শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

অর্থনীতির শ্লথ গতিতে বেকারত্ব বাড়ছেই

 

এইচ এম আকতার: দেশের অর্থর্নীতি এগুচ্ছে শ্লথ গতিতে। বিনিয়োগ স্থবির হওয়ার কারণে দিন দিন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। অথচ অর্থনীতিতে কালো টাকার পরিমাণ বাড়ছে। পাচার আর কালো টাকা বিনিয়োগ না হওয়ার কারণেই এই সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। বেকারত্ব মোকাবেলা করাই দেশের জন্য বৈশি^ক চ্যালেঞ্জ। বেকারত্বের সংখ্যা ২৬ লাখে দাঁড়ালেও সরকার বলছে কমচে। অর্থনীতির গতি প্রতিফলিত হয় শিল্প-কারখানার নিয়োগচিত্রে। আর তা স্পষ্ট বোঝা যায় চাকরির বাজারে তরুণ জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তিতে। 

 দেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে। বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে ক্রমশ। সম্প্রতি প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের রিপোর্টে (ডব্লিউইএফ) বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আগামীতে ১৫টি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ বা ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বেকারত্ব। আর এ বছরের মে-তে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) একটি জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যাতে বলা হয়েছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে বেকারের সংখ্যা এখন ২৬ লাখ।

 বিবিএসের হিসেবে, উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি-নয় শতাংশ। কয়েক বছর আগে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বিশ্বে বাংলাদেশেই শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে বলা যাবে না। দেশে বেকারের সংখ্যা যে ব্যাপকহারে বাড়ছে তার কিছুটা নমুনা দেখা যায় সম্প্রতি যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে আয়োজিত চাকরি মেলায় আসা প্রার্থীদের ঢল দেখে।

তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে যাদের জ্ঞান বা কাজের অভিজ্ঞতা আছে, তাদের জন্যই এই মেলার আয়োজন ছিল। উদ্যোক্তাদের ধারণা ছিল তিন হাজারের মতো চাকরিপ্রার্থী আসতে পারেন। মেলায় চাকরিপ্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত দেখে সরাসরি কর্মী বাছাই করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু মেলায় আসা চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজারেরও বেশি। শেষ পর্যন্ত চাকরি প্রত্যাশীরা নির্দিষ্ট বাক্সে জীবনবৃত্তান্ত রেখে চলে যান।

 বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এছাড়া গড় আয়ুও বেড়েছে। কিন্তু কর্মসংস্থানের জন্য যে বিনিয়োগ দরকার তাতে যথেষ্ট ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশে বর্তমানে নতুন শিল্প-কারখানা তৈরি হচ্ছে না। আর বেসরকারি উদ্যোগে শিল্প-কারখানা গড়ে না উঠলে কাঙ্তি কর্মসংস্থান তৈরি হবে না। ফলে বেকারের সংখ্যা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।

 ছোট এই দেশে জনসংখ্যার চাপ অনেক বেশি। তাই প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। একজন মানুষের অপরাধী হওয়ার সঙ্গে তার অর্থনৈতিক অবস্থার একটি সম্পর্ক রয়েছে। একজন শিক্ষিত যুবক সঠিক সময়ে কর্ম ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে না পারলে তার মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়। পারিবারিক ও সামাজিক উপেক্ষা একজন বেকার যুবকের, বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার যুবকের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। এর ফলে সে অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়ে পড়তে পারে। কাজেই আমাদের উন্নয়ন কৌশলে কর্মসংস্থানকেই এক নম্বর অগ্রাধিকার করার পাশাপাশি তা যথাযথ বাস্তবায়নের প্রতি সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। বেকার তরুণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করতে পারলে উন্নয়নের সব পরিকল্পনাই মুখ থুবড়ে পড়বে। সরকারের শীর্ষমহল এবং শ্রম-শিল্প-কর্মসংস্থান সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে। সুতরাং বেকারত্ব হ্রাস ও কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যে এখনই পদপে নেয়া দরকার।

 বেকারত্ব কমিয়ে আনতে হলে সুষ্ঠু বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি শিল্প-কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। দূর করতে হবে গ্যাস-বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো সংকট। শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য জমি পাওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান দীর্ঘসূত্রতা-জটিলতা দূর করতে হবে। স্বল্প সুদে দ্রুত ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান তৈরিতে ভূমিকা রেখে সরকারের অংশীদার হিসেবে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। 

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সব সূচকেই উন্নতিতে বাংলাদেশ। যদিও কর্মসংস্থান সম্প্রসারণে তা কাজে আসছে না। তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বরং কমছে। কর্মসংস্থানের সুযোগের এ ঘাটতিতে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে তরুণ শ্রমশক্তির বড় একটি অংশ।

বাংলাদেশের শ্রমবাজারের প্রকৃত চিত্র তুলে আনতে সম্প্রতি এ নিয়ে একটি গবেষণা করেছে বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলছে, ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের হার বেড়েছিল বার্ষিক ৩ দশমিক ১ শতাংশ হারে, যা ওই সময়ে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়েও বেশি। 

২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে কর্মক্ষম মানুষ বেড়েছিল ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে। অর্থাৎ্ শ্রমবাজারে যুক্ত হওয়া তরুণদের পাশাপাশি বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হয়েছিল ওই সময়। এর পর থেকে কর্মসংস্থানের হার শ্লথ হয়ে পড়ে। ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কর্মক্ষম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারেরও নিচে নেমে আসে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি। এ সময় কর্মসংস্থান বেড়েছে বার্ষিক মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ হারে।

২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৩০ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের মধ্যে বেকারত্বের হার আগের মতোই বা ক্ষেত্রবিশেষে কমেছে। কিন্তু তরুণদের মধ্যে এ সময়ে বেকারত্বের হার বেড়েছে। অর্থাত্ কয়েক বছর ধরে কর্মস্থানের সুযোগ কমে যাওয়ার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে তরুণদের ওপর। উচ্চপ্রবৃদ্ধির মধ্যেও তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমার এ প্রবণতাকে উদ্বেগ হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংক।

বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৩ অনুযায়ী, ওই সময়ে কর্মে নিয়োজিত ছিল ২ কোটি ১৪ লাখ ৬৫ হাজার তরুণ। শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৫-১৬তে এ সংখ্যা নেমে এসেছে ১ কোটি ৮৯ লাখ ৮৯ হাজারে। কর্মক্ষম তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হারও বেড়েছে এ সময়। ২০১৩ সালে কর্মক্ষম তরুণদের মধ্যে বেকার ছিল ৮ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৫-১৬ সালে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ। বেকারত্বের হার আবার উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেশি। উচ্চশিক্ষিত তরুণদের ১২ দশমিক ১ শতাংশ বেকার।

কর্মসংস্থানের সুযোগ খুব একটা না বাড়লেও তা কমেনি বলে দাবি করেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, কর্মসংস্থানের সুযোগ খুব বেশি বাড়াতে পেরেছি, তা বলা যাবে না। পোশাক খাতের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকলেও তা হচ্ছে না। অন্যান্য খাতও ততটা শ্রমঘন নয়। আমাদের তরুণরা কৃষি কর্মসংস্থানে যাচ্ছে না। তবে যেটুকু কর্মসংস্থান হওয়ার কথা, সেটা আমরা করতে পেরেছি।

কর্মসংস্থান বাড়ানোর নানা উদ্যোগের কথা জানিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, উদ্যোক্তা তৈরির ব্যবস্থা আছে আমাদের। অনেকে এখন সেবা খাত, ক্ষুদ্র-মাঝারিসহ বিভিন্ন লিংকেজ শিল্পে নিজের কাজের সুযোগ তৈরি করে নিচ্ছে। একই সঙ্গে অন্যের কাজেরও সুযোগ সৃষ্টি করছে। বছরে ২০ লাখ করে গত পাঁচ বছরে প্রায় এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে বৈদেশিক শ্রমবাজারেও।

জানা গেছে, দেশের সবচেয়ে শ্রমঘন পোশাক শিল্পে গত তিন বছরে প্রায় ১ হাজার ২০০ কারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে কর্মসংস্থান হারিয়েছে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক, যার বড় অংশই তরুণ। কর্মসংস্থান হ্রাসের চিত্র দেখা গেছে বহুজাতিক কোম্পানিতেও। বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণায় শেভরন বাংলাদেশের অনেকেই চাকরি হারিয়েছে। টেলিকম সেবা খাতের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানেরও সহস্রাধিক তরুণ কর্মসংস্থান হারিয়েছে গত কয়েক বছরে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি কামরান টি চৌধুরি বলেন, আমাদের শ্রমশক্তিতে প্রতি বছর যুক্ত হচ্ছে ১৮-২০ লাখ জনগোষ্ঠী। কিন্তু সবার জন্য কর্মসংস্থান দেশে করতে পারছি না। বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। আমাদের আন্ডার এমপ্লয়মেন্টও অনেক বেশি। সার্বিকভাবে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। আবার দক্ষতা বৃদ্ধির অবকাঠামো ও কর্মসূচিও তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগ আরো জোরদারের মাধ্যমে তরুণসহ গোটা শ্রমশক্তির কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।

শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, তরুণদের জন্য শ্রমবাজারে তেমন কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না। কারণ শিল্প একটি রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই কর্মসংস্থানে সংখ্যাগত উল্লম্ফন নেই। এছাড়া অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে অন্যান্য শিল্পও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে না। ফলে শিল্পনির্ভরতা ক্রমেই বাড়তে থাকলেও সেখানে কর্মসংস্থানে অনেকটা স্থবিরতা বিরাজ করছে।

এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ধারাবাহিক বিকাশ শিল্পের স্বাভাবিক নিয়ম হলেও অবকাঠামোগত দুর্বলতায় বর্তমানে এতে কিছুটা স্থবিরতা বিরাজ করছে। এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে কর্মসংস্থানে। তবে শীঘ্রই অবস্থার পরিবর্তন হবে।

 দেশের বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি হলে বেকারের সংখ্যা কমে আসবে। সরকার দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আমরা বিনিয়োগকারীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছি। সরকার এ কারণেই গ্যাস এবং বিদ্যুতের সংযোগ সহজ করেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আনারও চেষ্টা চালাচ্ছে। একই সাথে বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর চেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ