ধর্ষক শ্রমিকলীগ নেতা তুফান দ্বিতীয় দফা রিমান্ডে নাপিতের স্বীকারোক্তিমূলক জাবনবন্দী
বগুড়া অফিস : বগুড়ার দেশকাঁপানো ধর্ষণ ও মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া করার ঘটনার মূলহোতা শ্রমিকলীগ নেতা তুফান সরকারকে দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। প্রথম দফা তিন দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল বুধবার পুনরায় ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে বগুড়ার অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক শ্যাম সুন্দর রায় তুফান সরকার ও তার সহযোগী মুন্নার ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। একই সাথে তুফান সরকারের স্ত্রী আশা ও তার শ্বাশুড়ি রুমির একদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন এবং বাকি আসামীদের রিমান্ড নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। মামলার অপর আসামী কাউন্সিলর রুমকি ৪ দিনের পুলিশ রিমান্ডে রয়েছে। ধর্ষিতা ও তার মায়ের মাথা ন্যাড়া করা নাপিত জীবন রবি দাস গতকাল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। এদিকে, ধর্ষকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। গতকালও বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন সংগঠন। তবে, মহিলা দলের প্রতিবাদ মিছিলে বাধা দিয়ে ব্যানার কেড়ে নিয়েছে পুলিশ।
মুখ খুলছে না এলাকাবাসী
ধর্ষিতা কিশোরী ও তার মাকে মাথা ন্যাড়া করে দেয়ার ঘটনার মূলহোতা শ্রমিকলীগ নেতা তুফান সরকার ও তার বড় ভাই যুবলীগ নেতা (সদ্য বহিষ্কৃত) মতিন সরকারকে নিয়ে মুখ খুলছে না এলাকাবাসী। তাদের ধারনা অতীতের মতো আবারো তারা জামিনে বের হয়ে দাপটের সাথে কর্মকাণ্ড চালাবে। তবে, তুফান সরকার গ্রেফতারের পর তার ভাই মতিন সরকার আত্মগোপন করেছেন। শহরের চকসুত্রাপুর চামড়া গুদাম লেনে তাদের বাসা ফাঁকা পড়ে আছে। শহরবাসীর মুখে মুখে ফিরছে মতিন আর তুফানের নানা কাহিনী। এলাকায় ঘুরে তাদের সম্পর্কে পাওয়া গেছে নানা তথ্য। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং পুলিশের সাথে গভীর সখ্যতা থাকায় এলাকার লোকজন মনে করছেন পুলিশ তাদেরকে বাঁচিয়ে দিবে।
বেকারি শ্রমিক থেকে কোটিপতি
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তুফান সরকার ১০ বছর আগেও চকসুত্রাপুরে ঢাকা বেকারি নামের একটি কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতো। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এলাকায় হিরোইন ও গাঁজার পুড়িয়া বিক্রি করতো। ওই সময়ের মধ্যেই বড়ভাই মতিন সরকারের অর্থ বৈভব এবং ক্ষমতা বাড়তে থাকায় খুচরা গাঁজা বিক্রেতা তুফান সরকার হেরোইন ও ফেন্সিডিলের পাইকারি ব্যবসা শুরু করে। এতে অল্প সময়ের মধ্যে তার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। এ সময় তার প্রয়োজন পড়ে রাজনৈতিক পরিচয়ের। একই এলাকার পৌর কাউন্সিলর জেলা শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক সামছুদ্দিন শেখ হেলাল তাকে আহবায়ক করে শহর শ্রমিকলীগের একটি কমিটি গঠন করে দেন। ওই কমিটির সদস্যদের নিয়ে তুফান মাদক ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে র্যাবের হাতে ১৫’শ বোতল ফেন্সিডিল ও বিপুল অংকের টাকাসহ র্যাবের হাতে ধরা পড়ে তুফান। কিছুদিন হাজত বাসের পর জামিনে বের হয়ে আসে সে। মাদক ব্যবসা থেকে নিজেকে কিছুটা আড়াল করে গঠন করে ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সা মালিক সমিতি। এরপর শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে অর্ধশতাধিক কর্মীকে লাঠি হাতে রিক্সা থেকে চাঁদা তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়। চাঁদা তোলার কাজে পুলিশের সহযোগিতার পাশাপাশি শ্রমিকলীগ নেতা সামছুদ্দিন শেখ হেলাল প্রত্যক্ষ ভাবে সহযোতিা করতে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার লোকজন ব্যাটারি চালিত রিক্সা ধরে চকসুত্রাপুরে তুফানের আস্তানায় নিয়ে যেতো। এরপর সমিতিতে ভর্তি বাবদ আদায় করা হতো ৩ হাজার টাকা। এছাড়াও শহরে চলাচলের জন্য প্রতিদিন রিক্সা থেকে আদায় করা হতো ২০ টাকা করে চাঁদা। এভাবে ৬ হাজারের বেশি অটোরিক্সা থেকে আদায় করা হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। এখান থেকেই আঙ্গুল ফুলে কলা গাছে পরিণত হয় তুফান। চকসুত্রাপুরে বিল্ডিং বাড়ি, দুইটি বিলাসবহুল প্রাইভেট কার, শহরের চকযাদু সড়কে কোটি টাকা ব্যয়ে দোকানের মালিক হয়ে যায় তুফান সরকার। রিক্সা চালক মজিবর সরকারের ৭ম ছেলে তুফান সরকার কয়েক বছরের ব্যবধানে হয়ে ওঠে এলাকার ডন। মতিনের বিরুদ্ধে এখনও রয়েছে একাধিক হত্যা মামলা। সন্ত্রাসী মতিনের বগুড়া শহরে নাইন এমএম মতিন ওরফে কশাই মতিন ওরফে পিস্তল মতিন হিসেবে পরিচিতি রয়েছে। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার অভিযোগ। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থেকে মতিন গত কয়েক বছরের মধ্যে বাগিয়ে নিয়েছেন জেলা চামড়া ব্যবসায়ি মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক ও জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদকের পদ। ফলে মতিন এখন প্রশাসনে মতিন সাহেব হিসেবে পরিচিত। দুইযুগ আগে মতিন ছিনতাই এবং মাদক ব্যবসা করতো। কিন্তু সাহসী ছেলে হওয়ায় মতিনকে সেই সময় যুবলীগ টেনে নেয়। এরপর থেকেই মতিন যুবলীগ ক্যাডার হিসেবে শহরে পরিচিতি লাভ করে। যুবলীগ ক্যাডার হিসেবে কয়েকটি মার্ডার করে। নাইন এমএম পিস্তলসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। একাধিকবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন মতিন। সর্বশেষ ২০১২ সালে র্যাব মতিনের আস্তানায় তল্লাশী করে মাদকসহ গ্রেফতার করে। ওই ঘটনায় যুবলীগ র্যাব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শহরে আন্দোলন করে। জামিনে মুক্তিলাভের পর জেল গেট থেকে তার বিপুল সংখ্যক ক্যাডার মোটর শোভাযাত্রাসহ তাকে নিয়ে যায়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর মতিন কৌশল পাল্টিয়ে চামড়া ব্যবসায়ি ও ট্রাক মালিক সমিতির পদ বাগিয়ে নেয়। আর এই দুই পদের কারনে জেলা প্রশাসন পুলিশ প্রশাসনের কর্তাদের সাথে গড়ে তোলেন সখ্যতা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এলাকায় জায়গা জমি দখল থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন মতিন। তার প্রভাব লোক মুখে ছড়িয়ে পড়ায় শুধু বগুড়া শহর নয় জেলা বিভিন্ন এলাকা থেকে জমি জমার বিচার নিয়ে লোকজন আসতো মতিনের আস্তানায়। প্রতিদিন বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চকসুত্রাপুরে তার আস্তানায় বিচার কাজ চলতো। পাশাপাশি মদ ও জুয়ার আসরও বসতো সেখানে। অঢেল সম্পদের মালিক মতিন সরকারের ক্ষমতার দাপট এতটাই বেড়ে যায় যে তিনি স্বরাস্ট্রমন্ত্রী, নৌপরিবহনমন্ত্রী, পুলিশ সুপার এবং জেলা পুলিশের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। মতিনের সেইসব ছবি এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলেছে। আর এসব কারনেই সাধারণ মানুষ এই ঘটনার বিচার নিয়ে সংশয়ে রয়েছে। প্রশাসনের উপরওয়ালাদের সাথে সখ্যতার সুযোগে মতিন সরকার ও তার ভাইয়ের অপকর্ম চাপা পড়ে কি-না তা নিয়েও শংকিত সাধারণ মানুষ।
মহিলা দলের ব্যানার কেড়ে নিলো পুলিশ
শ্রমিকলীগ নেতা তুফান সরকার কর্তৃক কিশোরী ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর ধর্ষকের স্ত্রী, শাশুড়ি ও বড় শ্যালিকার নেতৃত্বে ধর্ষিতা ও তার মাকে নির্যাতন করে মাথা ন্যাড়া করার ঘটনায় প্রতিদিনই বগুড়ায় বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধন অব্যাহত রেখেছে। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল বুধবার বেলা ১২টার দিকে জেলা মহিলা দল দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে একটি ঝাড়– মিছিল বের করে। মিছিলটি সদর পুলিশ ফাঁড়ি পার হয়ে সার্কিট হাউজ রোডে যাওয়ার পথে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় মহিলা নেত্রীদের সাথে বাকবিত-ার একপর্যায়ে পুলিশ ব্যানার কেড়ে নেয় এবং মিছিলকারীদের সেখান থেকে হটিয়ে দেয়। প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশের বাধা প্রদান এবং ব্যানার কেড়ে নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়া সদর থানার ওসি এমদাদ হোসেন বলেন, মহিলা দল ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চেয়েছিল, এজন্য তাদের বাধা দেয়া হয়েছে। এছাড়া দুপুরে শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথায় মানববন্ধন করে ধর্ষক তুফান সরকার ও তার সহযোগীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছে একটি বামপন্থী নারী সংগঠন।