শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

অনল প্রবাহ’র কবি ইসমাঈল হোসেন সিরাজী

মোঃ জোবায়ের আলী জুয়েল :  বিখ্যাত লেখক, বাগ্মী, অনল প্রবাহ কাব্য রচয়িতা, মুসলিম পুনর্জাগরণ ও ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের অগ্রদূত ইসমাঈল হোসেন সিরাজী ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুলাই সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন।

বহু প্রতিভার অধিকারী মানুষটি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবান্ধিক, সাংবাদিক, বাগ্মী, সমাজ সংস্কারক, সংগঠক, ইসলাম প্রচারক, রাজনীতিক, সৈনিক, নারী শিক্ষা ব্রতী ও সঙ্গীত রচয়িতা। তাঁর পিতার নাম শাহ সৈয়দ আব্দুল করিম এবং মাতা নূরজাহান খানম।

সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর হাতে খড়ি গ্রাম্য পাঠশালায়। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে সিরাজগঞ্জ বিএল হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ  স্কুলেই সিরাজীর ছাত্র জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। অর্থাভাবে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভে ব্যর্থ হন। তিনি কেবল ব্যক্তিগত চেষ্টায় যেটুকু লেখাপড়া শিখেছিলেন তা’ তাঁর অসামান্য প্রতিভার পরিচায়ক। শৈশবকাল থেকেই তিনি অসামান্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি ধর্ম, সাহিত্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। মাইনর স্কুলে পড়ার সময় তাঁর সাহিত্য প্রতিভার স্ফুরণ গটে এবং তিনি কবিতা রচনায় হাত দেন। 

সিরাজীর প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘অনল প্রবাহ’ লেখার কারণে কারা বরণ করেন এবংসেই প্রথম কোনো মুসলমানের বই বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশ সরকর। এই কাব্য গ্রন্থে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিষোদগারের অভিযোগে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে কবির বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ৯ সেপ্টে¥বর তাঁকে দু’বছর সশ্রম কারাদ-ে দ-িত করা হয়। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে কবি বর্তমান ঝাড়খ-ের হাজারীবাগ জেল থেকে মুক্তি পান।

দেশ ও জাতির সেবা করাই তার জীবনের প্রধান ব্রত ছিল। এই ব্রত পালনের জন্য তিনি বাংলার গ্রামে গঞ্জের মানুষের সাথে নীবিড় ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি সেকালে বাংলার সভা সমিমিতে জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদান করতেন। তিনি লেখনীকে পরবর্তীতে জীবনের প্রধান অবলম্বন হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। তার অথ্যন্ত মননশীল মেধা, ধিশক্তি ও গেীরক নি¯্রাবের মতো অনলবর্ষী বক্তৃতায় বাংলার ঘুমন্ত মুসলমানেরা ঘুমের ঘোর কেটে আত্মসন্ধিৎ ফিরে পায়। পরবর্তী যুগের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তারই মানস সন্তান।

তিনি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অপরাজেয় সেনা নায়ক ছিলেন। সেজন্য তাঁকে ব্রিটিশের হাতে বহু নিগ্রহ ভোগ করতে হয়েছিল। একাধারে ইংরেজ ও অন্য ধারে হিন্দু সম্প্রদায় এই দু’দলের সঙ্গে তিনি কথা ও কাজে সব্যসাচীর মতো আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর ‘অনল প্রবাহ’ (১৯০০ খ্রিঃ) নামক কাব্যই এই সংগ্রামের প্রধান কীর্তি স্তম্ভ। এই কাব্যে তিনি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যয়ের ‘ভারত সঙ্গীত’ নামক গাঁথার ছন্দে যে অনলবর্ষী ছন্দ সৃষ্টি করেন তা, ইংরেজ কামানের গোলাবর্ষণ থেকেও ফলদায়ক হয়ে উঠেছিল। তাই বাধ্য হয়েই এই ‘অনল প্রবাহ’ কাব্য ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে।

জেল থেকে কারা মুক্তির পর বলকান যুদ্ধে বিপর্যস্ত তুরস্কের সাহায্যর্থে গঠিত অল ইন্ডিয়া ‘মেডিক্যাল মিশন’ এর সহযোগী হিসেবে ২রা’ ডিসেম্বর তুরস্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানে তিনি যুদ্ধের ময়দানে আহত সৈনিকদের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য তুরস্ক সরকার কবিকে ‘গাজী’ উপাধীতে ভূষিত করেন। এ সময় কবি সিরিয়াও ভ্রমন করেন। সভা-সমাবেশে ভাষণ দেয়ার জন্য তিনি সমগ্র বাংলা সফর করেন।

তার সেবা-ধর্ম, ইসলাম ও মুসলিম প্রীতি এবং স্বাজাত্যবোধ এতই প্রবল ছিল যে, তিনি স্বাধীনতার জন্য আজীবন ভারতীয় কংগ্রেসের একজন খ্যাতনামা সদস্য ও জন-নায়ক রূপে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কবি সক্রিয়ভাবে নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯১৯-১৯২৩ সালের খিলাফত ও অহিংস আনেআলনে রেখেছিলেন বিরাট ভূমিকা। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের নেতৃত্বে স্বরাজ দল গটিত হলে তাতে তিনি যোগ দেন। ১৯২৪ সালে সিরাজগঞ্জে বঙ্গীয় মোসলেম মাহাসভায় অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ১৯২৭ সালের ১৫ ও ১৬ আগস্ট কোলকাতার অ্যালবার্ট হলে অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গীয় ধর্মীয় সম্মেলনের সভাপতি, ১৯২৭ সালের ২৫ অক্টোবর মোসলেম তরুণ সংঘের সভায় সভাপতি ইত্যাদি পদ অলঙ্কৃত করেন। ১৯২৯ সালে প্রাদেশিক আইন সভার প্রার্থী হিসেবে ফরিদপুর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মহান ব্যক্তিত্ব ইসমাঈল হোসেন সিরাজী ছিরেন বাঙালী মুসলিম রেনেসাঁর অন্যতম অগ্রদূত। তিনি ছিলেন জাতীয় জাগরণের প্রবক্তা এবং ক্ষুরধার লেখনীর কবি ও সাহিত্যিক। মুসলিম তরুণদের কাছে তিনি ছিলেন বিপ্লবী আলোকবর্তিকা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলম তাকে বাংলার তারণ্যের পথ প্রদর্শক আলোকবর্তিকা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। 

তিনি দরিদ্র ছিলেন বটে, কিন্তু তা’ তার স্বল্প আয়ের জন্য নয়। তিনি ‘দয়ার সাগর’ নামে পরিচিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকেও দয়ায় হার মানিয়ে দেন।

গ্রন্থ বিক্রয় করে ও বহু বক্তৃতা দিয়ে তার সে সময় প্রচুর অর্থ উপার্জন হতো। তিনি বাড়িতে দরিদ্র ছাত্রের জন্য দান-সত্র খুলেছিলেন। শত শত ছাত্র তার এই অর্থে লেখাপড়া করতো। স্ত্রী শিক্ষার জন্যও তিনি জীবন পাত করে গেছেন।

সম সাময়িক পত্রিকা আল-এসলাম, ইসলাম প্রচারক, প্রবাসী, কোহিনূর, সোলতান, মোহাম্মদী, সওগাত, নবযুগ ও নবনূর প্রভৃতিতে তার গঠনমূলক লেখা প্রকাশি হতো। তার অধিকাংশ লেখাতেই ইসলাম ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও উত্তরাধিকারকে উদ্দীপ্ত করে তোলার প্রয়াস ছিল। ইসমাঈল হোসেন সিরাজী সিরাজগঞ্জে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি জমিদার ও মহাজন বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের সংগঠিত করেন।

সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী সেকালে বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তার গ্রন্থের সংখ্যা অনেক। কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী ও সঙ্গীত বিষয়ে এ পর্যন্ত তার একত্রিশ খানা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়া সম-সাময়িক পত্র-পত্রিকা সাময়িকীতে বিভিন্ন বিষয়ে তার প্রায় তিন শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এখানে তার রচিত প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত সেই একত্রিশ খানা গ্রন্থের পরিচিতি তুলে ধরা হলোÑ

কাব্য: (১) অনল প্রবাহ (১৯০০) খ্রিঃ) [তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বইটি বাজেয়াপ্ত করে লেখককে দু’বছর কারাদ- দিয়েছিলেনৎ (২) উচ্ছ্বাস (১৯০৭ খ্রিঃ) (৩) উদ্বোধন (১৯০৭ খ্রিঃ) (৪) নবউদ্দীপনা (১৯০৭ খ্রিঃ) (৫) উৎসব (১৯০৭ খ্রিঃ) (৬) স্পেন বিজয় কাব্য (১৯১৪ খ্রিঃ) (৬) সঙ্গীত সঞ্জীবনী (১৯১৫ খ্রিঃ) বিবিধ কবিতা ও গান (৮) প্রেমাঞ্জলী (১৯১৬ খ্রিঃ) গীতিকাব্য (৯) গৌরব কাহিনী (প্রকাশিত) (১০) আবেহায়াত (প্রকাশিত) (১১) পুষ্পাঞ্জলী (প্রকাশিত) (১২) কাব্য কুসুমোদ্যান (প্রকাশিত (১৩) মহাশিক্ষা কাব্য (প্রকাশিত) মাহাকাব্য।

উপন্যাস: (১৪) রায় নন্দিনী (১৯১৮ খ্রিঃ) ঐতিহাসিক উপন্যাস (১৫) তারাবাঈ (১৯২২ খ্রিঃ) ঐতিহাসিক উপন্যাস (১৬) ফিরোজা বেগম (১৯২৩ খ্রিঃ) ঐতিহাসিক উপন্যাস (১৭) নূরুদ্দীন (১৯২৪ খ্রিঃ) ঐতিহাসিক উপন্যাস।

ভ্রমণ কাহিনী: (১৮) তুরস্ক ভ্রমণ (১৯১৩ খ্রিঃ) ভ্রমণ কাহিনী (১৯) তুরস্কের ডায়েরী (প্রকাশিত) ভ্রমণ কাহিনী (২০) সিরিয়া ভ্রমণ (অপ্রকাশিত) ভ্রমণ কাহিনী।

প্রবন্ধ: (২১) আদব কায়দা শিক্ষা (১৯০৭ খ্রিঃ) সামাজিক প্রবন্ধ (২২) স্বজাতি প্রেম (১৯০৯ খ্রিঃ) (২৩) সুচিন্তা (১৯১০ খ্রিঃ) (২৪) তুর্কী নারী জীবন (১৯১৩ খ্রিঃ) সামাজিক ইতিহাস (২৫) স্ত্রী শিক্ষা (১৯১৪ খ্রিঃ) সামাজিক প্রবন্ধ (২৬) স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা (১৯১৬ খ্রিঃ) সাংস্কৃতিক ইতিহাস (২৭) কারা কাহিনী (১৯১৬ খ্রিঃ) অপ্রকাশিত (২৮) মুক্তি বাণী (প্রকাশিত) (২৯) বিবিধ প্রবন্ধ (প্রকাশিত) অন্যান্য: (৩০) নব উদ্দীপনা (৩১) মহানগরী কর্ডোভা।

সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তিনি দক্ষতার সাক্ষর  রেখে গেছেন। সাপ্তাহিক ‘হাবলুল মতীন’ পত্রিকার তিনি সহকারী সম্পাদক ছিলেন্ ১৯১৯ খ্রিস্টাবেদর সচিত্র মাসিক পত্র ‘নূর’ প্রকাশ ও সম্পাদনা এবং ১৯২৩ সালে নব পর্যায়ে প্রকাশিত ‘ছোলতান’ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

এই ক্ষণজন্মা কবি বহু প্রতিভার অধিকারী, মানবদরদী, দেশ হিতৈষী, সমাজ সংস্কারক ও স্বাধীনতার অগ্রপথিক সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাই মাত্র ৫১ বছর বয়সে নিজ জন্মভূমি সিরাজগঞ্জে মৃত্যুরবরণ করেন। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ