শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

বুথিদংয়ের উত্তর-পূর্বে নারাইংশং ও মিঙগিছি গ্রামের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট

বুথিদংয়ের উত্তর-পূর্বে নারাইংশং ও মিঙগিছি গ্রামের ঘরবাড়িতে মগসেনাদের অগ্নিসংযোগ -সংগ্রাম

কামাল হোসেন আজাদ ও শাহনেওয়াজ জিল্লু, কক্সবাজার : মংডু ও বুথিদং শহরতলীর উত্তর-পূর্বে এক এক করে ৫টি রোহিঙ্গা গ্রামে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে বর্মী সেনারা। গত শুক্রবার ভরদুপুর-এ ঘটনা শুরু হলেও গতকাল রোববার পর্যন্ত চলতে থাকে। যার ফলে এখনো বাংলাদেশে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০জন করে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।

সূত্র জানিয়েছে, তংবাজারের নিকটবর্তী গ্রাম নারাইংশং ও মিনগিছিতে সকাল থেকে সামরিক সদস্যরা রোহিঙ্গাদের বাড়ি ঘরে গিয়ে তল্লাসির নামে লুটপাট চালায়। এসময় স্বর্ণালংকার, নগদ টাকা, দামি আসবাবপত্র, মোবাইল সেট, সৌর প্যানেল ও গবাদিপশু লুট করে নিয়ে যায়। পরে বেলা দেড়টার দিকে পেট্রোল ঢেলে মশাল দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ধাওয়া করে গ্রামের রোহিঙ্গাদের। ভোক্তভুগি রোহিঙ্গারা দিকবিদিক ছুটে পালায়। নদী পাড়ের ঝোপঝাড়ে এবং পাহাড়ে আশ্রয় নেয় অনেকে। গবাদি পশু লুট করে নিয়ে যাওয়ার সময় একটি গরু সামনে অগ্রসর না হলে, কুড়াল দিয়ে পিঠে আঘাত করে গরুটিকে ফেলে চলে যায়। এ ঘটনায় আশে পাশের গ্রামের অনেক রোহিঙ্গারাও পালিয়ে যাচ্ছে। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বাংলাদেশের দিকে ছুটে আসছে তারা। আতংক, উৎকন্ঠা ও শঙ্কা বিরাজ করছে সর্বত্র।

এদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন ও বার্মার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার ঈঙ্গিত পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে বার্মার সরকার ও সেনাবাহিনী। আরাকানে লোক দেখানো ত্রাণ বিতরণ এবং বার্মার অভ্যন্তরের উদ্বাস্তুদের ঘরে ফেরার আহ্বান জানিয়েছে সেনা প্রধান মিন অংহ্লাইং। গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে “উদ্বাস্তু” শব্দ উল্লেখ করলেও এর দ্বারা রোহিঙ্গাদের বুঝিয়েছেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। তাছাড়া বাংলাদেশে আশ্রিত লাখ লাখ রোহিঙ্গার বিষয়ে সেনা প্রধান কোন কিছু বলেননি।

একদিকে উদ্বাস্তুদের ঘরে ফেরার আহ্বান জানালেও অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করছে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো। গত জুমাবার ও শনিবারও মংডুর পাঁচটি রোহিঙ্গা গ্রামে আগুন দিয়েছে সেদেশের সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলীও করেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীর পাঠানো তথ্য ও ছবিতে দেখাগেছে, গত বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টার সময় দক্ষিণ মংডুর ফ’খালীর রোহিঙ্গা গ্রাম পুতিপাড়ায় অগ্নিসংযোগ করে সামরিক বাহিনী। এতে পুড়ে ছাই হয়ে যায় রোহিঙ্গা বসতবাড়িগুলো। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। ঘটনাস্থল থেকে দুই কিলোমিটার দূরের চালিপ্রাং থেকে ভিডিও ধারণ করে কয়েকজন রোহিঙ্গা যুবক এসব তথ্য ও ছবি সংবাদদাতার নিকট পাঠিয়েছে। 

এছাড়া ফ’খালী এবং বাংলাদেশ সীমান্তের তুম্ব্রুর তিনটি গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে সেনারা। সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলী চালিয়েছে। গুলীতে কেউ বিদ্ধ না হলেও অজ্ঞান হয়ে পড়ে অনেকে। নো-ম্যান্স ল্যান্ডে দিনাতিপাত করা রোহিঙ্গারা যেকোন সময় প্রাণ নাশের আশংকা করছেন।

এদিকে বুথিদং-এর প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধারা বিভিন্ন পল্লীর রোহিঙ্গাদেরকে চাল, ডাল, আলু প্রভৃতি দিতে বাধ্য করে। পরে নির্দিষ্ট স্থানে রোহিঙ্গাদের ডেকে নিয়ে তা বিতরণ করেছে তারা। এসময় ত্রাণ বিতরণের ফটো ও ভিডিও নেয় প্রশাসন। ধারণা করা হচ্ছে, গণমাধ্যমে প্রকাশ এবং আন্তর্জাতিক মহলে দেখানোর জন্য “ত্রাণ বিতরণ নাটক” করছে প্রশাসন।

আরাকানের একজন মুসলিম সংবাদকর্মী জানিয়েছে, মংডু, বুথিদং ও রাথিদং-এর পর এবার সেনাবাহিনী আকিয়াবের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে আকিয়াবের পাথরকিল্লা তথা ম্রাউক নগরীর আশে পাশের রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে সেনা সমাগম হচ্ছে। গত শনিবার থেকে সেখানেও অভিযান শুরু করেছে।

এছাড়াও আরাকানের রাজধানী আকিয়াবের মাম্ব্রায় রোহিঙ্গাদের হয়রানি করে চলেছে বর্মী সৈন্যরা। গত বুধবার মাম্ব্রার হত্তিপাড়ায় সেনাদের পরিকল্পিত স্থল মাইন বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাদের হয়রানি করছে।

সূত্র জানিয়েছে, মাম্ব্রার ছেত্তা পাড়া ও হত্তিপাড়ায় গতকাল রবিবার সকালেও রোহিঙ্গাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাসী চালিয়েছে সেনা সদস্যরা। এসময় ঘরের আসবাবপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে। দামি মোবাইল পাওয়া গেলে তা ছিনিয়ে নেয়। নারীদের শ্লীলতাহানী করে। সৈন্যদের সহায়তা করে স্থানীয় অতিউৎসাহী রোহিঙ্গা বিদ্বেষী রাখাইনরা।

এর আগে স্থানীয় পুলিশ প্রধান বিস্ফোরণের ঘটনায় রোহিঙ্গারা জড়িত নয় বলে সেনা সদস্যদের বর্ণনা দেন। তারপরও রোহিঙ্গাদের হয়রানী করে যাচ্ছে সৈন্যরা।

মংডু, বুথিদং ও রাথিদং এর মতো রোহিঙ্গাদের দমন পীড়ন চালানোর জন্য ইস্যু তৈরী করছে সেনাবাহিনী এমন ধারনা করছেন রোহিঙ্গারা।

ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে গেল রোহিঙ্গা মেয়ে ইয়াসমিনের!

ইয়াসমিন। বয়স চৌদ্দ পনের’র কৌটায়। আরাকানের মংডু উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। ক্লাসের রোল নম্বর ছিল ২। শুধু মেধাবী নয়, তুখোড় মেধাবী শিক্ষার্থীর এক উদাহরণ ছিল এমেয়েটি। জীবনের লক্ষ্য ছিল ডাক্তার হওয়া। আরাকানের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির হতদরিদ্র বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে নিজ হাতে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল মেয়েটি। কিন্তু ২৪ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া ভয়াবহ সেনা বর্বরতায় সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল ইয়াসমিনের। অন্য দশজন রোহিঙ্গার মত ইয়াসমিনের পরিবারও প্রাণ বাঁচাতে চলে যায় বাংলাদেশে। হয়ে যায় ভাগ্যবিড়ম্বিত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু।

সংবাদদাতার সাথে কক্সবাজারের কুতুপালং-এ কথা হয় ইয়াসমিনের। ইয়াসমিন জানান, তার বাবা জহির উদ্দিন ছিলেন মংডুর হাইন্দা পাড়া এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান। মা মসুদা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। এলাকায় তাদের সুপরিচিত ছিল। তাদের পরিবারের সদস্যদের লোকেরা সম্মান করতো। অর্থ প্রতিপত্তি সবকিছুই ছিল তাদের। ছিল বহু জায়গা-জমি। কিন্তু বর্মী মগসেনাদের কালো থাবা সব নিঃশেষ করে দিয়েছে।

ইয়াসমিন আরো জানান, ৭ ভাইবোনের মধ্যে সে ২য়। লেখাপড়ার প্রতি অদম্য ইচ্ছা আর প্রতিক্লাসে কৃতিত্ব অর্জনের কারণে বাবা-মা দু’জনই তাকে খুব আদর করতো। এমনকি সহপাঠিদের মধ্যেও তার আলাদা একটা গুরুত্ব ছিল। বাবা-মা দু’জনই শিক্ষিত হওয়ায় তাকে লেখা পড়ার প্রতি অনুপ্রেরণা যোগাতেন। তার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণে উৎসাহ দিতেন বাবা।

ইয়াসমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “পঁইস তারিখ শুক্কুবারে আঁর বাবারে দরি নিগিয়ই মেলিটেরীঅলে। তারপত্তুন বাবারে আর তোয়াই ন’ফাই। বাবা বাঁচি আছেনে মরি গিয়ই হইত্ নফারি”। অর্থ্যাৎ ২৫ আগস্ট শুক্রবার আমার বাবাকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে যায় মিলিটারীরা। তারপর থেকে আর বাবার খোঁজ পায়নি। বাবা বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন তাও জানিনা।

কিছুক্ষণ গুঙ্গিয়ে নিরবে চোখের পানি ঝরায় ইয়াছমিন। তারপর নিরবতা ভেঙ্গে আবার বলা শুরু কওে সে। তার বলা কথাগুলোর অনুবাদ হুবহু এরকম। বার্মায় রোহিঙ্গাদের পড়াশুনার তেমন সুযোগ সুবিধা নেই। কেউ পড়তে চাইলে তাকে মঘের নাম দিয়ে স্কুলে ভর্তি হতে হয়। পড়ালেখায়ও বৈষম্য করে রাখাইন ছাত্র ও শিক্ষকরা। “ক্বলা ছা” বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে।

ক্বলা ছা মানে কি জানতে চাইলে ইয়াছমিন বলেন, ‘ক্বলা’ মানে বাঙ্গালি আর ছা মানে বাচ্চা অর্থাৎ বাঙ্গালীর বাচ্ছা। সে জানায়, রোহিঙ্গাদের হেয় করে অপমানজনকভাবে রাখাইন ও বর্মীরা এটা বলে থাকে।

ইয়াছমিন বলেন, সব অপমান সয়েও আমরা বেশ ক’জন রোহিঙ্গা ছাত্রছাত্রী পড়ছিলাম। কিন্তু এবছর থেকে রোহিঙ্গা ছাত্রছাত্রীদের জাতীয় কোন দিবসের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে দেয়নি। সামনে থেকে স্কুলে ভর্তি করা হবেনা বলে ঘোষণাও দিয়েছে।

ইয়াছমিন বলেন, এত এত বৈষম্যের পরও রোহিঙ্গা ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে। গত বছরের অক্টোবরের সহিংসতার পরও মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অনেকজন গুন্ডা (জিপিএ ফাইভ) পেয়েছে। পরীক্ষা দিতে পারলে এবার আমিও ‘গুন্ডা’ নিতে পারতাম।

ইয়াসমিন আবারো দীর্ঘএক নি:শ্বাস ফেলে বলেন, “আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন আর কোন দিনও পূরণ হবেনা!” 

ইয়াসমিন ও তার ছোট পাঁচ ভাইবোন, বড় ভাই ও মা এখন শুধু মাথা গুজার ঠাঁই খুঁজে বেড়াচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। হয়তো আশ্রয়ের ঝুঁপড়ি পেয়ে যাবে কিছু দিনের মধ্যে। কিন্তু তার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন কি সে আবার দেখতে পারবে? বাবার ইচ্ছে পূরণের সুযোগ কি তার হবে? সে কি পাবে এমন এক বিদ্যালয় যেখানে তাকে আর কোন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেনা কেউ? এইসব প্রশ্ন কি শুধু প্রশ্নবোধক চিহ্নই হয়ে থাকবে নাকি তার কোন উত্তর মিলবে?

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ