শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

আরাকানে রোহিঙ্গাদের ৫০ হাজার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে

কামাল হোসেন আজাদ/ শাহজালাল শাহেদ : মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে অব্যাহত রয়েছে সেদেশের সৈন্যদের সন্ত্রাসী সহিংস কর্মকাণ্ড। একে একে জনশূন্য করা হচ্ছে মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলো। নিধনজজ্ঞ কোনভাবেই থামছে না। পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে নতুন নতুন গ্রামগুলোর ঘরবাড়ি। 

গত দেড় মাসেও আরাকানের উত্তর ভূখন্ডে মিয়ানমারের নাগরিক স্বীকৃতিপ্রার্থী রোহিঙ্গাদের নৃশংসভাবে হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুন্ঠনসহ এমন কোন অপরাধ নেই; যা তারা করছে না। রোহিঙ্গাদের গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, খোয়াড়ভরা ছাগল, দোকানভরা মালামাল, হ্যাচারী ও ফিশারী ভর্তি মাছ সবই লুটপাট করে নিচ্ছে। ফলে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে সেখানে। খাবারের জন্য হাহাকার অবস্থা বিরাজ করছে রোহিঙ্গাদের মাঝে ।

সূত্র জানিয়েছে, এরইমধ্যে উত্তর আরাকানের ছোট বড় পাঁচশতাধিক রোহিঙ্গা গ্রামের ৫০ হাজার বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে মগ সৈন্যরা। এতে করে প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম দেশান্তর হয়েছে। তৎমধ্যে সাড়ে পাঁচ লাখের মতো পাড়ি জমিয়েছে বাংলাদেশে। ৫০ হাজার রোহিঙ্গা গহীন পাহাড়ে, দ্বীপে ও সমুদ্র তীরে আশ্রয় সন্ধান করছে । উত্তর আরাকানে আরো লাখ তিনেকের মতো রোহিঙ্গা মুসলমান রয়েছে। যাদের বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলো সৈন্যরা অবরোধ করে দখলে নিয়েছে। ফলে কোন রোহিঙ্গা জীবিকার সন্ধানে বের হতে পারছে না। এমনকি হাটবাজারেও যেতে মানা । চিকিৎসা নিতে ব্যর্থ হয়ে মারা যাচ্ছে রোগিরা । সামগ্রিক সংকটকালে খাদ্যও ফুরিয়ে গেছে তাদের। ফলে খেয়ে না খেয়ে বহু রোহিঙ্গা মুসলমানের দিনাতিপাত করতে হচ্ছে।

এদিকে, আন্তর্জাতিক খাদ্য সংস্থাসহ দেশি-বিদেশী এনজিওগুলোর কর্মীদের আগস্টের শেষ দিকে উত্তর আরাকান ছাড়তে বাধ্য করে প্রশাসন। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে বৈশ্বিক চাপে পড়ে নামমাত্র ত্রাণ কিছু অসহায় রোহিঙ্গাদের মাঝে বিলি করতে দেখা গেছে। আবার অনেক গ্রামে প্রশাসন ত্রাণ বিতরণের কয়েকটা ছবি তোলে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। যার দরুন মানবিক সংকটে পড়েছে আরাকানের নিরীহ মানুষগুলো। 

জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থা জানিয়েছে, ৮০হাজার শিশু আরাকানে অপুষ্টিতে ভুগছে। মূলত খাদ্যের অভাবে স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে সেখানে। দু’দিন আগে উখিয়ার কুতুপালং মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন মংডুর কিয়াম্বং এলাকার বাসিন্দা আবু তাহের ও তার স্ত্রী ফাতেমা বেগম। তারা জানিয়েছেন, বার্মার সেনাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রাণ বাজি রেখে লুকিয়েছিলেন তারা। কিন্তু, খাওয়ার মতো কিছুই ছিল না। বিশুদ্ধ পানি থেকে শুরু করে কোনও ধরনের খাদ্য সামগ্রী নেই আরাকানে।

শীলখালী গ্রামের আবুল কালাম জানান, যারা পাহাড়ের কিনারায় বসবাস করছিলেন, তারা এতদিন বাংলাদেশে না এসে পালিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। কিন্তু, এখন আর সেখানে থাকার কোনও সুযোগ নেই। খালি পড়ে থাকা বসতবাড়ি থেকে শুরু করে বিভিন্ন হাটবাজার ও চালের গুদামগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে সেনাবাহিনী। ধ্বংস করছে কোটি টাকার সম্পদ।

শুক্রবার (৬ অক্টোবর) জুমার দিনে আরাকানের বিভিন্ন এলাকায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য দেখা গেছে। ওইদিন রাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে মংডুর উত্তরে ডাংগার ডেইল বাজারে। এতে কোটি কোটি টাকার পণ্য আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। একইভাবে বুথিদংয়ের নারাইংশং, বুজরংশংসহ আলিয়ং বাজারের রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীদের দোকানপাট পুড়িয়ে দিয়েছে। ক্ষতি হয়েছে রোহিঙ্গাদের কয়েক কোটি টাকার সম্পদ ।

২৫ আগস্ট সহিংসতা শুরুর পর আরাকানে কত সংখ্যক মানুষকে বর্মী বাহিনী হত্যা করেছে তা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও, ন্যূনতম পাঁচ হাজার থেকে সাড়ে সাত হাজার রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছে বলে ধারণা পাওয়া যায়। এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে সাতটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সৈন্যরা হত্যা পরবর্তী হেলিকপ্টারে করে লাশ নিয়ে গিয়ে গহীন পাহাড়ে গণকবর দিয়েছিল। বাংলাদেশ পালিয়ে যাওয়ার সময় অনেক গণকবর প্রত্যক্ষভাবে দেখেছে রোহিঙ্গারা ।

বুথিদং’র আলিয়ং বাজারে সৈন্যদের অগ্নিসংযোগ:

বুথিদং উপজেলার মুসলিম পল্লীর প্রসিদ্ধ বাজার আলিয়ং বাজারে অগ্নিসংযোগ করেছে বর্মী সেনাবাহিনীর সদস্যরা। শনিবার সকালে অন্তত এক প্লাটুন সৈন্য বাজারটি ঘেরাও করে বন্ধ দোকান পাটে আগুন দেয়। এতে বহু রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীর দোকানপাট পুড়ে গেছে।

সূত্র জানিয়েছে, আলিয়ং বাজারটি রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যবসার একটি বড় ক্ষেত্র ছিল। স্কুল, মাদরাসা, ইউনিয়ন অফিস ও স্থানীয় রোহিঙ্গা পল্লীগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে বাজারটি হওয়ায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের সমাগম ছিল। কিছুদিন আগে মগ প্রশাসনের তরফ থেকে রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীদের বাজারটি বন্ধ করে দেয়ার জন্য নোটিশ দেয়া হয়। সে থেকে দোকানপাট বন্ধ রাখে ব্যবসায়ীরা। এরপর সকালে অগ্নিসংযোগ করে ব্যবসার বড় ক্ষেত্র আলিয়ংবাজারটি পরিণত করা হয় ধ্বংসস্তুপে। আগুনের লেলিহান শিখা পাশ্ববর্তী বসতঘরেও ছড়িয়ে পড়ে বলে জানা গেছে।

আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, বুথিদং বাজারে রোহিঙ্গাদের যেতে হলে এনভিসি কার্ড তথা অভিবাসন কার্ড নিতে হয়। তাই সৈন্যরা আলিয়ং বাজার পুড়িয়ে দিয়েছে, যাতে রোহিঙ্গারা বুথিদংমুখী হয়ে পড়ে এবং এনভিসি নিতে বাধ্য হয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ