রোহিঙ্গাদের খাবারে স্বনির্ভরতা আনতে আইল্যান্ড সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ
শাহজালাল শাহেদ, কক্সবাজার: মিয়ানমারের আরাকানে চলছে মুসলমান নির্যাতন। থেমে নেই মগ সৈন্য ও উগ্রপন্থীদের বর্বরতা। খুন হয়েছে বহু মানুষ। ধর্ষণের শিকার হয়েছে শত-শত নারী কিশোরী। পুড়িয়ে দিয়েছে অগণিত ঘরবাড়ি। আর এসব ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতি থেকে প্রাণে বাঁচতে আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে সীমান্ত পাড়ি। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়াদের, দেয়া হচ্ছে সরকারি বেসরকারি ত্রাণের সহযোগিতা। তবে এভাবে ত্রাণের উপর মুখিয়ে থেকে পরিবার চালানো সম্ভব নয়।
চাষবাস করে অন্তত শাক সবজি খাতে হলেও স্বনির্ভরতা আনতে এবার ভিন্নমাত্রার ত্রাণ সহযোগিতা নিয়ে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক ব্রোকারেজ হাউস আইল্যান্ড সিকিউরিটিজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির এমন উদ্যোগ ও তৎপরতা রোহিঙ্গাদের দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিক আহারের পরিপূর্ণতা এনে দিবে। সেইসাথে খাবারের বিষক্রিয়া (ফুড পয়েজন) রোধে এ শাক সবজি মূখ্য ভূমিকা রাখবে বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন স্বাস্থ্য বিশ্লেষকগণ।
তারা মনে করেন, অনেক সময় রুচি-চাহিদা অনুসারে পরিবর্তনযোগ্য খাবারের প্রয়োজন পড়ে। শুধু চাল, ডাল আর আলু দিয়ে কয়দিন খাবেন। কেউ তো ত্রাণ হিসেবে সবজি দেবে না। কিন্তু শরীরে পুষ্টি জোগাতে সবজি দরকার। তাই খাবারে বৈচিত্র্য আর স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে আইল্যান্ড সিকিউরিটিজ লিমিটেডের তরফ থেকে বীজ কিনে চারা গজিয়ে সবজি গাছ বিতরণের এমন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা সকিনা বেগম গত আড়াই মাসে অনেক ধরনের ত্রাণ পেয়েছেন। দেশী-বিদেশী এসব ত্রাণের মধ্যে নগদ টাকা, তাঁবু, চাল, ডাল, বিস্কুট, তেল, কাপড়, ওষুধ থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের কিছুই বাদ নেই। কিন্তু গত ১৭ নবেম্বর ত্রাণ হিসেবে লাউ গাছের চারা হাতে পেয়েছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এই নারী। সকিনা বেগমসহ কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় বালুখালী ক্যাম্প-২ এর থাইনখালী ঘোনাপোড়া এলাকার প্রায় ৫ হাজার পরিবার এ ধরনের লাউ গাছের চারা পেয়েছেন। ২৪ নবেম্বর এ ধরনের আরও ৬ হাজার লাউয়ের চারা বিতরণ করা হয়। পর্যায়ক্রমে বিতরণের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল সাড়ে ৩ হাজার পুঁইশাকের চারা ও প্রায় ২শ রেডলেডি জাতের পেঁপে গাছের চারা। যা শুক্রবার ১ ডিসেম্বর বিতরণ করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে চারা বিতরণের এ ধরনের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক ব্রোকারেজ হাউস আইল্যান্ড সিকিউরিটিজ লিমিটেড। তারা ইতোমধ্যে একটি মসজিদও নির্মাণ করেছে। যেই মসজিদ কেন্দ্রিক গড়ে ওঠেছে মক্তব। বসেছে ছোটখাট বাজার।
ব্যতিক্রমী উদ্যোগের পেছনের গল্প বলতে গিয়ে আইল্যান্ড সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দীন এফসিএমএ বলেন, আমরা ক্যাম্পের আশেপাশে ২৯টি টিউবওয়েল বসিয়েছি। কিন্তু পানির ব্যবস্থা হলে কি হবে, মানুষের স্যানিটেশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করছে, তাতে রোগব্যাধি ছড়িয়ে মহামারীর আশঙ্কা দেখা দেয়। তখন আমরা বালুখালী ক্যাম্পে ৬০টি স্যানিটারি টয়লেট বসালাম। আমাদের দেখে অন্যরাও এগিয়ে এল। একাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন স্থানীয় মোহাম্মদ মোতাহের মিয়া, সোলতান আহমেদসহ বেশ কিছু লোক। ঠিক এ ধরনের ব্যতিক্রমী চিন্তা থেকেই মনে হলো, শুধু চাল, ডাল আর আলু দিয়ে কয়দিন খাবে। কেউ তো ত্রাণ হিসেবে সবজি দেবে না। খাবারে বৈচিত্র্য এবং স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করেই বীজ কিনে চারা গজিয়ে সবজি গাছ বিতরণের পরিকল্পনা নিই। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় আইল্যান্ড সিকিউরিটিজের সিনিয়র অ্যাক্সিকিউটিভ ও চকরিয়া শাখার কর্মকর্তা মোহাম্মদ জিয়াউর রহমানকে।
জিয়াউর রহমান বলেন, অফিসের নির্দেশ পেয়ে ক্যাম্পের আশেপাশে নার্সারি তৈরির কাজে লেগে যাই। নার্সারিতে মোট ১০ হাজার লাউয়ের চারা, ৩ হাজার পুঁইশাকের চারা এবং ২০০ রেডলেডি জাতের পেঁপে গাছের চারা পরিচর্যা শুরু করি। ইতোমধ্যে ৫ হাজার পরিবারের মধ্যে লাউয়ের চারা বিতরণ করা হয়েছে।
লাউ গাছ কেন ত্রাণ হিসেবে দেওয়া হলো? এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, লাউ গাছ খুব দ্রুত বাড়ে। এটার জন্য বাড়তি কোনো জায়গার প্রয়োজন হয় না। এই গাছের পাতা যেমন শাক হিসেবে তেমনি লাউ সবজি হিসেবে পুষ্টিকর। তাছাড়া লাউয়ের মাচা রৌদ্রের খরতাপ থেকে ঘরকে ঠান্ডা রাখে। এসব বিবেচনায় লাউ গাছকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
মহতি এই উদ্যোগে সার্বিক সহায়তায় ছিলেন- আইল্যান্ড সিকিউরিটিজের পরিচালক নাকিব উদ্দিন নিশাদ, সিনিয়র ব্যবস্থাপক আবু সাঈদ, চকরিয়া শাখার ব্যবস্থাপক ফজলুর রহমান ও কক্সবাজার তথ্যসেবা কেন্দ্র শাখার ইনচার্জ আবু ওবাইদা মুন্না।
এদিকে আইল্যান্ড সিকিউরিটিজের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন একশান এইড-এর বিদেশী এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, অনেকে অনেক রকম ত্রাণ দিয়েছে। কিন্তু লাউ চারা যে ত্রাণ হিসেবে দেয়া যায়, তা সত্যিই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এর মাধ্যমে লাউচারা বড় হলে ঘরের চালে ছায়া দিবে। অন্যদিকে লাউ ও শাক দুটোই খাবার হিসেবে উপকারে আসবে।