বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

চ্যাম্পিয়ানদের ঘরেই সন্ত্রাসের বীজ!

বিবেকবান, নীতিবান মানুষের গুরুত্ব সব সমাজেই স্বীকৃত। তবে দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমান সভ্যতায় এ জাতীয় মানুষের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। কোনো সমাজে বিবেকবান মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেলে সে সমাজের দুঃখ বাড়ে। ট্র্যাজেডি হলো, এই বিষয়টি মানুষ বোঝার  পরেও ভুল রোডম্যাপে চলতেই যেন বেশি ভালোবাসে। এর পরিণতি যা হবার তাতো হবেই। বর্তমান বিশ্ব তার জ্বলন্ত প্রমাণ। লক্ষণীয় বিষয় হলো, বর্তমান সভ্যতার শাসকদের মধ্যে প্রায় সবাই বিবেকের বার্তাকে অগ্রাহ্য করে অন্যায়, অবিচার ও নিপীড়নের পথকে বেছে নিয়েছেন। মানবরূপী এসব দানবরা আবার বড় গলায় কথা বলেন। বিশ্বব্যবস্থার বিভিন্ন প্রসঙ্গে নসিহতও করেন। গদি থেকে সরে যাওয়ার পরও তাদের জিহ্বা লকলক করে। সুযোগ পেলেই বিভিন্ন প্রসঙ্গে তারা কথা বলেন। তাদের জঘন্য ও স্ববিরোধী বক্তব্যের কড়া জবাব দেয়া সময়ের দাবি হলেও সেই কর্তব্য পালনে কেউই তেমন এগিয়ে আসেন না। নীতিহীন বর্তমান সভ্যতায়  এমন চিত্রই যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। তবে এমন বাতাবরণের মধ্যেও বিবেকের তাড়নায় কেউ কেউ সত্য উচ্চারণে কুণ্ঠিত নন। এদেরকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
প্রসঙ্গত আমরা আমেরিকার শিকাগো অঙ্গরাজ্যের খ্যাতিমান সাংবাদিক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক স্টিফেন লেন্ডম্যানের কথা উল্লেখ করতে পারি। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের জন্য দোজখের বিশেষ জায়গা অপেক্ষা করছে। বুশকে যুদ্ধাপরাধী এবং অন্ধ ও গোঁড়া বলেও অভিহিত করেন এই লেখক। গত ২০ অক্টোবর প্রেস টিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে লেন্ডম্যান এসব কথা বলেন। উল্লেখ্য যে, নিউইয়র্কের জর্জ ডব্লিউ বুশ ইন্সটিটিউটে প্রদত্ত বক্তৃতায় সাবেক প্রেসিডেন্ট মি. বুশ গোঁড়ামি, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব এবং মার্কিন রাজনীতিতে মিথ্যা চর্চার নিন্দা করেন। এসবই বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পের নীতির বিরুদ্ধে যায়। আমেরিকায়  শেতাঙ্গদের প্রাধান্যের বিরুদ্ধেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন বুশ। বুশের এসব কথার জবাবে লেন্ডম্যান বলেন, ‘বুশ হচ্ছেন সাজা না পাওয়া যুদ্ধাপরাধী, ঈশ্বর জানেন তার এখন কারাগারে থাকার কথা, সেই ব্যক্তি নিজের নাম উল্লেখ না করে ট্রাম্পের সমালোচনা করছেন অথচ তিনি নিজে একজন গোঁড়া, বর্ণবাদী এবং আরো অনেক কিছু। দুই দফার শাসনামলে নিজের ঘৃণ্য রেকর্ডগুলো উপেক্ষা করছেন বুশ।’ লেন্ডম্যান আরো বলেন, বুশই আফগানিস্তান ও ইরাকে নগ্ন আগ্রাসন চালিয়েছেন এবং আমেরিকায় মুসলমানদেরকে নিপীড়নের মুখে ফেলেছেন। তিনি আরো বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পেরও সমালোচনা করার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে ট্রাম্প বুশের চেয়ে গোঁড়া এবং বর্ণবাদী নন। বুশের হাত রক্তে রঞ্জিত যা কখনও মুছে যাবে না। তার জন্য দোজখের বিশেষ জায়গা অপেক্ষা করছে। তিনি নাইন-ইলেভেনের ভয়াবহ ঘটনার সাথে জড়িত।
আমরা জানি, নাইন-ইলেভেনের ঘটনা বর্তমান দুঃসহ বিশ্ব পরিস্থিতির জন্য দায়ী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ঘটনা কারা ঘটিয়েছে? বুশসহ অনেকেই তো এ ঘটনার জন্য মুসলমানদের দায়ী করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু উক্ত ঘটনার জন্য মুসলমানেরা যে দায়ী নয় তা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক স্টিফেন লেন্ডম্যানও বলেন, নাইন-ইলেভেনের ঘটনায় ওসামা বিন লাদেন কিছুই করেননি। আরবদের দায়ী করা হয় কিন্তু তারাও দায়ী নন। সব কিছু করেছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। কিন্তু তিনি এদের কারো বিচার করেননি। বরং তিনি লেগেছেন অন্যদের পেছনে। নাইন-ইলেভেনের ঘটনাকে পুঁজি করে অন্য দেশের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এবং মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এইসব রেকর্ড হচ্ছে জর্জ ডব্লিউ বুশের, এগুলো সম্পর্কে অন্য কাউকে অভিযুক্ত করা যাবে না। এমন তথ্য-উপাত্তের পর আমরা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে কোন নামে অভিহিত করবো? আমরা কি আসলেই কোনো সভ্য পৃথিবীতে বসবাস করছি?
আমরা যে সভ্য পৃথিবীতে বসবাস করছি না তার বড় প্রমাণ যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ প্রতিদিনই নিজেদের বুলেট ভরা হ্যান্ডগান নিয়ে ঘুরে বেড়ান। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক এক গবেষণার ফলাফলে গত বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানানো হয়। আমেরিকান জার্নাল ‘পাবলিক হেলথের’ এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, যারা বন্দুক নিয়ে ঘুরেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই তরুণ, তারা দক্ষিণাঞ্চলে বাস করেন। নিজেদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্যই তারা বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ান বলে জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য যে, স্কুল, কনসার্ট এবং বিভিন্ন স্থানে বন্দুক হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নতুন এই গবেষণা চালানো হয়েছে। গত ২০ বছরে এই প্রথম কোন জাতির বন্দুক বহনের অভ্যাসের ওপর গবেষণা চালানো হলো। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে বন্দুক হামলার ঘটনা বেড়েই চলেছে। ২০ অক্টোবর তারিখে খবরটি পরিবেশন করেছে এএফপি। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর ইপিডেমিলোজির সহযোগী অধ্যাপক আলি রওহানি বাহবার বলেন, হ্যান্ডগান বহনের বিষয়ে গবেষণা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ৯০ শতাংশ হত্যাকা- বা সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটে থাকে হ্যান্ডগান তথা আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে। কি পরিমাণ মানুষ তাদের সঙ্গে হ্যান্ডগান তথা আগ্নেয়াস্ত্র বহন করছে সে বিষয়ে যাচাই করাটা এখন খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। আর লক্ষণীয় বিষয় হলো, যারা হ্যান্ডগান বহন করেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই পুরুষ এবং তারা তরুণ। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, যারা হ্যান্ডগান বহন করেন তাদের মধ্যে ৮০ ভাগেরই এ ধরনের অস্ত্র বহনের অনুমতি রয়েছে। আর এদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই তাদের হ্যান্ডগান বহন করেন গোপনে, দশ শতাংশ খোলামেলাভাবেই তাদের হ্যান্ডগান বহন করে থাকেন। অনেকের আবার এ ধরনের অস্ত্র বহনের অনুমতি নেই। তবুও অবৈধভাবেই তারা অস্ত্র বহন করছেন।
বর্তমান সময়ের সবচাইতে উন্নত ও সভ্য রাষ্ট্র বলে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লখ মানুষের বুলেট ভরা হ্যান্ডগান নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর এমন চিত্র আমাদের অবাক করে বৈকি! নিজেদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্যেই তারা এভাবে হ্যান্ডগান নিয়ে ঘুরে বেড়ান বলে জানানো হয়েছে। প্রশ্ন জাগে, যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশ- যেখানে আইন-আদালত আছে, আইনের শাসন আছে, গণতন্ত্র আছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে; সেখানে লাখ লাখ মানুষকে বন্দুকসহ এভাবে ঘুরে বেড়াতে হবে কেন? যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকায় স্কুল, কনসার্ট এবং জনসমাগমস্থলে ব্রাশফায়ার করে শিশু-কিশোর ও নর-নারীকে যখনই হত্যা করা হয়, তখন প্রশ্নের গভীরতা আরো বেড়ে যায়। এত উন্নত একটি দেশে কী করে মানুষের ভেতর এমন জিঘাংসা ও সন্ত্রাসের মনোভাব বিরাজ করে ? জর্জ বুশের আমল থেকে তো যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পৃথিবীময় যুদ্ধের এলান জারি করেছে। কিন্তু অন্যদিকে যে ঘরেই যুক্তরাষ্ট্রের বহু নাগরিকের মনে সন্ত্রাসের বীজ বপিত হয়ে আছে সেই খবর তারা রাখলেন না কেন? আমরা মনে করি, বিষয়টি ধামাচাপা না দিয়ে এবং সঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণ করা মার্কিন নেতাদের জন্য এখন খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ