড় করে সেখানে ফলানো হচ্ছে নানারকম ফসল, আর তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ঘর-বাড়ি। আগেকার দিনে বাঁশ ছাড়া গৃহস্থালি কাজের কথা ভাবাই যেত না। এই বাঁশবাগান নিয়ে কবি সাহিত্যিকরাও রচনা করেছেন অনেক গল্প ও কবিতা। যতীন্দ্র মোহন বাগচী “বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ, মাগো আমার শ্লোক বলা কাজলা দিদি কই” কবিতাটি মনে করিয়ে দেয় আগেকার দিনে বাড়ির পাশে প্রচুর বাঁশ বাগানের কথা। আজ আর বাড়ির পাশে বাঁশবাগান তেমন একটা দেখা যায় না। উপমহাদেশে স্বাধীকার আন্দোলনের তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লার কথা শোনেনি এমন মানুষ খুব কমই আছে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিতুমীর সৈন্যদের জন্য বাঁশের কেল্ল¬া বানিয়েছিলেন, যা আজো ইতিহাস হয়ে আছে। কলম আবিষ্কৃত হওয়ার আগে নাকি বাঁশের কুঞ্চি সূচালো করে কেটে কালির দোয়াতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে লেখা হতো। আজ সেসব শুধুই স্মৃতি। আমাদের দেশে ভাল্কো, জাবা, তল্লা, মুলিসহ নানা প্রজাতির বাঁশ আছে। তার মধ্যে চুয়াডাঙ্গা জেলায় ভাল্কো, জাবা ও তল¬া বাঁশই দেখা যায়। ভাল্কো ও জাবা জাতের বাঁশ মোটা ও শক্ত হওয়ায় ঘর-বাড়ি তৈরি, ইমারত নির্মাণকাজে ভাড়া, খুঁটি, খাল-বিল পারাপারের জন্য সাঁকো, চাটাই তৈরিসহ নানা প্রকার ভারি কাজের জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। আর তল্লা জাতের বাঁশ দিয়ে বুকশেল্ফ, তাকিয়া, দোলনা, ডালা, কুলা, ঝুড়ি, চালন, ঢালন, চ্যাঙ্গারি, মাছ ধরার পলো, খালই, দোয়াড়ি, বিত্তি, খাদম ইত্যাদি তৈরি হয়ে থাকে। বর্তমানে পানির অভাবে মাছ না থাকায় মাছ ধরার এসব যন্ত্র আর ব্যবহার হয় না। তবে কার্যক্ষেত্রে কোনো প্রকার বাঁশেরই গুরুত্বই কম নয় এবং বাঁশের কোনো অংশই ফেলনা নয়। বাঁশ ছাড়াও এর কঞ্চি বাড়ি বা ফসলের ক্ষেতে বেড়া দেয়া, সবজি বাগানের খুঁটি, নানারকম সবজির মাচা তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়। শুকনা কঞ্চি, বাঁশ ও বাঁশের মুথা, শুতনা পাতা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়। বাঁশের কাঁচা পাতা গবাদিপশুর প্রিয়খাদ্য। বাঁশের কুড়া (কচিবাঁশ) অনেকেরই উপাদেয় খাদ্য। বর্তমানে পানচাষ লাভজনক হওয়ায় দামুড়হুদা উপজেলায় ব্যাপকভাবে পানচাষ শুরু হয়েছে। পান বরজের মূল উপকরণ হলো বাঁশ। পান বরজের বেড়া, খুঁটি, শলি ও ছাউনিতে প্রচুর বাঁশ ব্যবহার হয়। ফলে এলাকায় আগের তুলনায় বাঁশের চাহিদা বেড়েছে বহুগুণে। এলাকায় বাঁশের ব্যাপক চাহিদা বাড়লেও এর উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে কৃষি বিভাগের কোনো প্রকার সাহায্য সহযোগিতা, পরামর্শ বা উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না। এলাকায় যেভাবে বাঁশের চাহিদা বেড়েছে তাই বাণিজ্যিকভাবে বাঁশ উৎপাদন করলে অন্যান্য ফসলের মতোই লাভজনক আবাদ হতে পারে। বাঁশের উৎপাদন বাড়লে এলাকার চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলায় চালান করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করা সম্ভব। বর্তমানে নির্বিচারে নানা কারণে বাঁশ কাটা হচ্ছে। এক শ্রেণীর মানুষ সচেতনতার অভাবে বাঁশের কাঁচা মুথা তুলে বিক্রি করছে। আর এলাকার ইটভাটা মালিকরা সস্তায় এসব হাজার হাজার মণ বাঁশের মুথা কিনে ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহার করছে। আমাদের দেশে সাধারণত দুভাবে বাঁশের বংশ বিস্তার করা যায়।
বাঁশের কাঁচা চোখওয়ালা গাঁটসহ বাঁশ লাগিয়ে ও  কাঁচা কঞ্চি গাঁটসহ কেটে ডাল কলমের মাধ্যমে নতুন বাঁশ উৎপাদন করা যায়। চুয়াডাঙ্গায় প্রথমোক্ত পদ্ধতিতে বাঁশ লাগানো হয়। বাঁশ লাগিয়ে ভালোভাবে পরিচর্যা করলে ৪/৫ বছর পর থেকে বাঁশ কাটা যায়। কথায় আছে দাতার নারকেল আর বখিলের বাঁশ। তাই বাঁশ লাগানোর পরই কাটা যায় না। বাঁশ লাগিয়ে  ভালোভাবে ঝাড় তৈরি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করলেই ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। দর্শনা বাজারের বাঁশ ব্যবসায়ী মনিরুল,লাল্টু ও কাদের জানান, আমরা প্রায় ৩০-৩৫ বছর ধরে বাঁশের ব্যবসা করছি। আগে আমাদের এলাকায় প্রচুর বাঁশ পাওয়া যেত এবং দামও ছিল কম। এখন আর আগের মতো বাঁশ পাওয়া যায় না। আগের তুলনায় এলাকায় বাঁশ উৎপাদন অনেক কমে গেছে। কারণ প্রতি বছর যে পরিমাণ বাঁশ কাটা হয় সেই তুলনায় লাগানো হয় না। কয়েক দশক আগেও জেলার বিভিন্ন এলাকায় বড় বড় বাঁশঝাড় ছিল যা বর্তমানে আর দেখা যায় না।
বর্তমানে জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে আকারভেদে প্রতিটি বাঁশ ২শ থেকে ৩শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমাদের দেশে কৃষি জমিতে বাঁশ লাগানো হয় না। তবে বাড়ির আশপাশের পতিত জমি, ফলজ ও বনজ বাগানের সাথে বাঁশ লাগিয়ে একটু যত্ন নিলে বাঁশও লাভজনক হতে পারে। তাই নিজেদের প্রয়োজনেই বাঁশ লাগানো ও এর সঠিক পরিচর্যা প্রয়োজন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ