শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

অথঃ সাভারের এমপির ক্রসফায়ার এবং জোটের রাজনীতি প্রসঙ্গ

নির্বাচন সামনে আসছে। সেজন্য জোট বাঁধার  হিড়িক পড়েছে। তাই আজ জোটের রাজনীতির কথা বলবো। তার আগে অতীব চাঞ্চল্যকর ও ভয়াল একটি বিষয় নিয়ে দুটো কথা বলা দরকার। সেটি হলো সাভারে সরকারদলীয় এমপি ডাক্তার এনামুর রহমানের কীর্তি। সত্যিই তিনি কীর্তিমান। গত ১৯ জুলাই বুধবার দৈনিক “মানব জমিন” পত্রিকায় এনামুর রহমান সম্পর্কে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরটি নীচে হুবহু তুলে দিচ্ছি।
ঢাকা-১৯ এ নতুন হিসাব-নিকাশ
৫ জনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছি, ১৪ জনের লিস্ট করেছি
ডা. এনামুর রহমান
কাজী সোহাগ, সাভার থেকে। ১৯ জুলাই ২০১৭, বুধবার
সাভারের বর্তমান এমপি ডা. এনামুর রহমান নির্বাচনী এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মোবাইল ফোনে মানব জমিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, সাভারে অনেক ক্যাডার আর মাস্তান ছিল। এখন সব পানি হয়ে গেছে। কারও টুঁ শব্দ করার সাহস নেই। ৫ জনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছি। আরো ১৪ জনের লিস্ট করেছি। সব ঠা-া। লিস্ট করার পর যে দু’একজন ছিল তারা আমার পা ধরে বলেছে, আমাকে জানে মাইরেন না, আমরা ভালো হয়ে যাবো। (ডা. এনামুর রহমানের বক্তব্যের রেকর্ড রয়েছে আমাদের কাছে)।
এলাকায় চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানকার ব্যবসায়ীরা ডাকলেও কেউ চাঁদা নিতে আসেন না। কারণ তারা জানে, এমপি জানলে সমস্যা হবে। ঝুট ব্যবসা নিয়ে আগে কতকিছু হতো। এখন এসব নিয়ে টুঁ শব্দও নেই। প্রধানমন্ত্রী এসবের জন্য আমাকে ডেকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
ডা. এনামুর রহমান বলেন, আমার মতো কোনো নেতা রাজনৈতিক তৎপরতা চালায়নি। সব সময় এলাকায় থাকি। মানুষের পাশে থাকি। দলের এমন অনেক কর্মসূচি ছিল যা কখনো পালন করা হয়নি। আমি এমপি হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সব ধরনের কর্মসূচি পালন করেছি।
তিনি বলেন, আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা আমার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ না পেয়ে মুখরোচক বক্তব্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। সাভারের এটা কালচার। যেই ভালো কাজ করবে তার বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারি ছড়ানো হবে। আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষ আমার সম্পর্কে ভালোভাবে জানে। এসব বিষয় নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত নই।
এই সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার পরদিন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ডাক্তার এনামুর রহমান সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বিজ্ঞাপনটি হুবহু নীচে তুলে দেয়া হলো।
অনাকাক্সিক্ষত বক্তব্য প্রত্যাহার ও দুঃখ প্রকাশঃ-
“৫ জনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছি, ১৪ জনের লিস্ট করেছি” শিরোনামে গত ১৯ জুলাই দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় ক্রসফায়ার সংক্রান্ত আমার যে বক্তব্য ছাপা হয়েছে তা অনভিপ্রেত, অশোভনীয় ও নিন্দনীয়। প্রকৃতপক্ষে আমি যে বিষয় আলোকপাত করতে চেয়েছিলাম তা যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে না পারায় বক্তব্যের জন্য আমি লজ্জিত, দুঃখিত জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। এই  অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত বক্তব্যটি ছিল একান্তই আমার ব্যক্তিগত। এর দায়িত্ব আমার নিজের এবং এর সংগে সরকার কিংবা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কোন সংশ্লিষ্টতা এমনকি নীতিগত কোনো প্রতিফলন নেই। আমি আমার অবিবেচনা সুলভ বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। একই সঙ্গে এ ব্যাপারে কাউকে বিভ্রান্ত না হবারও অনুরোধ করছি।
নিবেদক
ডা. এনামুর রহমান
সংসদ সদস্য, ঢাকা-১৯
ডাক্তার এনামুর রহমান পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করার পরেও এই আলোচনা থেমে নেই। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এই ভয়ানক খবর নিয়ে আলোচনা করছে। কারণ,  তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেও মানব জমিনের সেই মূল রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ডাক্তার এনামুর রহমানের বক্তব্যের রেকর্ড মানব জমিনের কাছে রয়েছে। সুতরাং কঠোর বাস্তব এবং সত্য হলো এই যে, ডাক্তার  এনামুর রহমান সেই রক্ত হিম করা  উক্তি করেছেন। তার পর তখন দেখেছেন যে চারদিকে সাংঘাতিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে তখন তিনি  তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একবার একটি বক্তব্য দিয়ে ফেললে সেটি কি আর ফেরত নেয়া যায়? বিশেষ করে সেই বক্তব্যের রেকর্ড যদি কারো কাছে থাকে?
একাধিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ডাক্তার  এনামুর রহমানের এই বক্তব্য প্রচারিত হওয়ার পর চারদিকে ভয় এবং আতঙ্কের সৃষ্টি  হয়েছে। বিরোধী দলের কর্মীরাই নাকি তার কাছে বেশি যাচ্ছে। কারণ দেশে যতগুলো ক্রসফায়ার হয়েছে তার সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীরা। তারা তার নিকট গিয়ে নাকি জানতে চাচ্ছেন যে, ১৪ জনের যে লিস্ট তিনি পাঠিয়েছেন সেই লিস্টে তাদের নাম রয়েছে কিনা? খোদ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের একটি অংশও তার নিকট নাকি ধরণা দিচ্ছে। কারণ বিরোধী দলের রাজনৈতিক তৎপরতা অনেক কমে যাওয়ায় সরকারি দলের বিভিন্ন অংগ সংগঠনের কর্মীরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে এবং খুন  হয়ে যাচ্ছে। এই খুনাখুনি থামাবার জন্য এমপি যে লিস্ট পাঠিয়েছেন তার মধ্যে সরকারি দলের অংগ সংগঠনের ক্যাডারদের নাম রয়েছে কিনা সেটি জানার জন্য এনামুর রহমানের কাছে ধরণা দেয়া হচ্ছে। ওপরের যে দুটি গ্রুপের কথা বলা হলো  তাদের নাম যদি থেকে থাকে তাহলে লিস্ট থেকে তাদের নাম বাদ দেয়ার জন্য এনামুর রহমানের কাছে তদবির করা হচ্ছে।
এ সম্পর্কে একাধিক রাজনৈতিক নেতা এই মর্মে মন্তব্য করেছেন যে, সাভারের ঐ সংসদ সদস্য যে তথ্য দিয়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন সেটি পড়লে রক্ত হিম হয়ে যায়। এই ধরনের ভয়ংকর বক্তব্য দেয়ার পর তিনি জেলের বাইরে কেমন করে থাকেন সেটি নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে। অনেককে বলতে শোনা যায় যে, একমাত্র মগের মুল্লুকেই এই ধরনের  যা ইচ্ছে তাই বক্তব্য দেয়া যায়। সাত খুন করে এসে কেউ যদি দুঃখ প্রকাশ করে তাহলে সেই সাত খুনের অপরাধ মওকুফ হয়ে যায় না।
॥দুই॥
শুরু করেছিলাম জোট বাঁধার রাজনীতি নিয়ে। ইতোমধ্যেই দেশে দুইটি বড় বড় জোট রয়েছে। একটি হলো বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট আর একটি হলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে জাতীয় পার্টি রয়েছে এবং তাদের তিনজন মন্ত্রীও শেখ হাসিনার ক্যাবিনেটে রয়েছেন। তার পরেও পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ ২২/২৩ টি দল নিয়ে নাকি একটি জোট গঠন করছেন। এই জোটের নীতি হবে নাকি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী মূল্যবোধ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বলেন যে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০  দলীয় জোটের বিঘোষিত নীতি হলো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী মূল্যবোধ। এরশাদের জাতীয় পার্টি বর্তমানে সরকারের সাথে এবং সেই সুবাদে যে ১৪ দলীয় জোটে রয়েছে সেই জোটের বিঘোষিত নীতি হলো বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র  এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা। এছাড়া এরশাদ যে ২২-২৩ টি রাজনৈতিক দলকে  তার জোটে যুক্ত করতে চেয়েছেন তাদের অস্তিত্ব কোথায়? অন্ধকারে টর্চ লাইট দিয়ে খুঁজলেও এসব দলের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। সেজন্য তিনি ২২-২৩টি দলের কথা বলেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি দলের নামও তিনি  উল্লেখ করতে পারেন নি। রাজনৈতিক মহলের কাছে এরশাদের এই তথাকথিত জোট গঠনের উদ্দেশ্য  অত্যন্ত পরিষ্কার। সেটি হলো, ইসলামী মূল্যবোধ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা বলে বিরোধীদলীয় জোটের ভোটে কিছুটা ভাগ বসানো। ২০ দলীয় জোটের ভোট যত কাটা যাবে ততই আওয়ামী লীগের পক্ষে আরেকটি মেয়াদে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা উজ্জ¦ল হবে। তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এরশাদের ঐসব জোটফোট কিছু নয়। তাকে আসলে আওয়ামী লীগের ক্রীড়নক হিসেবে মাঠে নামানো হয়েছে।
গতকাল শনিবার ২২জুলাই ইংরেজি দৈনিক “নিউ এজে” আরেকটি জোট গঠনের  সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এটি হলো ৭ দলীয় বাম জোট। এই জোট চলতি মাসের শেষের দিকে অথবা আগামী মাসের প্রথম দিকে আত্মপ্রকাশ করবে বলে বলা হয়েছে। এখন নাকি জোটের ঘোষণাপত্র তৈরির কাজ চলছে। এই জোটে যারা অন্তর্ভুক্ত থাকবে তারা হলো, সিপিবি বা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ বা বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল, স্যোসালিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (মার্ক্সিস্ট), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের বিপ্লবী পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী দল এবং ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ। এই সাতদলীয় জোটের নাম দেয়া হয়েছে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। শক্তি যাই থাকুক অথবা সদস্য ও সমর্থক যাই হোক না কেন মিডিয়ার কল্যাণে সিপিবি এবং বাসদের নাম তবুও শোনা যায়। কিন্তু অবশিষ্ট দলগুলোর নামও শোনা যায়নি। সুতারাং তাদের শক্তি ও সমর্থনের আলোচনা অবান্তর। যারা ভেতরের খবর রাখেন  তারা বলেন যে, এই দলের নাটের গুরু হচ্ছে সিপিবি, যারা  পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত  আওয়ামী লীগের বি-টিম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
॥তিন॥
তবে  আরেকটি রাজনৈতিক জোট গঠনের কথা বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে ভেসে বেড়াচ্ছে। সেটি হলো আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বাইরে একটি তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি বা তৃতীয় রাজনৈতিক জোট। এই জোট গঠন এবং সমন্বয় সাধনের জন্য কয়েকদিন আগে আসম আব্দুর রবের উত্তরার বাসায় কয়েকটি ছোট দলের বৈঠক বসেছিল। দলগুলো ছোট হলেও এদের নেতারা অনেক সুপরিচিত। এদের সাংগঠনিক শক্তি যাই থাকুক না কেন, জনগণের কাছে এসব নেতার ফেস ভ্যালু রয়েছে। সেদিন যারা রবের বাসায় বৈঠকে বসেছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজা  চৌধুরী এবং তার পুত্র মাহি বি চৌধুরী, জেএসডির প্রেসিডেন্ট আ স ম আব্দুর রব এবং সেক্রেটারি আব্দুল মালেক রতন, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক এবং ঐ দলের অন্যতম নেতা প্রাক্তন এমপি আকরাম হোসেন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, বাসদের চৌধুরী খালেকুজ্জামান প্রমুখ। সভাটি সুষ্ঠুভাবে হতে পারেনি। সভাটি যখন শুরু হয় তখন থেকেই আ স ম রবের বাসা পুলিশ কর্ডন করে রেখেছিল। এছাড়া  সভা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর পুলিশ সভার মধ্যে ঢুকে পড়ে। এই নিয়ে পুলিশের সাথে সভায় উপস্থিত নেতৃবৃন্দের তর্কবিতর্ক হয়। প্রস্তাবিত তৃতীয় শক্তির নেতারা বলেন যে তাদের সামনে আশু লক্ষ্য হলো  দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। আর দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে একটি কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রে পরিণত করা।
নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে ততই জোটের প্রক্রিয়া দানা বাঁধছে। আগামী  দুই তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনী জোট গঠনের প্রক্রিয়া সমাপ্ত হবে এবং দেশে আগামী দিনের  রাজনীতির একটি পরিষ্কার চিত্র ফুটে উঠবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
[email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ