শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

পেঁয়াজের দাম এখন সেঞ্চুরিতে

এইচ এম আকতার: সারা দেশে আবার অস্থির হয়ে উঠেছে পেঁয়াজের বাজার। বাজার মনিটরিং না থাকায় বেপোরয়া পেঁয়াজ সিন্ডিকেট। ধাপে ধাপে বৃদ্ধিতে এখন সেঞ্চুরির (শতকের) পথে এই নিত্যপণ্যের দাম। ভারতে পেঁয়াজে দাম বেশি এমন অজুহাতে দেশের বাজারে পেঁয়াজে দাম এক’শ টাকা ছুঁইছে। সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে বেড়েছে প্রায় ২৫-৩০ টাকা পর্যন্ত। গতকাল রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতিকেজি দেশী পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৯৫ থেকে ১০০ টাকায়। চলতি সপ্তাহে দাম কমার সম্ভাবনা তো নেই বরং বাড়বে।
অথচ দেড় মাস আগে দেশী পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। আমদানি করা পেঁয়াজ ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। সে হিসাবে গত দেড় মাসের ব্যবধানে কেজিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৫০ টাকা। এর মধ্যে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুই দফায় দাম বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা। এক মাস আগে দাম ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। দেড় মাসের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ১০০ শতাংশ। এছাড়া বছরের তুলনায় দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অন্যদিকে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। গতকাল সরেজমিন রাজধানীর কাওরান বাজার ঘুরে দেশী ও আমদানি করা পেঁয়াজের কোনো সংকট দেখা যায়নি।
বাজারে পাইকারি আড়তে পর্যাপ্ত পরিমাণ পেঁয়াজের বস্তা দেখা গেছে। আর খুচরা বাজারেও কোনো ধরনের সংকট লক্ষ্য করা যায়নি। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের পেঁয়াজের বাজার ভারত থেকে আমদানির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। ভারতের বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়েছে, তাই দেশেও এর প্রভাব পড়েছে। এছাড়া ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানিও কমে গেছে। এ কারণে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়তি। অন্যদিকে পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে দেশী পেঁয়াজ আছে, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। দেশী পেঁয়াজের পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই, তাই দাম একটু বাড়তির দিকে।
কাওরান বাজারের পেঁয়াজ কিনতে আসা শান্তিনগরের বাসিন্দা এবং সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা জাহানারা বেগম বলেন, যেভাবে পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে বাড়ছে তাতে সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। তিনি বলেন, কাল এক পাল্লা ৪২০ টাকা দিয়ে নিয়েছি আজ ৪৪০ টাকা। তিনি পেঁয়াজের বাজারে মনিটরিং জোরদারের দাবি করেন।
শ্যাম বাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সুজন বলেন, বাজারে পুরান পেঁয়াজ শেষের দিকে। নতুন করে আবাদ করা পেঁয়াজ এখনও কৃষকের জমিতে আছে। সেই নতুন পেঁয়াজ আসতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। তাই বাজারে দেশী পেঁয়াজের ঘাটতি রয়েছে, যার কারণে দাম একটু বাড়তির দিকে। তিনি বলেন, নতুন পেঁয়াজ এলেই দাম আবার কমতে থাকবে। দয়াগঞ্জ বাজারের খুচরা পেঁয়াজ বিক্রেতা মো. মানিক মিয়া বলেন, আড়ৎদাররা বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন। যে কারণে তাদেরও বেশি দামে পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। আর বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে। পাইকারি বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেই শেষ পর্যন্ত এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে ভোক্তার ওপর। আমদানি করা পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বড় ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার লোভের অভিযোগ সামনে আনছেন আড়ৎদাররা। তারা বলছেন, মূলত আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে বড় ব্যবসায়ীরা দেশী পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সঠিকভাবে বাজার মনিটরিংয়ের অভাব এই জন্য দায়ী বলে মনে করছেন তারা।
 পেঁজারের ঝাঁজ খাবারের স্বাদ বাড়ালেও, আতঙ্ক বাড়িয়ে চলছে বাজারে। লাগামহীন দামে জনজীবনে অস্থিরতার নতুন মাত্রা যোগ করে চলছে এই ঝাঁজ। আর বাজারে দাম বাড়ার প্রতিযোগিতায়ও এখন শীর্ষে রয়েছে পণ্যটি।
 গেল তিন থেকে চার মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। আর গেলো এক সপ্তাহে তৈরি হয়েছে যেন ভৌতিক অবস্থা।
জানা গেছে, চালের পর এবার পেঁয়াজের বাজারে সিন্ডিকেট স্বক্রিয় হয়ে উঠেছে। আগাম বন্যার অজুহাতে চালের পর এবার তিনগুণ হারে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে পেঁয়াজের দাম। বাজার নিয়ন্ত্রণে নেই সরকারের কোন উদ্যোগ। এতে করে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের বাজার। মজুদ সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে না পারলে এই বাজার আরও লাগামহীন হয়ে পড়বে। এক মাসে পেঁয়াজের দাম ৯০ টাকা থাকলে তা কমে ৫৫-৬০ টাকা নেমে আসে। কিন্তু মাত্র এক সপ্তহের ব্যবধানে আবারও বেড়েছে কেজিতে ২৫-৩০ টাকা।
বাজার ইতোমধ্যে নতুন পেঁয়াজ আসতে শুরু করেছে। এসময় পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কোন কারণ নেই। তাহলে কি কারণে পেঁয়াজের দাম বাড়লে তা কেউ বলতে পারছে না। তারা ভারতের বাজারে পেঁয়াজে দাম বৃদ্ধিকে দাযী করছেন। আসলে এটি কোনভাবেই ঠিক নয়। দেশে এখন পেঁয়াজ গাছসহ বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা। তাহলে কেন পেঁয়াজে দাম বাড়বে। মূলত এটি সিন্ডিকেটের কারসাজি।
এসব সিন্ডিকেটের গুদামে মজুদ রয়েছে কয়েক লাখ টন পেঁয়াজ। হঠাৎ করে পেঁয়াজের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখন তারা আমদানি মূল্য বৃদ্ধির অজুহাত দিচ্ছে। অথচ অর্ন্তজাতিক বাজারে পেঁয়াজে দাম বাড়েনি। সরকার চাইলে ভারতে ছাড়া অন্য কোন দেশ থেকেও পেঁয়াজ আমদানি করতে পারে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর কোন উদ্যোগ নেই।
গতকাল শ্যামবাজার, যাত্রাবাড়ি, কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল ও কাঁঠালবাগান বাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে এ সব তথ্য জানা গেছে।
বাজারে খুচরা পর্যায়ে দেশী পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৯০-১০০ টাকা আর ভারতীয় পেঁয়াজ ৮৫ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। আর পাইকারী পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে দেশী পেঁয়াজের পাল্লা (৫ কেজি) সাড়ে ৪’শ টাকা আর ভারতীয় পেঁয়াজের পাল্লা ৩৪০ টাকায়।
দাম নিয়ে মোকামের ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে এমন অভিযোগ করে পাইকাররা জানান, বৃষ্টির কারণে ভারতে কিছুটা দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশী পেঁয়াজে। তবে বড় ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে অধিক মুনাফার আশায় দেশী পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছেন।
কারওয়ান বাজারের ৪৩ নং আড়ত মিনহাজ বাণিজ্যালয়ের হৃদয় হোসেন বলেন, সম্প্রতি বৃষ্টির কারণে ফরিদপুর, পাবনাসহ উৎপাদনকারী কয়েকটি এলাকায় প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে।
এছাড়া ভারতের পেঁয়াজের ওপর বাংলাদেশকে নির্ভর করতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মত ভারতেও বৃষ্টিতে পেঁয়াজের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, দেশটিতে প্রায় ২০ জাতের পেঁয়াজের উৎপাদন হয়। তবে বাংলাদেশে যে কয়েক জাতের পেঁয়াজ আসে তার মধ্যে সাউথ, বেলুরিয়া পেঁয়াজ অন্যতম। কিন্তু এই দুটি জাতের পেঁয়াজই নষ্ট হয়েছে বেশি। সেজন্য দাম বেড়েছে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী।
জানা গেছে, ভারতের পরিস্থিতির উপরই বাংলাদেশের পেঁয়াজ, রসুন, আধা মরিচসহ মসলার বাজার নির্ভর করে। ভারতের বাজারে এসব পণ্যের দাম বাড়লেই বাংলাদেশের বাজারেও বাড়তে থাকে। ব্যাখ্যা একটাই ভারতের বাজারে দাম বেড়েছে। একটি দেশ এভাবে একটি প্রতিবেশি দেশের ওপর নির্ভর করতে পারে না। আর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার কারনেই তাদের ইচ্ছা মত দাম বাড়ে দাম কমে।
সূত্র মতে বাংলাদেশে এসব পন্যের যে বছর ফলন ভাল হয় সে বছর ভারতেই পন্যের আমদানি মূল্যও কম থাকে। এতে করে দেশীর পণ্যের তুলনায় ভারতীয় পণ্যের দাম কম থাকে। আর এ কারণে ভারতীয় পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে। এতে করে স্থানীয় উৎপাদনকারিরা লোকসানের সম্মুখিন হয়। ফলে পরবর্তী বছর আর ঐ পণ্য উৎপাদনে উৎসাহ হারায়। এতে পন্যটির মূল্য বাড়তে বাধ্য।
এ বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে ভারতীয় কৃষকরা পেঁয়াজের কম হওয়ার কারণে রাস্তায় ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে। প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল মাত্র ৫ টাকা। বাংলাদেশের বাজারে তাদের পেঁয়াজ তখন বিক্রি হয়েছে ২০-২৫ টাকায়। মাত্র ৪ মাসের ব্যবধানে এমনকি হলো সে পেঁয়াজের দাম বেড়ে দাড়িয়েছে ৮০-৮৫ টাকা।
ভরতের ৪টি রাজ্যে আগাম বণ্যা হলেও পেঁয়াজ উৎপাদন হয় এমন রাজ্যে কোন বন্যা হয়নি। তাছাড়া শীত মওসুমেই সারা বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়ে থাকে। ভারত আর বাংলাদেশে বছরে এক মওসুমেই এই পেঁয়াজের উৎপাদন হয়ে থাকে। তাহলে চলতি বছরের জুন মাসের বন্যায় পেঁয়াজের ওপর কোন প্রভাব পড়ার কথা নয়। এতে বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় এই দাম বৃদ্ধির পেছনে দুই দেশের সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে। কিন্তু এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রনের দায় কার। সরকার যদি ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি না করে বিকল্প কোন দেশ থেকে আমদানি করতে পারে তাহলেই সিন্ডিকেট ভেঙ্গে পড়বে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
আমদানি করা পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বড় ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার লোভের অভিযোগ সামনে আনছেন আড়তদাররা। তারা বলছেন, মূলত আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে বড় ব্যবসায়ীরা দেশী পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সঠিকভাবে বাজার মনিটরিংয়ের অভাব এই জন্য দায়ী বলে মনে করছেন তারা।
নিম্ন আয়ের মানুষের দাবি সরকার খোলা বাজারে আতপ চাল বিক্রি করলেও তার কোন ক্রেতা নেই। এসব ট্রাকে সরকার পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারে। এতে করে পেঁয়াজের বাজার কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু সরকার তা না করে দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
 ক্রেতাদের অভিযোগ সরকার যদি মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার না করে তাহলে এ পন্যটির দাম আরও বাড়বে। কারণ নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসবে আরও তিন মাস সময় লাগবে। এর আগে পেঁয়াজের দাম কমার কোন সুযোগ নেই।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ