রোগীর চেয়ে ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি বেশি
ইকবাল মজুমদার তৌহিদ, সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ) : সোমবার সকাল ৮:১৫ মিনিট। টিকিট কাউন্টারের সামনে কয়েকজন নারী লাইন ধরে দাড়িয়ে আছে। কিন্তু কাউন্টারে টিকিট দেওয়ার মত কোন লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঘড়ির কাটায় যখন ৮:৩০ মিনিট হাসপাতালের বেশীর ভাগ কক্ষের দরজা জানালা খোলা থাকলেও বেশীর ভাগ ডাক্তার, নার্স ও স্টাফরা ছিলেন অনুপস্থিত। ঘড়ির কাটায় সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আস্তে আস্তে ডাক্তার, নার্স ও স্টাফরা আসতে থাকেন। তবে হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষমান রোগীর চেয়ে কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের উপস্থিতি বেশী লক্ষ্য করা যায়।
গত সোমবার সরেজমিনে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। এরপর দুপুর পর্যন্ত হাসাপাতালে অবস্থান করে রোগী ও অন্যান্য লোকদের সঙ্গে আলাপ কালে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও ভোগান্তির কথা তুলে ধরেন।
টিকিট কাউন্টারের সামনে কথা হয় সোনারগাঁ পৌরসভার বাগমুছা গ্রামের সুমন মিয়ার সঙ্গে। তিনি তার অসুস্থ স্ত্রী সখিনা বেগমকে গাইনি বিভাগের ডাক্তার দেখাবেন। তিনি সকাল ৯টায় এসে ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কোন ডাক্তারের দেখা পাননি।
কৃষ্ণপুরা গ্রামের জামাল মিয়া বলেন, এই হাসপাতালে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা সেবা না দিয়ে হয়রানি করা হয়। শুধু কম দামের কিছু ওষুধ দিলেও ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকতে হয়। তিনি বলেন বেশীর ভাগ ওষুধই বাহির থেকে ক্রয় করতে হয়।
বৈদ্যের বাজার দামোদরদী গ্রামের শিউলী আক্তার বলেন, আমার ছেলের এলার্জি হয়ে সারা শরীর ফুলে যায়। ডাক্তার দেখানোর পর হাসপাতাল থেকে ওষুধ না দিয়ে একটি স্লিপ আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। পরে বাধ্য হয়ে বাইরের ফার্মেসি থেকে টাকা দিয়ে ওষুধ ক্রয় করতে হয়েছে।
সনমান্দি থেকে আসা রোগী শাহিনুর ইসলাম বলেন, হাসপাতালের চারদিকে ময়লা, আবর্জনা ও স্যাতসেতে পরিবেশ। মশা-মাছি ভনভন করছে চারদিকে। পরিবেশের কারণে রোগীরা এখানে ভর্তি হতে চায় না।
আনন্দ বাজার সোনামুখী গ্রামের রাশিদা বেগম বলেন, বেশীর ভাগ ডাক্তাররা ঢাকায় অবস্থান করেন। তারা সপ্তাহে দুই বা তিন দিন হাসপাতালে আসে হাজিরা দিলেও ঠিকমত রোগী দেখেন না।
ভট্টপুর গ্রামের নার্গিস আক্তার বলেন, তার অসুস্থ বাচ্চাকে নিয়ে তিনি হাসপাতালে এসেছেন। এখানকার ডাক্তাররা সব সময় তাদের কক্ষে বসে খোশ গল্পে ব্যস্ত থাকেন। জরুরি রোগী থাকলেও তারা দ্রুত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। সেজন্য সরকারি হাসপাতালে রোগী না এসে বে-সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগীরা ভিড় জমায়।
হাসপাতালে পুরুষ বেডে ভর্তি বৈদ্যের বাজার সাতভাইয়াপাড়া গ্রামের মনির হোসেন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় পায়ের হাড় ভেঙ্গে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ৮ দিন যাবৎ তিনি ভর্তি থাকলেও তাকে ভাল ও উন্নত চিকিৎসা না দেয়ায় তার পা’র এখনও কোন পরিবর্তন হয়নি।
বারদী ইউনিয়নের দৈলরদী গ্রামের রফিক মিয়া বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় তার মাথা কেটে যাওয়ার পর রোববার রাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সোমবার বেলা ১১টা পর্যন্ত কোন ডাক্তার তাকে দেখতে আসেন নি।
হাড়িয়া চান্দেরপড়া গ্রামের শাহপরান বলেন, তার পা ভেঙ্গে দেড় মাস যাবত হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। নি¤œ মানের খাবার ও ডাক্তারদের অবহেলার কারণে তার দিনের পর দিন অবনতি হচ্ছে। গরীব বলে টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা নিতে না পারায় এখানে পরে রয়েছেন।
লাহাপাড়া গ্রামের নাহিদা আক্তার বলেন, ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি দুই দিন পূর্বে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একটি স্যালাইন ও দুইটি ট্যাবলেট ছাড়া ডাক্তাররা তাকে আর কিছুই দেননি। এতে তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নার্সদের ঔষধের কথা বললে তারা আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন।
নুনেরটেক গ্রামের সাফিয়া বেগম বলেন, তিনি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গত দুই দিন যাবত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। দুই দিনে ডাক্তার একবার এসে তাকে দেখে নামমাত্র চিকিৎসা দিলেও কোন ভাল ওষুধ দেননি। এ বিষয়ে নার্সদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাকে হাসপাতাল থেকে অন্যত্র গিয়ে চিকিৎসা নিতে বলেন।
হাসপাতালের নিচ তলায় জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, মহসিন মিয়া নামে এক ওয়ার্ডবয় বেডে শুইয়ে রোগীকে ব্যান্ডিজ করছেন। ডাঃ নুর জাহান ইসলাম ও মেডিকেল এসিষ্ট্যান্ট হারুন অর রশিদ পার্শ্বের চেয়ারে বসে আসেন।
মহিলা বেডে গিয়ে দেখা যায়, চাঁদপুর জেলার নাছির উদ্দীন মিঞা নামে এক রোগীকে মহিলা বেডে ভর্তি করেছেন। এতে ওই বেডে থাকা নারী রোগীরা অস্বস্তি বোধ করছেন।
ল্যাব বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, টেকনিশিয়ান মনোয়ার বেগম তার চেয়ারে বসে মোবাইল ফোনে খোশ গল্পে মেতে রয়েছে। তার সামনে ১০/১২ জন রোগী বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য দাঁড়িয়ে থাকলেও সে দিকে তার কোন খেয়াল নেই।
এ্যাম্বুলেন্স চালক সামছুল হক সামসু হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্স না চালিয়ে ব্যক্তিগত এ্যাম্বুলেন্স মালিকদের দিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে রোগী পাঠান। এতে তিনি মালিকদের কাছ থেকে কমিশন পকেটে বুঝে নেন।
অফিস সহকারী নজরুল ইসলাম আওয়ামীলীগ নেতা হিসেবে নিজেকে জাহির করে সার্টিফিকেট বাণিজ্য ও আশপাশের ক্লিনিকে রোগী পাঠিয়ে অবৈধভাবে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
অফিসের ক্যাশিয়ার নুরুল আমিন বিভিন্ন ফাইলপত্র স্বাক্ষর, ডাক্তারদের বদলী, নিয়োগ, ছাড়পত্র দিয়ে অবৈধ ভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
হাসপাতালে হোমিও প্যাথলজি চিকিৎসার জন্য একজন ডাক্তার থাকলেও তিনি বেশীর ভাগ সময়ই অনুপস্থিত থাকায় রোগীরা জানেনই না এই হাসপাতালে হোমিও প্যাথলজির চিকিৎসা করা হয়।
আনোয়ারুল ভূঁইয়া নামে এক ব্যক্তি হাসপাতালের রোগীদের খাওয়ার দায়িত্ব পেলেও তিনি নি¤œমানের খাবার রোগীদের পরিবেশন করেন তিনি।
স্থানীয় সাহাপুর গ্রামের ফারুক হোসেন জয়রামপুর গ্রামের সজীব মিয়া ও সাহাপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন নামে কয়েকজন ব্যক্তির মালিকানাধীন এ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে সামনে দাড়িয়ে থাকে। সরকারি এ্যাম্বুলেন্স থাকার পরেও এ সকল এ্যাম্বুলেন্স দিয়ে রোগী বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়।
হাসপাতালের সামনে পানাম গ্রামের আনোয়ার হোসেন, জিয়ানগর গ্রামের জামাল মিয়া, সাহাপুর গ্রামের আবুল হোসেন, নজরুল ইসলাম, ভট্টপুর গ্রামের মহিউদ্দিনসহ প্রায় ৮/১০টি ফার্মেসী রয়েছে। এ সকল ফামের্সিতে প্রায় দ্বিগুন দামে রোগীদের কাছে ওষুধ বিক্রি করা হয়। হাসপাতালে প্যারাসিট্যামল, এন্টার্সিট, হিস্টাসিন, আয়রন, এমোক্সোসিলিন ও গ্যাষ্টিকের ওষুধ ছাড়া কোন ওষুধই দেওয়া হয় না। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে হাসপাতালের ডাক্তারদের সখ্যতা থাকায় কমিশনের বিনিময়ে তাদের ওষুধ পেনক্রিপশনে লিপিবদ্ধ করে থাকেন এবং ফার্মেসি মালিকরা অবৈধ লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বাসা হাতপাতালের কাছে থাকলেও তিনি এখানে না থেকে তিনি ঢাকার বাসায় বসবাস করেন। এই বাসায় থাকেন মুগদা ৫’শ শয্যা হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ লোকমান হোসেন।
অপারেশন থিয়েটার থাকলেও বেশীর ভাগ সময় তালাবদ্ধই থাকে এই বিভাগ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তানভীর আহাম্মেদ বলেন, সোনারগাঁ উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা সহ পাশ্ববর্তী আড়াইহাজার ও মেঘনা থানার কয়েক লক্ষ লোকের বসবাস। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৫’শ থেকে ৬’শ রোগী চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। তিনি বলেন, হাসপাতালটিতে বর্তমানে যে হারে রোগী বাড়ছে সে ভাবে আমরা রোগীদের স্থান দিতে পারি না। তাই হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নিত করলে এলাকাবাসীর জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা যাবে। সোনারগাঁ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শাহীনুর ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে মৌখিকভাবে অভিযোগ পেয়েছি। সরেজমিনে তদন্ত করে অভিযুক্ত ডাক্তার, নার্স ও স্টাফদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে সোনারগাঁ আসনের সংসদ সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, সোনারগাঁয়ের কয়েক লাখ মানুষ একটি সরকারি হাসাপাতালের চিকিৎসা নিতে হয়। ডাক্তারদের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে কোন লোক কষ্ট করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, জনসংখ্যার দিক চিন্তা করে হাসপাতালটিকে ৫০ শয্যায় উন্নিত করার জন্য ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দেয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলেই খুব শিঘ্রই নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হবে।