শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ব্যয়ের চাপে দিশাহারা মানুষ

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : একটি ভালো রাষ্ট্রের সংজ্ঞা কী? ধনী দেশ ও আন্তর্জাতিক লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে অজস্র প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন, উঁচু ইমারত নির্মাণ, রঙিন মরিচাবাতি জ্বালিয়ে রাস্তাঘাট, দালানকোঠা আলোকিত করা কোন ভালো রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য নয়! অন্যদিকে মন্দ দেশের সংজ্ঞা কী? অন্য সব দোষের কথা বাদ দিলেও শুধু একটি কারণে কোনো দেশ একটি মন্দ দেশ হিসেবে গণ্য হতে পারে, যদি সেখানে ভিন্নমত পোষণকারী মানুষের জীবন হয়ে উঠে অনিরাপদ এবং নিরপরাধ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে হয় বঞ্চিত। কোনো দেশ বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে গেলেও সাধারণ মানুষের কিছুই আসে যায় না এবং তাদের গর্ব করার মতো কোনো কারণই থাকে না,যদি না সেখানে আইনের শাসন ও দুবেলা দুমুঠো ভাত খাওয়ার নিশ্চয়তা না থাকে। আইনের শাসনের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। মানুষের জীবন বাঁচায় যে খাদ্যদ্রব্য তা যদি আকাশছোঁয়া চড়া দামে কিনতে হয় তখন আর দুঃখের সীমা থাকে না। প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় সব ক্ষেত্রেই বেড়েই চলেছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোর কারণে সরাসরি এর প্রভাবটা পরিবারের ব্যয়ের উপর পড়ছে। আর এ কারণে পণ্য উৎপাদন ও পরিবহন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে নি¤œ ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ। সরকারের আজ্ঞাবহ লোকজনের মুখে উন্নয়নের কথা শুনে মাঝেমধ্যে পুলকিত হয়। কিন্তু যখন দেখি এক কেজি কাঁচা মরিচের দাম দুই কেজি চালের দামের সমান তখন আর হিসেবটা মিলাতে পারি না।
একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে যখন আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটে তখন সেখানে অপরাধীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। তবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারই পারে অপরাধীর বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে। যারাই ক্ষমতায় থাকেন তারাই বলেন জনগণের ভাগ্যের পরির্বতনের জন্য রাজনীতি করেন। অথচ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। কারণ যারাই ক্ষমতার গদিতে বসেন তারাই হিটলার মুগুলিনির উত্তরসূরীর ভূমিকা পালন করেন।
জনগণের কল্যাণে যদি রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করতেন তাহলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় এতো বেড়ে যেতো না। দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে স্বস্তির নিঃশ্বাসটুকু সাধারণ মানুষ ফেলতে পারছে না। একদিকে গুম, খুন, অপহরণের বিভীষিকা। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী মানুষকে কষ্টের ফ্রেমে বন্দি করে দিচ্ছে। দেশের সরকার যখন শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ফন্দি করে তখন আর সেখানে রাষ্ট্রীয় ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না। এই সরকার প্রশ্নবিদ্ধ একটি নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করছে এটা তো অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ক্ষমতায় এসেই সরকারী চাকরিজীবীদের বেতন দ্বিগুণ করে দিয়েছে। এটা দোষের তা আমি বলছি না। কিন্তু সরকারের উচিত ছিল বেসরকারি কোম্পানীগুলোতে কর্মরতদের জন্যও একটা বেতন কাঠামো দাঁড় করানোর ব্যবস্থা করা। একটা সময় মানুষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করতো। কিন্তু এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠানে লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরিটা নিতে পারলে জীবনে আর কিছু লাগে না। এমনিতেই গাড়ি বাড়ি সব হয়ে যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতন বৈষম্য না থাকলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতন বৈষ্যমের পার্থক্য আকাশ-জমিন। দেশের স্বনামধন্য কিছু পাবলিক লিমিটেড কোম্পানীতে আমার পরিচিত কিছু লোক চাকরি করেন। তাদের নিকট থেকে জানতে পারলাম তারা বেতন বৈষম্যের শিকার। একজন তো বলেই ফেলল যে কোম্পানীর এমডি, জিএম, ম্যানেজারদের বেতন আর সাধারণ কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতনের ব্যবধান আকাশ-পাতাল তফাত। এই দেশে যদি ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত থাকতো তাহলে একজন পিয়ন কিংবা ক্লিনারের বেতন আর রাষ্ট্রপ্রধানের বেতনের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান হতো না। এই বৈষম্য দূর করা তো সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু সরকার তা করছে না। এই সমস্যার সমাধান শুধুমাত্র আইন করে নিরসন করা সম্ভব নয়। ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল নাগরিক তার সুফল ভোগ করতে পারবে।
যুক্তরাজ্যের বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট এর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) গত মার্চে প্রকাশিত এক জরিপ অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল নগরীর তালিকায় শীর্ষ শহর এখন ঢাকা। জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিক দিয়ে বিশ্বের মোট ১৩০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ৬২তম। এই জরিপ সরকার হঠানোর জরিপ নয়! তবু সরকার বাহাদুর গ্রহণ করবেন কি না এটাই দেখার বিষয়! অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী ২০১০ সালে দেশের একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা। বিপরীতে খরচ ছিল ১১হাজার ২০০ টাকা। ফলে প্রতি মাসে সাশ্রয় করতে পারতো ২৭৯ টাকা। ২০১৬ সালে একটি পরিবার সাশ্রয় করতে পারতো ২৩০ টাকা। আলোচ্য বছর একটি পরিবারের গড় আয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা এবং ব্যয় ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশর ক্যাব এর ভাষ্যমতে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৭১ শতাংশ। ক্যাব বলছে, রাজধানীতে ২০০৯ সালের দুই শয়নকক্ষ বা বেডরুমের একটি পাকা বাসার গড় ভাড়া ছিল ১০ হাজার ৮০০ টাকা,২০১৬ সালে তা ১৯ হাজার ৭০০ টাকা উঠেছে।
সংসারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার ফলে বিপাকে পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। নিত্যপণের আকাশ ছোঁয়া দামের সদাইপাতির হিসাবটা কোনভাবেই মেলানো যাচ্ছে না। নিম্নবিত্তের জন্য এক একটা দিন পার করাটা কত যে কষ্টের তা কেবলমাত্র অভুক্ত পরিবারই অনুধাবন করতে পারে। মধ্যবিত্তের দিনও যেন আর চলে না। দরজায় কড়া নাড়ছে শীত। তবু সবজির বাজারে আগুন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব বলছে,গত তিন মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে দ্বিগুণ। বাজার ভেদে পণ্যের দাম বাড়ার হার আরো বেশি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাজারে সিটি কর্পোরেশনের মূল্যতালিকা থাকলেও তা হালনাগাদ কিংবা তদারকি করা হয় না। রাজধানীর বাজারগুলোতেও নেই কোন তদারকি। আর সে গুযোগে ইচ্ছেমত দাম হাঁকান একশ্রেণীর অসাধু বিক্রেতা। বাজারে এখন সবচেয়ে কম দামি সবজির দাম ৬০ টাকা। কেন বাড়ছে শাকসবজির দাম। এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারোরই। তবে কাঁচা শাক-সবজির দাম বাড়ার অজুহাতের অভাব নেই বিক্রেতাদের। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভাষ্যমতে, এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক আট সাত যা গত বছর একই সময়ে ছিলো ৫ দশমিক এক শূন্য। শুধু মাত্র গত তিন মাসেই এই মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ হয়েছে। গত এক বছরে গ্যাসের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পায়তারা চলছে। এ অবস্থায় নিম্নবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তদের মধ্যেও হতাশা বাড়ছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ভারসাম্য রাখতে কাটছাঁট করতে হচ্ছে প্রতিদিনের বাজার তালিকা। ব্যয় এতটাই বেড়েছে যে জীবন চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। কয়েক মাস ধরে চাল, ডাল, লবণ, তেল, পিঁয়াজ কাঁচামরিচ সব পণ্যেই লেগেছে দামের আগুন। আর কাঁচাবাজারের তাপে পুড়ে যাচ্ছে হাত। শিক্ষার ব্যয়ও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। নানা ছুঁতোয় বাড়ি ভাড়া বাড়াচ্ছে বাড়িওয়ালা। দিন যেন চলতে চায় না। তারপরও দিন চালাতে হয়। চলছে। চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। দুঃখ, কষ্ট আর যন্ত্রণা বুকে চেপে সংসার নামক ঘানিকে টেনে নিচ্ছে নি¤œমধ্যবিত্তরা। তাদের জীবনে নেই কোনো আশা-আকাঙ্খা, নেই কোন উচ্চাভীলাস। তারপরও তাদের উপরই খড়গ চলছে বারবার। ফলে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় জীবনযাপনে হিমশিম খাচ্ছেন সীমিত ও মধ্য আয়ের মানুষগুলো। পাঠকের নিশ্চয় মনে থাকার কথা ২০০৪ সালে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে একবার কাঁচা মরিচের কেজি ১০০ টাকা হয়েছিল। তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা তখন বলেছিলেন, মানুষ বিএনপি-জামায়াতকে ভোট দেয়ার ঝাল বুঝুক! এবার তো বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় নেই তাহলে কেন মরিচের কেজি তিনশ টাকা? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? চৈত্র-বৈশাখ যেমন বারো মাস থাকে না তেমনি ক্ষমতার দাপটও কাহারও চিরদিন থাকে না। এই বিষয়টি ক্ষমতাসীনদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন। দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশা সরকার জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর জন্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে দিশাহারা মানুষের আর্তনাদ উপলব্ধি করবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ