বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

এক মায়ের আকুতি...

তাজমিম আক্তার : স্নিগ্ধ সুবাস ভোরের বাতাস, সূর্যের কিরণ, আকাশ যেন সেজে থাকে রঙিন সাজে, সুবহানাল্লাহ! প্রতি প্রভাতে আসে প্রকৃতির মায়াবী এই ক্ষণ। কিন্তু দেখা হয় না, প্রতিদিন সকাল বেলাটা যেন ঘড়ির কাঁটার সাথে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তাড়াহুড়া আর তাছাহুড়া। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে যেতে হয়Ñ ইস্টার্ন হাউজিং, কখনো রিক্সায়, না পেলে পায়ে হেঁটে, স্কুলের গেটে পৌঁছিয়ে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস, আবার বাসায় ফেরা, প্রতিদিন আসার সময় শুনতে পাই একটা শব্দ-
কইরে তোরা? কেউ নাহি শুনে। সবুজ! সবুজ! কইরে? ভাঙ্গা ভাঙা আওয়াজ, ডাকের মাঝে কত আকুতি। স্কুলে যাওয়ার সময় এদিক-সেদিক তাকানোর সময় হয় না। কিন্তু স্কুলে বাচ্চা রেখে বাসায় আসার সময় পথে তাড়াটা কম, তাই এটা সেটা দেখার ফুরসত হয়। প্রতিদিনই এই কথাগুলো শুনতে আসি।
কিন্তু একদিন ভাবলাম, দেখিতো কে? কাকে ডাকছে। আগ্রহের বশীভূত হয়ে রাস্তার পাশে ড্রেন, তার পাশে বেড়ার ঘর, নুইয়ে ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকলাম। ঘরের ভিতরে একটা মাচা, তার ওপর জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় একজন বৃদ্ধ মহিলা শুয়ে আছে। পরণে ময়লা কাপড়, রুক্ষ মাথার চুলু হয়তো আশির কাছাকাছি বয়স। হাড়-চামড়া ছাড়া শরীরে আর কিছুই নেই। বিছানার পাশে একটা মটকাতে পানি রাখা আছে। কয়েকটা চটের বস্তা আর দুটি কাঁথা,একটি গ্লাস, একটি প্লেট, মাথার কাছে দেয়ালের দড়িতে দুই একটা কাপড় ঝুলে আছে। ঘরে ঢুকামাত্রই গন্ধে উৎকটন নাক জ্বলে যাচ্ছে যেন। মনে হচ্ছে বৃদ্ধ মহিলাটা বিছানায় তার প্রয়োজনীয় কাজ সারে। তারপরও আমি ঘরে ঢুকলাম। তাকে সালাম দিলাম,  বললাম: কাকে ডাকছো বুড়ি মা। আমাকে দেখে বৃদ্ধ মহিলা নড়েচড়ে উঠতে চাইল। কিন্তু উঠার শক্তি নেই।
বৃদ্ধ মহিলা বলল : কে বাহে?
আমি বললাম : আমাকে তুমি চিনবে না। তোমার আওয়াজ শুনে আসলাম। কাকে ডাকছ তুমি? আর সবুজটাই বা কে?
আমি আরও জানতে চাইলাম তুমি এখানে কেন? তোমার কেউ নেই?
বৃদ্ধ মহিলাটির চোখ দু’টি ছলছল করে উঠল, চোখে-মুখে অব্যক্ত যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি। বিষন্ন মুখে বলল : দুই পোলা, এক মাইয়া, আসে না কেউ? খোঁজ-খবর নেয় না। বলতে বলতে থেমে গেল, চুপ করে রইল কিছুক্ষণ।
আমি বললাম : তোমাকে কে খাওয়ায়। বলল, যার দয়া হয় সে দেয়।
এ কেমন জীবন! মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে। নিজের চোখে না দেখলে বুঝা যায় না, আমি ফিরে আসি। মনে কেমন যেন অশান্তি, তখন থেকে একটা টান এই ছোট ঘরটার প্রতি। প্রায়ই এটা সেটা নিয়ে খেতে দিতাম। বৃদ্ধ মহিলার ছোট ছোট ইচ্ছা, পছন্দ পূরণ করতে চেষ্টা করেছি। তার মধ্যে ইলিশ মাছ, মুরগির সালুন খাবে। আর কত বায়না। জর্জরিত দেহের বেদনায় কাতর, বিরক্তির আভাস ফুটে উঠত। বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকত। স্কুল বন্ধ থাকলে এই পথটিতেই খুব বেশি যাওয়া হত না। তবু মাঝে মাঝে খোঁজ নিতাম। শুনতাম এমনও দিন যায় তার খাবার ভাগ্যে জুটেনি। আমি শুনে রাস্তার এই পাড়ের হোটেল থেকে খাবার কিনে এনে খাওয়াতাম। তার থাকার পরিবেশ দেখে অনেক খারাপ লাগত। কষ্ট পেতাম। মনে মনে ভাবতাম, রাস্তার নিকৃষ্ট প্রাণীর জীবনও তো এই মহিলার চেয়ে অনেক ভাল। তারাও তো তাদের অবস্থার পরিবর্তন করে সুবিধা বুঝে। আর এই বৃদ্ধার এতটুকু সুবিধা নেই। একে তো ড্রেনের গন্ধ। তার ওপর নিজের ঘরের নোংরা দুর্গন্ধ ধেকার কেউ নেই। শীত-গ্রীষ্ম, রোদ-বৃষ্টি সব মুখ বুঝে সহ্য করে যাচ্ছে। এই পৃথিবীতে কত জায়গা, অথচ এই বৃদ্ধার জন্য কোথায়?
এক সময় জানতে পারলাম, তার ছেলেরা ড্রেনের পাশে এই দুই হাত জায়গা দখল নেয়ার জন্য তাকে এখানে রেখে যায়। হায়রে মানুষ! অবাক হলাম। বৃদ্ধ মহিলাটি কাঁদতে কাঁদতে বলে, মা! সারা রাত মশা কামড়ায়। ঘুমাইতে পারি না, ক্ষুধা লাগে, কাউরে ডাইকা কইতে পারি না, ভয় লাগে কাউরে লগে পাই না। আমাকে পেলে তার কত কথা, বলবে না-ই বা কেন? তার কথা শুনার মানুষও তো নেই। আমাকে পেলে কতটা যে খুশি হত। এ কথা সেকথা বলতে চাইতো। কিন্তু আমি বেশি সময় সেখানে অবস্থান করতে পারতাম না। ঘরের পরিস্থিতি এমনটাই ছিল, তবু মানবতা। কি এক নেশায় আমাকে এই বৃদ্ধার কাছে টেনে নিতো। এটা-ই কি মানবতা? না-কি মহান আল্লাহ্র সৃষ্টি মানবের প্রতি ভালবাসা? তা জানি না। বৃদ্ধ মহিলাটি কত কস্টে দিনাতিাত করছিল। অথচ স্বার্থপর সন্তানদের সেদিকে খেয়াল ছিল না। তবু আমার মনটাকে বুঝ দিতে পারতাম। মহান মহান আল্লাহ্ বলেছেন-
“তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারো ‘ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, তাদের একজন অথবা উভয়ে যদি তোমাদের জীবদ্দশায় বার্ধক্য উপনীত হয় তবে তাদেরকে উহু শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বলো তাদের সাথে সম্মানসূচক ন¤্র কথা।”
যেখানে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় ‘ইবাদত বন্দেগী অতঃপর পিতা-মাতার হক্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত করেছেন। মহান আল্লাহর পর মানুষের সর্বাধিক ইহসান বা অনুগ্রহ থাকে পিতা-মাথার সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছেন, সেখানে আমাদের সমাজে সদ্ব্যবহার তো দূরের কথা, ঘর হতে বের করে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে। অথচ পিতা-মাতার আনুগত্য ও সেবা জান্নাতে নিয়ে যায় আর তাদের অসন্তুষ্টি জাহান্নামে পৌঁছে দেয়। অর্থাৎ- তারা আমাদের জান্নাত অথবা জাহান্নাম। মা-বাবা কথাটিই অনেক আপন, যার মাঝে ভালবাসা, মায়া, মমতা জড়িয়ে আছে। মা মানে মা, এর তুলনা হয় না। মা কষ্টেরপর কষ্ট বরণ করে সন্তান গর্ভে ধারণ করে। কত যন্ত্রণা সহ্য করে তার সন্তানকে বুকের মাঝে আগলে রাখে, সন্তানের মুখের হাসিই মায়ের আনন্দ, কত ত্যাগ, কত বিসর্জন, কত রাত না ঘুমিয়ে রাতভর সন্তানের সেবা করেছেন। এ সবই মা নামের এই শব্দের বৈশিষ্ট্য। এই বৃদ্ধাও নিশ্চয়ই একদিন এক আদর্শ মা ছিলেন। আজ তার মূল্য নেই। তাকে কারো প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই দুর্বল অসহায় বৃদ্ধ মা তার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সন্তানের ভবিষ্যৎ-এর জন্য, মঙ্গলের জন্য, মাটি আঁকড়ে পড়ে ছিল দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, একা একা। আমি ভেবে ছিলাম আমাদের দেশে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র বৃদ্ধাশ্রমে তাকে রেখে আসব। যাতে করে সে মনুষ্য সমাজে বাস করতে পারে। সেখানে তার পাশে আরো অনেকে থাকবে। তা আর হয়ে উঠেনি। ঈদুল ফিতরে স্কুল বন্ধ ছিল টানা এক মাস। ঈদের আনন্দ শেষে স্কুল খোলে। আবার সেই ব্যস্ততা, সেই তাড়াহুড়া কিন্তু বৃদ্ধ মিহলাকে তার ঘরে আর দেখতে পেলাম না। পাশের একটা লোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাতম বৃদ্ধ মহিলা মারা গেছে। আমার মন এমন একটা খবর শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ভিতরে ভিতরে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। বৃদ্ধার ছেলেরা এই জায়গাটা অবশেষে দখল নিতে পারেনি। অথচ মাকে যতটা কষ্ট দেয়ার ততটা কষ্ট দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। মানুষের মাঝে কোথায় মনুষ্যত্ব?
মহান আল্লাহ্র বিধান কত সুন্দর, কতটা দয়াময়, কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, অর্থাৎ “আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছি।” সূরা আল- ‘আনকাবুত ২৯: ৮।
মহান আল্লাহ্র এই আদেশ, নির্দেশ, বিধান সবই তো মানুষের কল্যাণের জন্য। তাই মানুষকেই তা বাÍবায়ন করতে হবে। পিতা-মাতার মর্যাদা মহান আল্লাহ দান করেছেন। আমাদেরকে গুরুত্বের সাথে মর্যাদা দিতে হবে, মর্যাদার হক্বদার পিতা-মাতা।
পরিচালক, মাদ্রাসা দারুস সুন্নাহ্। মহিলা শাখা, মিরপুর ঢাকা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ